কলসি ও মহিলা
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৯
বিজন সাহা
আস্ত্রাখানের ভোলগা তীরে
ক্রেমলিন থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম ভোলগা তীরে। পথে পড়ল লেনিনের স্ট্যাচু। এতে অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই। এদেশের প্রতিটি শহরের এক বা একাধিক লেনিনের স্ট্যাচু আছে। কিছুটা দূরেই এক মহিলার ভাস্কর্য – কলসী কাঁখে শুয়ে আছেন। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চললাম ভোলগার দিকে। রাস্তার দুই দিকে পুরানো দালানকোঠা, মনে হয় বিপ্লবের আগের তৈরি। গ্রীষ্মে মানে কিছু দিন আগেও এখানে যে ট্যুরিস্টদের ভিড় ছিল সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আসলে আস্ত্রাখানে ভোলগা বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে কাস্পিয়ান সাগরে পড়েছে। একটা শাখার অন্য পাড়ে দেখলাম পদ্ম ফুটে আছে, যদিও সেটা ঠিক তেমন নয় যেমনটা শুনেছি গল্পে। কয়েক বছর আগে আমার স্ত্রী গুলিয়া মেয়ে ক্রিস্টিনা আর ছেলে সেভাকে নিয়ে এখানে এসেছিল পদ্মপুকুর দেখতে। সেটা ঘটে গ্রীষ্মের শুরুতে। পদ্মে পদ্মে ঢেকে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। দেখতে মনে হয় যেন পদ্মপুকুর, মানে বিস্তীর্ণ এলাকা পদ্ম ফুলে ঢাকা যেমনটা আমাদের দেশে শাপলা ফুটে থাকে মাঠের পর মাঠ। এখানে তেমন কিছু দেখলাম না, মাত্র কয়েকটি পদ্ম ফুটে আছে। এখন যেহেতু পদ্মের মৌসুম নয়, তাই খুব বেশি কিছু দেখার আশা ছেড়ে দিলাম, যদিও শহর থেকে বেশ দূরে যেখানে কাস্পিয়ান সাগরে ভোলগা মিলেছে সেখানে ভিন্ন চিত্র দেখা যেতেই পারে। সেখানে দেখা পেলাম এক মহিলার যিনি কুকুর নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন ভোলগা তীরে। না না, আসলে এটা আরেকটা স্ট্যাচু। আন্তন চেখভের বিখ্যাত গল্প দামা স সাবাচকোই-এর অনুকরণে। সেই ঘটনা ঘটেছিল ইয়ালটায়, কৃষ্ণ সাগরের তীরে। তাই চেনা ভাস্কর্য দেখেও প্রথমে একটু সন্দেহ ছিল। তবে সেখানে নামফলক দেখে নিঃসন্দেহ হলাম। সেখানে বেশ কিছু ছবি তুলে গেলাম দুপুরের খাবার খেতে।
প্রথম পিওতরের স্ট্যাচু
সেদিন তুষার একটা রেস্টুরেন্টে আমাদের ট্রিট দিল। স্থানীয় কিনা জানি না, তবে দেখে মনে হল উজবেক কিচেন। অনেকটা আমাদের দেশের মত খাবার। গল্পে গল্পে কেটে গেল কয়েক ঘন্টা। রেস্টুরেন্টের পাশেই পুরানো এক বিল্ডিং। বেশ সুন্দর দেখতে। তুষার বলল এখানে বিবাহ সম্পন্ন হয়। মনে মনে ভাবলাম বিয়ে করার জন্য আদর্শ জায়গা। আবার হাঁটার পালা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম প্রথম পিতরের মনুমেন্টের কাছে। এখন এখানে অনেক নতুন নতুন আবাসিক বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। তবে সেসব এই মনুমেন্টের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নির্মিত হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৭১৭ সালের ২২ নভেম্বর