ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় : কাশ্মীরের শাসক (৭২৪-৭৬০)’
রাজীব শ্রাবণ
সে রাজার রাজত্বকাল ছিল ৭২৪-৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ। কাশ্মীরে অবস্থিত সে রাজ্য।সেই হারিয়ে যাওয়া রাজকাহিনীর কথাই আজ শুনব। সেই কাহিনির সবথেকে নির্ভরযোগ্য সূত্র হল কলহণের কাশ্মীর সম্পর্কিত ঐতিহাসিকের গ্রন্থ থেকে। সে গ্রন্থের নাম রাজতরঙ্গিণী। সে গ্রন্থে খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত কাশ্মীরের ইতিহাস পাওয়া যায়।সেই গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন যে, গোনানডা রাজবংশের পতনের কথা। তেমনি পাওয়া যায় খৃষ্টীয় সপ্তম শতকের গোড়ারদিকে দুর্লভবর্ধন কারাকোটা বা নাগ বংশের প্রতিষ্ঠার কথা । এই দুর্লভবর্ধনের রাজত্বকালেই চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ্ কাশ্মীর পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, তখন কাশ্মীরের পার্শ্ববর্তী পাঁচটি রাজ্য ঐ দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সেই পাঁচটি রাজ্য ছিল — তক্ষশীলা, সিংহপুর, উরসা, পুঞ্চ ও রাজপুরা। তবে ঐতিহাসিকদের মতে দুর্লভবর্ধন শুধুমাত্র কাশ্মীর নয়, পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের ওপরেও নিজের প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এই কারাকোটা বংশেরই শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়। তাঁর সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি তাঁর সারাজীবন ধরে রাজ্যের সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সর্বদা সামরিক অভিযান নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, এবং যুদ্ধবিগ্রহ করেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল।
নিজের রাজত্বের গোড়ারদিকে ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় কনৌজের শাসক যশোবর্মনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে তিব্বতের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে সাফল্য লাভ করেছিলেন। ৭৩৩ খৃষ্টাব্দে তিনি চিনের সম্রাটের কাছে নিজের দূত পাঠিয়ে তিব্বতের বিরুদ্ধে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। চিনের সম্রাট তাঁর সেই কূটনৈতিক মিশনকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং কাশ্মীরের রাজাকে তাঁর বন্ধু বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তবে চিনের সম্রাট মুক্তাপীড়কে কোনো ধরণের সামরিক সাহায্য করেননি। কিন্তু চিনের সাহায্য না পেলেও মুক্তাপীড় তাঁর সামরিক অভিযান থেকে বিরত হননি। তিনি তিব্বতকে পরাজিত করে তাঁর রাজ্যের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের উপজাতিদের দমন করেছিলেন। সেইসব উপজাতির নাম ছিল — দর্দ, কম্বোজ ও তুর্কি। এরপরে কনৌজের রাজা যশোবর্মনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ দেখা দিয়েছিল, তখন তিনি কনৌজের রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে শুধু কনৌজের অধীশ্বর হয়ে বসেননি, ঐ রাজ্যটির সার্বভৌম প্রভুও হয়ে বসেছিলেন। এইসব যুদ্ধে জয়লাভ করবার পরে ললিতাদিত্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছিলেন এবং দ্বিগ্বিজয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। কলহণ তাঁর গ্রন্থে ললিতাদিত্যের দ্বিগ্বিজয়ের বিস্তৃত বিবরণ রেখে গিয়েছেন।
🍂
যশোবর্মনকে পরাজিত করবার পরে তিনি পূর্বদিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং কলিঙ্গে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। তখন গৌড়ের রাজা তাঁর আগমন বার্তা পেয়ে বিনাযুদ্ধে তাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন এবং তাঁর কাছে উপঢৌকন হিসেবে যুদ্ধহস্তী পাঠিয়েছিলেন।
এরপরে কর্নাটের মধ্য দিয়ে তিনি দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। কর্নাটের রানী রট্ট তাঁর কাছে নতিস্বীকার করে তাঁকে কোনো বাধা দেননি। ফলে মুক্তাপীড় বিনাবাধায় কাবেরি পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং আশপাশের কয়েকটি দ্বীপ জয় করে নিয়েছিলেন। তারপরে পশ্চিমদিকে অভিযান চালিয়ে তিনি কোঙ্কন অঞ্চল জয় করে দ্বারকায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ফলে অবন্তী ও অন্যান্য রাজ্য তাঁর আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল। এছাড়া তিনি উত্তর-পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চলেও নিজের সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন। উত্তর-পশ্চিমে তিনি কম্বোজ, তুর্কি, তিব্বত, দর্দ ও মাম্মুনি নামক এক রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। কলহণ ললিতাদিত্যের যুদ্ধাভিযানের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাতে— প্রাগ্-জ্যোতিষ, স্ত্রীরাজ্য