জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৭৭

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা  ১৭৭
সম্পাদক : মৌসুমী ঘোষ 
চিত্রগ্রাহক - কল্যাণ সাহা
জীবজন্তুদের নানা মজার কথা
সুমনা সাহা

পর্ব- ৯
মনসা পুজো ও সাপের কথা


বুকাই খুব মন দিয়ে পুজোর স্থানটি দেখছিল। তকতকে নিকানো দাওয়ার একপাশে চন্দ্রাতপের নিচে বেদির উপর প্রতিমা এনে বসানো হয়েছে গতকাল সন্ধ্যায়। পিছনে একটি প্রাচীন নিম গাছের ছায়া। সকালের মিষ্টি আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে দেবীর মুখে খেলা করছে। একটা বিরাট পদ্মফুলের উপর মা মনসা বসে আছেন, তাঁর চারটে হাত। উপরের দুই হাতে পদ্ম আর নিচের দুই হাতে দুটো সাপ। দেবী প্রতিমার মাথার উপরেও সাতটা ফনাওয়ালা সাপের ছাতা। কোঁকড়ানো চুলগুলোও যেন কিলবিলে সাপের মত। দেবীর কোলে একটা ছোট বাচ্চার মত। আজ বাড়ির সবাই খুব ব্যস্ত। দাদু বলেছেন, “আজ আর কোথাও টো টো করে ঘুরে বেড়িও না। ঘরেই থাকো। লোকজন আসবে, সকলের সঙ্গে আলাপ কোরো।” বুকাই তাই গিনিকে বলে দিয়েছে, “কাল রাত্রে বাবা এসেছে। আজ আর বেরোব না রে, ঘরে থেকেই পুজোর কাজকর্ম দেখব। দাদুও ঘরে থাকতে বলেছেন। পরশু তো আমাদের ফেরার ট্রেন। তুই ভূতোদাদাকে ডেকে আনিস।” গিনির মুখটা ম্লান হয়ে গেল বুকাইরা চলে যাবে শুনে। পিঠে আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে বুকাই পিছন ফিরে দেখল দাদু তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, “কি দেখছ দাদুভাই?”
“ঠাকুর। দাদু ঠাকুরের মাথায় নারায়ণের মত সাপ কেন?”
“নারায়ণের মাথায় সাপ থাকে তুমি দেখেছ?”
“হ্যাঁ, ঠামি ভাগবত পড়ে, সেখানে একটা ছবি আছে, নারায়ণ সমুদ্রে শুয়ে আছেন আর মাথায় বিরাট ছাতার মত সাপের ফনা। ঠামি বলেছে ওটা বাসুকী বা শেষনাগ। মনসারও তো নারায়ণের মত চার হাত। তাহলে কি মনসা লেডি নারায়ণ?” 
দাদু বুকাইয়ের কথা শুনে হেসে ফেললেন। হাসি আর থামতেই চায় না। তারপর হাসি থামিয়ে বুকাইয়ের হাত ধরে দাওয়ার অপর প্রান্তে দড়ির খাটিয়ায় বসলেন, বললেন, “তুমি ভাই আমার কাছে থেকে যাও। তোমার মায়ের কাছ থেকে আমি চেয়ে নেব তোমায়। তোমার চিন্তার চলন দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আসলে দাদুভাই, মনসার আরেক নাম পদ্মা। নারায়ণের স্ত্রী লক্ষ্মীর মতোই। মনসা তো সর্পদেবী, আর সাপ ফসল ক্ষেতের ইঁদুর খেয়ে ফেলে ফসল রক্ষা করে বলে অনেকে মনসা পুজোকে লক্ষ্মীপুজোও বলে। মা লক্ষ্মী তো শ্রী-সমৃদ্ধির প্রতীক, আগেকার দিনে চাষবাসই ছিল সমৃদ্ধির উপায়। কিন্তু পুরাণে মনসার জন্মের বিবরণ অনুযায়ী তিনি শিবের মেয়ে অথবা কশ্যপ ঋষির কন্যা। কদ্রু তার মা, বাসুকী হলেন দাদা।”