প্রথম পিওতরের নির্দেশক্রমেই আস্ত্রাখান কাউন্টি গঠন করা হয়। আমরা যখন ওখানে ঘুরাফেরা করছি তখন এক স্পোর্টিং কার এসে থামল। তুষার পরিচয় করিয়ে দিল ওর ছেলের সাথে। কিছুক্ষণ পরে এলো তুষারের বুলেট প্রুফ মারসিডেজ। আমরা ধীরে ধীরে চললাম তুষারের অফিসের দিকে। আমি তুষারের সাথে ওর গাড়িতে, দেমিদ আর দিলীপ আমাদের পিছু পিছু। ঠিক হল আমরা আর তুষারের অফিসে যাব না। আগামীকাল সকালে দেখা করব। ও আমাদের নিয়ে যাবে শহরের বাইরে ফিসারি ফার্মে। এখন আমরা নিজেরাই ঘুরে বেড়াবো শহরের বিভিন্ন এলাকায়।
আস্ত্রাখান নামের সাথে খান শব্দটি জড়িত থাকায় সব সময়ই এই নামের উৎপত্তি নিয়ে কৌতুহল ছিল। এ নিয়ে অনেক লিজেন্ড ও জনশ্রুতি চালু আছে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের আলেক্সান্দ্রিয়ার ক্লাউডিয়া টলেমির লেখা থেকে জানা যায় কুবান নদীর পাশে বিস্তীর্ণ স্তেপ ভূমিতে আস্তুরোখানি নামক এক জনগোষ্ঠী বাস করত। ভাসিলিয়েভার মতে আজকের আস্ত্রাখান সেই জাতির নাম বহন করছে। সাহিত্যে এই এথনোস আজতুরাকানি বা আজকুরাকানি নামেও পরিচিত। এই মতবাদ সত্য হলে আস্ত্রাখানের বয়স দুই হাজার বছর। এছাড়াও বিভিন্ন লিপিতে এই শহর বিভিন্ন নামে উল্লেখিত আছে যেমন আজস্তোরোকান, আজতারাকান, আজতরোকান, আজতরোখান, আস্তোরোকান, আস্তোরোখান, আস্ত্রখান, হাজতরকান। এছাড়াও ইভান গ্রজনির আমলেও বিভিন্ন লিজেন্ড প্রচলিত ছিল যার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই ভূমিতে রুশদের দাবি প্রতিষ্ঠা করা। তাতার-মিশারদের ছিল নিজস্ব লোককথা। সেই অনুযায়ী তাদের রাজার নাম ছিল সারাই-খান। সারাই-খানের দুই ছেলে আস্তের-খান ও কাসিম-খান। এদের নাম থেকেই সারাই, আস্ত্রাখান ও কাসিমভ – এই শহরগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। তবে আস্ত্রাখানবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে প্রাচীন কালে এই এলাকার শাসক আস্ত্র ও তার মেয়ে আস্ত্রার গল্প যাদের স্মরণে এই শহরের নাম হয়েছে আস্ত্রাখান। এছাড়াও অনেকের মতে এই শহরের নামের সাথে জড়িত সাথে আস নামক এক জাতি যারা মধ্য যুগে এখানে বসবাস করত। তবে ঐতিহাসিক ভাবে আস আর আলান একই জাতি আর তাদের নামের সাথে জড়িত ককেসাসের উত্তর অসেতিয়া বা আলানিয়ার নাম।
এখানে অনেক দর্শনীয় স্থান থাকলেও আমাদের বিশেষ করে দিলীপের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয় বানিজ্য কেন্দ্র। তুষারকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পরেও ঠিক কিছুই বলতে পারল না। আমরা গুগলের সাহায্যে অবশ্য শেষ পর্যন্ত জায়গাটি খুঁজে পেতে সমর্থ হই। এখন বলতে গেলে পরিত্যাক্ত প্রায় এক বাড়ি। সেখানে অবশ্য এখনও নামফলক ঝুলছে যাতে লেখা আছে – আরকিটেকচারাল মেমোরিয়াল, ভারতীয় বানিজ্য আঙ্গিনা, উনবিংশ শতকের শুরুর দিক, রাষ্ট্র দ্বারা সংরক্ষিত। যদিও কারা এই বনিকেরা, কখন, কীভাবে এসেছিলেন এসব কিছুই জানা