“আর কোলে বাচ্চার মত ওটা কি?”
“ওটা বাচ্চাই তো। মা মনসা তাঁর ছেলে আস্তিককে কোলে নিয়ে বসে আছেন।”
“তোমরা মনসা পুজো করো কেন?”
“কেন করি?” দাদু কেমন উদাস হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “এ হল বংশের রীতি। অনেকবছর ধরে চলে আসছে, তাই ভাঙতে সাহস পাই না। আমাদের বংশের পূর্বপুরুষদের কেউ একজন সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলেন। সেই থেকে এই পুজো আরম্ভ হয়েছিল সর্পদেবী মনসাকে সন্তুষ্ট করতে, যাতে পরিবারে আর কেউ সাপের কামড়ে মারা না যায়। তুমি বেহুলা লখিন্দরের গল্প শোননি?”
“হ্যাঁ, ঠামি বলেছে। চাঁদ সদাগর মনসার পুজো করেনি বলে রেগে গিয়ে মনসা এক এক করে তার সাত ছেলেকে সাপ পাঠিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। লখিন্দরের জন্য লোহার বাসর ঘর তৈরি করা হয়েছিল যাতে সাপ ঢুকতে না পারে। কিন্তু একটা ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে সাপ ঢুকে লখিন্দরকে কামড় দিয়ে বিষ ঢুকিয়ে দিল, আর তখন লখিন্দরের মৃতদেহ নিয়ে বেহুলা স্বর্গে গিয়ে দেবতাদের নাচ গান করে সন্তুষ্ট করে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিল, অনেকটা এরকমই ছিল গল্পটা।”
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। মনসা নৃত্য গীত প্রিয়। তাঁর পুজোয় তাই নাচ গানের ব্যবস্থা থাকে। এখানেও হবে। পশ্চিমবাংলার প্রায় সব গ্রামেই সমস্ত আষাঢ়-শ্রাবণ মাস জুড়ে মনসা পুজো হয়। ঐ সময়ই সাপখোপের উপদ্রব বাড়ে কি না! অনেক জায়গায় ভাদ্র মাসেও পুজো হয়। আসলে মনসা পুজো বেশির ভাগই পারিবারিক পুজো, আর প্রত্যেক পরিবারেই পুজোর নেপথ্যে সাপের কামড়ে মৃত্যুর মত কোন ইতিহাস থাকে, ফলে পুজোর সময় সব জায়গায় এক থাকে না। অনেক বাড়িতে কার্ত্তিক মাসে কালিপুজোর পরও মনসা পুজো হয়, আমাদের মুর্শিদাবাদেই ডাঙ্গাপাড়ায় ২২ পুতুলের পুজো হয়। কালিপুজোর পঞ্চমীর পর থেকেই শুরু হয় এই পুজো। নাচ, বাউলগান, কথকতা, যাত্রাপালা কত কী হয়!”
“সাপের হাত থেকে বাঁচতে লোকে তো শিব পুজো করলেও পারে। শিবের গলায় সাপ পেঁচানো থাকে। কৃষ্ণ পুজোও করতে পারে। কালীয় সাপের মাথার উপর নেচে কৃষ্ণ ওকে শেষ করে দিয়েছিল।”
“তা তো পারেই। যে কোন বিপদে যে কোন একজন দেবতাকে ভক্তি করে ডাকলেই হয়। কিন্তু এসব সম্প্রদায়ের ব্যাপার। তুমি বড় হলে বুঝতে পারবে। শৈব, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অভিজাত দেবী নন মনসা। তিনি যেন দেবতা সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তার উপর নারী। শিব, বিষ্ণু এঁরা হলেন পুরুষ দেবতা। অনেক ঝগড়াঝাঁটি আর বিদ্রোহ করে তবেই মনসাকে নিজের পুজো আদায় করতে হয়েছে। সুতরাং দেব দেবীর পুজোও একরকম সাম্প্রদায়িক অধিকার প্রতিষ্ঠা। এখন তো মনসা পুজো মেয়েদের ব্রতর মধ্যে আঞ্চলিক গ্রামদেবী হয়েই বেঁচে আছে।”
“আচ্ছা দাদু, পৃথিবী থেকে সব সাপ মেরে ফেললেই তো ভাল হয়। তাহলে সাপের কামড়ে কেউ আর মরে যাবে না!”
“তুমি যতটা সহজ ভাবছ দাদুভাই, আসলে কাজটা ততটা সহজ নয়। প্রতি বছর সাপের কামড়ে সারা পৃথিবীতে গড়ে প্রায় এক লাখ মানুষ মারা যায়। তোমার মত অনেকেই ভাবতে পারে, সাপ না থাকলেই বেশ হত। কিন্তু প্রকৃতির কোনো প্রাণীই হঠাৎ লোপ পায় না। সময় লাগে। পরিবেশ ও প্রকৃতির বিরাট পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে কোনো কোনও প্রাণী ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। এ ছাড়া মহামারি বা  বড় কোনও দুর্যোগের কারণেও কোনো কোনো প্রাণিগোষ্ঠি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু সাপের ক্ষেত্রে এমন হওয়ার সম্ভাবনা কম, যেহেতু প্রকৃতির নানা পরিবর্তনের সঙ্গে সাপ নিজেকে খুব ভাল ভাবে মানিয়ে নিতে পারে। পৃথিবীতে প্রায় ৩৪০০ প্রজাতির সাপ আছে আর তারা কোথায় নেই? সমুদ্রে, পাহাড়ে, সমতলে, বনে বা মরুভূমিতে—সব জায়গাতেই সাপ বাস করে। তাই প্রাকৃতিক ভাবে সাপ লোপ পেয়ে যাবে, এমন সম্ভবনা খুবই কম। সাপ নিশ্চিহ্ন করতে হলে আমাদেরই তাহলে পৃথিবীর সব সাপ মেরে ফেলতে হবে। সেটাও বেশ মুশকিল।”
“কেন দাদু? মুশকিল কেন?”
“কেন? তোমাকে যদি কেউ মারতে আসে, তুমি কি করবে? পালাবে তো? সাপও চট করে পালিয়ে যাবে। সাপের কিন্তু কান নেই। তাতেও তার কোনো অসুবিধা হয় না। ত্বক দিয়েই দিব্যি শব্দ তরঙ্গ বুঝতে পারে। সাপের দৃষ্টি শক্তিও দুর্বল। সব রং তারা দেখতে পায় না। তবে তাদের চোখের আছে দারুণ এক ক্ষমতা। ইনফ্রারেড আলো ধরা পড়ে সাপের চোখে। ফলে তাপের কোনো উৎস খুব সহজেই চোখে পড়ে এদের। সাপের জিভেরও আছে অদ্ভুত ক্ষমতা। কেবল স্বাদ নয়, বাতাসের গন্ধ শুঁকে বিপদ আঁচ করতে পারে সাপ জিভের সাহায্যে। এদের চোয়ালের পেশী অসম্ভব স্থিতিস্থাপক, নিজের চেয়ে আকারে বড় শিকারকেও গিলে ফেলতে পারে নিমেষে।