ছিল না, কিন্তু এই সুদূর প্রবাসে নিজেদের দেশের এই স্মৃতিটুকু দেখে গর্বে মনটা ভরে উঠেছিল। পরে অবশ্য জেনেছি যে ভারতীয় বানিজ্য আঙ্গিনা বা ইন্ডিয়ান ট্রেডিং কমপাউন্ড সপ্তদশ শতকের একটি ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যের নিদর্শন বা স্মৃতিস্তম্ভ। ভলাদার স্ট্রীট ১৪, আস্ত্রাখান এই ঠিকানায় অবস্থিত এই দোতলা বসত বাড়ি এখনও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে এর বর্তমান অবস্থার সাথে আদি স্থাপনার কোন মিল নেই বললেই চলে। এর কারণ সেই পুরানো বাড়ির বিভিন্ন রকম এক্সটেনশন যা আদি বাড়ির রূপ সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছে। ইন্ডিয়ান ট্রেডিং কমপাউন্ডের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬২৫ সালের ক্লিউচারেভ দিনলিপিতে – «১৬২৫ সালে পারস্য, আর্মেনিয়া ও ভারতের লোকজন স্পাস্কি মনাস্তিরের অদূরে এশিয়ান স্টাইলে পাথর দিয়ে অতিথিশালা তৈরি করে।» ১৬৭১ – ১৬৭২ সালের স্তেপান রাজিনের অভ্যুত্থানের সময় ইন্ডিয়ান ট্রেডিং কমপাউন্ড পুড়িয়ে দেয়া হলে ১৬৭৩ সালে সেটা পুনর্নির্মিত হয়। এরপর ১৮০৯ সালে বিল্ডিংটি ক্লাসিস্ট শৈলীতে পুনর্নির্মাণ করা হয়। কিন্তু উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয়রা আস্ত্রাখানে তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
কুকুর সঙ্গী মহিলা
যেহেতু আস্ত্রাখানে ভোলগা অনেকগুলো শাখা বিস্তার করে শহরময় ছড়িয়ে আছে তাই শহরে রয়েছে অসংখ্য সেতু। আছে বিভিন্ন উপাসনালয় – যেমন ভ্লাদিমির, নিকোল, কাজান সাবর, শ্বেত, কৃষ্ণ, লোহিত মসজিদ, রোমান ক্যাথলিক চার্চ ইত্যাদি। আছে বিভিন্ন মিউজিয়াম, থিয়েটার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কয়েক বছর আগে গুলিয়া যখন এখানে বেড়াতে এসেছিল, মস্কো ফিরে এখানকার রাস্তাঘাট সম্পর্কে বেশ উষ্মা প্রকাশ করেছিল। হয় আমি সেসব রাস্তা দেখিনি অথবা ইতিমধ্যে সেগুলো ঠিক করে ফেলেছে – এক কথায় শহরের রাস্তাঘাট মোটেই খারাপ মনে হল না।
বিকেলের দিকে ঘুরতে ঘুরতে গেলাম স্থানীয় এক বাজারে। সেটা অবশ্য আমাদের বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়। উদ্দেশ্য মাছ দেখা। কত রকমের যে মাছ বলার মত নয়। দামও মস্কোর তুলনায় অনেক কম। গুলিয়া বলেছিল এখান থেকে তরমুজ আর মাছ নিয়ে যেতে। যদিও বিক্রেতারা বলল, ওরা ভালো ভাবে প্যাকেট করে দেবে, তবে যেহেতু আমাদের গাড়িতে ফ্রিজ নেই তাই দেমিদ বলল আরও বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আমরা যখন মস্কো গিয়ে পৌঁছুবো ততদিন পর্যন্ত মাছ টিকবে না। তাই মাছ কেনার আইডিয়া বাদই দিতে হল।
আস্ত্রাখানে ১৯ শতকের ভারত
https://www.youtube.com/watch?v=Y9JH98nEKds&t=138s
আস্ত্রাখানের ভোলগা
https://www.youtube.com/watch?v=XIbUE8M8Syg&t=8s
ছবিতে আস্ত্রাখান
http://bijansaha.ru/album.php?tag=264
আরও পড়ুন
0 Comments