🍂

সব মিলে সাপের অনেকগুলো হাতিয়ার আছে। এদের বংশ নির্বংশ করা মোটেই সহজ নয়। তবুও ধরা যাক, সব সাপ মেরে ফেলা হলো। পৃথিবী পুরোপুরি সাপ মুক্ত হয়ে গেল। তুমি ভাবছ, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, কিন্তু না। সাপ লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে অন্য অনেক সমস্যা। সাপের খাদ্য ইঁদুর, পাখি বা ব্যাঙ ইত্যাদি প্রাণী। সাপ না থাকলে এসব প্রাণীর সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এরা হামলা চালাবে মানুষের খাদ্যভাণ্ডারে, অর্থাৎ শস্যক্ষেত্রে। ক্রমবর্ধমান এদের হাত থেকে খাদ্য বাঁচাতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে কৃষকদের। এটা একদিক থেকে যেমন স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ, তেমনই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে হু হু করে। ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে গেলে বিউবোনিক প্লেগের মতো মহামারি পৃথিবীতে আবারও ফিরে আসতে পারে। শুধু প্লেগ নয়, নতুন নতুন মহামারিও দেখা দিতে পারে বিশ্বজুড়ে। প্রাণিজগতে তাই কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রতিটি প্রাণীই এই পৃথিবীর জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। সাপকে তো বিদায় করব, তারপর ইঁদুরের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাদের আবার এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার খোঁজ করতে হবে।”
এই বলে দাদু হা হা করে হেসে উঠলেন। বুকাই মন দিয়ে দাদুর কথা শুনছিল, তাই খেয়াল করেনি কখন ভূতো ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছে। গিনি আর রাজিও দিব্বি চোখ গোল গোল  করে দাদুর কথা গিলছে। দাদু বললেন, “বুকাইয়ের মাথায় অনেক প্রশ্নের চাষ হয়। বলো, আর কি প্রশ্ন জমেছে মনের মধ্যে?” 
(ক্রমশ)

জয়দীপ সাহা
অষ্টম শ্রেণি, সোদপুর হাই স্কুল, উত্তর ২৪ পরগণা

রথের মেলা 

গৌরাঙ্গ দাস 

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। যত ঝঞ্জাট বাঁধালো বৃষ্টিটা। কেন, আর কিছুটা সময় পরে নামালে মেঘেদের এমন কী ক্ষতি হতো! তবে কি ওরা আমাদের বন্ধু ভাবে না? আমরা যারা মেলার আনন্দ নিতে চাই। সোনাই ভাবলো-- একদিন মেঘেদের সঙ্গে নিরিবিলি বসবে কথা বলতে। বলবে, রথের মেলার সময় তোমাদের এভাবে ঝরে পড়া ঠিক নয়। কত মানুষ মেলায় পসরা সাজিয়ে বসে। নানান স্বপ্ন থাকে তাদের। তাদের ক্ষতি করো না। ধরো কেউ ভাবে-- মেলায় বসে যা উপজর্ন করবে, তাদিয়ে বই খাতা কিম্বা টিউশন মাস্টারের বকেয়া মাইনেটা মেটাবে বা ছেলে-মেয়েদের নতুন জামা দেবে।
  ঠাম্মার ডাক-- সোনাই মনে হচ্ছে এ বৃষ্টি বন্ধ হবার নয়।
  --ধৈয্য হারিয়ো না ঠাম্মা। বৃষ্টি বন্ধ না হোক, একটু কমলে আমরা ছাতা মাথায় বের হবো। মা বাবাকে কথা দিয়েছি-- জিলিপি এনে খায়াবো। মনে জোর রাখো ঠাম্মা, আমরা মেলায় যাবোই। শোনো ঠাম্মা, তুমি আমাকে একটা গ্যাস বেলুন কিনে দেবে। সকালবেলায় ছাদে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবো। দেখতে থাকবো যত সময় চোখ নাগাল পায়। কত উপরে উঠে যাবে!হয়তো একটা পাখির ডানায় বাড়ি খাবে! তারপর...। অমিও বড়ো হয়ে আকাশে উড়বো। অনেক মানুষ নিয়ে অনেক দেশে যাবো। খুব ইচ্ছে আমার উড়ান চালাবো। বাবা মাকে বলেছি আমার ইচ্ছেটা। আজ তোমাকে বললাম, আশীর্বাদ করো ঠাম্মা।
  দাদু ভাই, আমার আশীর্বাদ সব সময় তোমার মাথায় আছে। জানি, একদিন তুমি বড়ো মানুষ হবে। শুধু মানুষ নিয়ে এদেশে ওদেশে নয়, দেশ রক্ষার কাজে ব্রতী হবে। যুদ্ধ বিমান চালাবে। আমিতো উপরেই থাকবো, আর দেখবো তোমার ওড়া-উড়ি। আনন্দে বুকটা ভরে তুলবো।

   বৃষ্টিটা ধরেছে। দুটো ছাতা হাতে ঠাম্মা। চলো দাদুভাই এবার বেরোনো যাক।

নিষ্প্রভ হয়ে আছে মেলা। জল-কাদার জন্য তেমন ঘোরাঘুরি হলো না। শুধু নাগরদোলায় চড়া হলো দুজনার। পাপড় কিনে খেলো। বাড়ির জন্য নিলো জিলিপি।
   ঠাম্মা একটা যুদ্ধ বিমান কিনে দিলেন সোনাইকে। দোকানি বললেন-- বিমানটা মাঠে গিয়ে ওড়াতে। কেননা, এবিমান-ড্রাইভ দিতে পারে, বোমা ফেলতে পারে, কাত-চিৎ হয়েও উড়তে পারে।
   ঠাম্মা সোনাই এর হাতে যুদ্ধ বিমানটা তুলে দিয়ে বললো-- তোমার স্বপ্ন খেলনা বিমান দিয়ে শুরু হোক।
   ঠাম্মা ও সোনাই বিমান নিয়ে কথা বলতে বলতে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।

অভিষিক্তা দাস
তৃতীয় শ্রেণি, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন স্কুল,, ব্যারাকপুর

*গ্রাম*
তরুণ লেখিকা রিয়া মন্ডল
একাদশ শ্রেণি
জওহর নবোদয় বিদ্যালয়
পশ্চিম মেদিনীপুর

                                        
 ঐ বাঁকে যায় চলে সাদা-মাটা গ্রাম, 
প্রথমেই জানাই আমি শত কোটি প্রণাম।।   
                                            
 চারিদিকে আছে শুধু ছোট্ট মাটির ঘর, 
আজও রেখেছি আগলে করিনি তাদের পর ।।

হতে পারে গ্রামখানিতে দামী জিনিস অল্প, 
তবু শেষ হবে না যদি লিখতে বসি গল্প।।

 চোখ ফেরালেই দেখবে শুধু। ক্ষেত ভরা সবুজ, 
কালোর ছোঁয়া নেইকো মোটেও মনে-প্রাণে অবুঝ।।

 মধ্যিখানে দেখবে তুমি মা বাসন্তীর চূড়া , 
দর্শন পেলেই মুছে যাবে হৃদয়ের পিড়া ।।

 মাতৃভূমি ছেড়ে যায়নি আজও মাতা গঙ্গা, 
মিল জায়গা জো আপনে দিল সে মাঙ্গা ।।

রুদ্রাংশ দাস
নবম শ্রেণি, সোদপুর চন্দ্রচূড় বিদ্যাপীঠ, উত্তর ২৪ পরগণা
রথযাত্রা 
তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

১) স্নানযাত্রা

ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা জানো নিশ্চয়ই এই যে ইংরেজির মাস গুলো মেনে আমাদের স্কুল কলেজ বড়দের অফিস এইগুলো চললেও আমাদের বারো মাসে তেরো পার্ব্বন হয় যে মাসগুলো অনুযায়ী সেগুলো হল বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক অগ্রহায়ণ বা অঘ্রান মাস পৌষ  মাঘ ফাল্গুন আর চৈত্র মাস।তোমরা হয়তো অনেকেই মাস গুলোর নাম জানো। আবার অনেকে জানো না তাই জন্য আমি আবার এই মাসগুলো নাম তোমাদের মনে করিয়ে দিলাম। কেন বলতো মনে করালাম কারণ  শুধু যে উৎসব পালন করা হয় তাই নয়, স্কুলের ছুটিও পড়ে এই মাসগুলো অনুযায়ী। তোমরা তো সবাই পুজোতে আনন্দ করো পুজোতে ছুটি পাও উৎসবে আনন্দ করতে ছোট বড় সবাইকারই ভালো লাগে এই যেমন এই সামনে আষাঢ় মাসে খুব বড় উৎসব আসছে তোমরা সবাই তো তার নাম জানো খুব আনন্দ করো কি বলতো এই উৎসবের নাম? রথযাত্রা। কেউ কেউ রথে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা সাজিয়ে রাস্তায় বের হতো আবার কেউ কেউ রথ দেখতে যাও। খুব বড় রথের উৎসব কোথায় হয় বলোতো? পুরীতে। উড়িষ্যা আমাদের পাশের রাজ্য। সেই রাজ্যের পুরীতে খুব বড় করে রথযাত্রা পালন করা হয়। উড়িষ্যার রথযাত্রা  উৎসব পৃথিবী বিখ্যাত। যেমন আমাদের এখানকার দুর্গা পুজো পৃথিবী বিখ্যাত ঠিক তেমনি। তোমরা হয়তো অনেকেই বড়দের সাথে পুরি বেড়াতে গেছো। সেখানে জগন্নাথও দেখেছো হয়তো রথও দেখেছো। তবে আজকে আমি তোমাদের রথ যাত্রার গল্প বলবো না সেটা বলব অন্যদিন। আজ বলবো এটা তো এখন জৈষ্ঠ্য মাস চলছে। গত বৈশাখ মাসের পূর্ণিমায় ছিল বুদ্ধপূর্ণিমা। তোমাদের বলেছিলাম সিদ্ধার্থ আর দেবদত্তের গল্প।
 আজ বলবো স্নানযাত্রার গল্প।

 জ্যৈষ্ঠ  মাসের পূর্ণিমায় জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা হয়। সেটিও পুরীর খুব বিখ্যাত তাই আজ তোমরা শুনবে স্নানযাত্রার গল্প। 

তোমরা যারা পুরীতে গেছো তারা নিশ্চয়ই জগন্নাথ মন্দির দেখেছো আর যারা যাওনি তারা গেলে দেখবে বড় দন্ড গ্রান্ড এভিনিউতে প্রায় সাড়ে 10 জমির ওপর জগন্নাথ দেবের বিরাট মন্দির সমস্ত রকম বৈভব নিয়ে উপস্থিত মন্দিরের ভেতরে আর বাইরে দুটি প্রাচীর। দুটি প্রাচীরের ভেতরে ও বাইরে চারটি করে প্রকাণ্ড দরজা।বাইরের প্রাচীরের নাম মেঘনাথ প্রাচীর। তবে এই মেঘনা প্রাচীরের উচ্চতা সর্বত্র সমান নয় প্রাচীরের উপর অর্ধ ডিম্বাকৃতি অজস্র পাথর খন্ড দিয়ে পুরোটাই ঘেরা তার মাঝে  সিংহের মূর্তি। পশুরাজ সিংহই শ্রী জগন্নাথ মন্দির কে পাহারা দেয়। লক্ষ্মী পুরাণে উল্লেখ আছে সমুদ্রের গর্জন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয়। এই প্রাচীর ভেদ করে সমুদ্রের শব্দ  মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে না । ছোটবেলা থেকে বহুবার পুরীর মন্দিরে গিয়ে  সেখানে পান্ডারা মন্দিরটি দেখাতে দেখাতে বিভিন্ন ছোট ছোট গল্প বলেছে শুনেছি। যেমন পুরীর মন্দিরে দাঁড়িয়ে কিন্তু সত্যি সত্যিই সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় না। এই মেঘনার প্রাচীর টি তৈরির নিশ্চয়ই কোন বৈজ্ঞানিক  ব্যাখ্যা থাকবে যে সেটি ভেদ করে সমুদ্রের গর্জন মন্দিরে আসতে পারে না কিন্তু পান্ডারা বলেছিল একটি বড় হনুমান মূর্তি এটিকে বলা হয় কান পাতা হনুমান। সমুদ্রের গর্জন শুনে ভয় পেয়ে দুই ভাইয়ের মাঝখানে ঢুকে পড়েন এবং তখন হনুমান কে জগন্নাথ নির্দেশ দেন যে সে যেন সমুদ্রের গর্জন কে পুরী মন্দিরে ঢুকতে না দেন কারণ তার বোন ভয় পাচ্ছে। এবং হনুমান কান পেতে সেই সমুদ্রের গর্জন কে আটকেছেন। জৈষ্ঠ্য মাসের পূর্ণিমা থেকে ভগবান জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব কাল ধরা হয় স্নানযাত্রার আগের দিন। পুরীর মন্দিরের ভেতরে নির্দিষ্ট জায়গায় বিশেষভাবে স্নানের বেদী  তৈরি করা হয়। একে বলা হয় স্নান মন্ডপ। 
এই মন্ডপের উচ্চতা এতটাই বড় হয় যে মন্দিরের বাইরে থেকে বিগ্রহ গুলির স্নান করানো দেখতে পাওয়া যায়। স্কন্ধ পুরাণ অনুযায়ী ইন্দ্রধনু দেব একটি কাঠের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এরপর থেকেই স্নান যাত্রা অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। অনুষ্ঠানের দিন সকালবেলা বাগান ঘাট এই সমস্ত দিয়ে স্নান যাত্রা যায়, আশেপাশে তরুণ এবং পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। খুব সুন্দর সাজানো হয়। তারপর জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা কে মন্দির থেকে  এনে এই বিদ্রোহগুলোকে স্নান মন্ডপের উপরে বসানো হয়। তারপর বিগ্রহের সামনে ধুপ ধুনো ফলমূল ইত্যাদি দিয়ে পুজো করা হয় তারপর বিদ্রোহগুলো কে স্নান করানোর জন্য পুরীর মন্দিরের ভেতর একটি কু আছে সেই পোয়া টির নাম সোনা কুয়াথেকে ১০৮ ঘড়া জল নিয়ে আসা হয়।  জল আনার সময় যারা জল আনেন তাদের ভালো করে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন যাতে তাদের নিঃশ্বাস এমনকি মুখ থেকেকোন দূষিত  পদার্থ না পড়তে পারে স্নানের আগে সুভদ্রার বিগ্রহকে সিল্কের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের গায়ে এক রকমের গুঁড়ো মাখিয়ে দেওয়া হয় এরপর ওই 108 টা সোনার পাত্রে যে জল রাখা আছে গঙ্গাজল কাঁচা দুধ আতর চন্দন এই সমস্ত মেশানো হয় তারপর সেগুলো তাদের মাথায় ঢালা হয় আর ডাক্তার সাথে সাথে চলতে থাকে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ কীর্তন নানীর পর 108 টা তুলসী পাতা জগন্নাথ দেবের চরণে দেওয়া হয় এই স্নানের পর আমাদের আর বলরাম কে বা হাতির বেশে সাজানো হয়। পদ্মবেশে সুসজ্জিত করে তোলা হয় জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার পর। এরও একটি বিশেষ গল্প আছে।  সেই গল্পও তোমাদের বলবো। এরপর তিন মূর্তির সামনে বিভিন্ন রকমের ফল মিষ্টি এইসব নিবেদন করা হয়। স্নানযাত্রার পর কিন্তু জগন্নাথ দেবের জ্বর হয়। ভগবানের জ্বর হয়  তাই তিনি কাউকে দর্শন দেন না। তারপর রথে করে ভক্তদের নিয়ে মাসির বাড়ি তারা তিনজনে বেড়াতে যান। 
বাকি গল্প পরের পর্বে।

আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 



Post a Comment

0 Comments