ও উত্তর কুরুর নামও পাওয়া যায়। কিন্তু কলহনের এই বর্ণনা কতটা ঐতিহাসিক, সেটা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে ললিতাদিত্য সম্ভবতঃ পূর্বদিকে বাংলা পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন, কারণ— তিনি মগধ থেকে একটি বৌদ্ধমূর্তিকে কাশ্মীরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া কলহন তাঁর গ্রন্থের অন্যত্রও বাংলার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তবে ললিতাদিত্য যে সত্যিই দাক্ষিণাত্য বা দক্ষিণ ভারত জয় করেছিলেন, কলহণের বিবরণ ছাড়া সেটার অন্য কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ কিন্তু পাওয়া যায় না। অন্য কোনো ঐতিহাসিক তথ্য না থাকবার ফলে ঐতিহাসিকেরা তাঁর দক্ষিণ ভারত বিজয়ের কাহিনী মেনে নিতে চান না। অন্যদিকে কলহণ তাঁর গ্রন্থে মাম্মুনি নামের যে শাসকের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তিনি সম্ভবতঃ একজন আরবীয় শাসক ছিলেন। আরবরা তখন কাশ্মীরের সীমান্ত অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং কাংড়া দখল করে নিয়েছিলেন। তাই এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে, ললিতাদিত্য তখন সেই আরব আগ্রাসন প্রতিরোধ করবার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর সেই প্রতিরোধের ফলেই আরবরা সেই অঞ্চলে নিজেদের স্থায়ী অধিকার স্থাপন করতে পারেননি। ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন যে, ললিতাদিত্য আরবদের পরাজিত করে পাঞ্জাবে তাঁদের লুটপাট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কাশ্মীরের চারপাশে তখন উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। তাই সম্ভবতঃ কম্বোজ, তুর্ক, দর্দ ও তিব্বতের বিরুদ্ধেও তিনি সাফল্যলাভ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘ক্লাসিক্যাল এজ’ গ্রন্থের ১৩৫ নং পৃষ্ঠায় জানিয়েছিলেন যে, একথা সত্যি যে, কলহণ কাশ্মীরের রাজসভার ঐতিহাসিক ছিলেন। তিনি হয়ত ললিতাদিত্যের বিজয় কাহিনী নিয়ে অতিরঞ্জন করেছিলেন, তবে তিনি ইতিহাসের পদ্ধতি ও আদর্শ সম্পর্কেও খুব সজাগ ছিলেন। সত্যের প্রতি তাঁর অবিচল নিষ্ঠা ছিল, ইতিহাসকে বিকৃত করবার ইচ্ছা তাঁর মধ্যে একেবারেই ছিল না। ললিতাদিত্যের চারশো বছর পরে তিনি তাঁর ইতিহাস গ্রন্থটি লিখেছিলেন। তাই তাঁর লেখার মধ্যে হয়তো কোনো ভ্রান্তি ঢুকে পড়তে পারে, তবে গ্রন্থটিতে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল তথ্য পরিবেশন করেননি। এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় একজন মহান বিজেতা ছিলেন। তাঁর রাজ্যজয়ের ফলে কাশ্মীর তখন একটি বড় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল, এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরে ভারতের অন্য কোন শাসকই সম্ভবতঃ এতবড় অঞ্চল জয় করতে পারেননি। তাঁর আমলেই কাশ্মীরের জনগণের গৌরবলিপ্সা পূর্ণ হয়েছিল, এবং তাঁরা তাঁকে সমগ্র জগতের অধীশ্বর বলে উল্লেখ করেছিলেন ও তাঁর জয়গান করেছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতে ললিতাদিত্য শুধু একজন বিজয়ী বীর ছিলেন না। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের সম্পদ দেশ গঠনের কাজেও ব্যয় করেছিলেন। তিনি অনেকগুলি নগর নির্মাণ করে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা, বিহার, মন্দির ও দেবদেবীর মূর্তি দিয়ে সাজিয়ে তুলেছিলেন। মার্তণ্ড মন্দিরকে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম বলা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক কলহণ এই রাজার ভূয়সী প্রশংসা করলেও, একইসাথে নিজের গ্রন্থে তাঁর চরিত্রের দুটি কলঙ্কের কথাও উল্লেখ করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে একটি হল যে, একবার তিনি মদমত্ত হয়ে প্রবারপুর শহরটি ধ্বংস করবার জন্য তাঁর মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মন্ত্রীরা সেই আদেশ পালন করেননি, এবং সজ্ঞানে ফিরে আসবার পরে তিনি তাতে সন্তোষপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁর জীবনের দ্বিতীয় কলঙ্কটি ছিল যে, তিনি গৌড়ের রাজাকে মিথ্যা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডেকে নিয়ে এসে গুপ্ত ঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করিয়েছিলেন। সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গৌড়ের রাজার অনুচরেরা, যে বিষ্ণু পরিহাস কেশবের নামে ললিতাদিত্য গৌড়ের রাজাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাশ্মীরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই দেবতার মূর্তি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এরপরে পাল্টা আক্রমনে সেইসব বাঙালি বীরেরা নিহত হলেও কলহণ কিন্তু নিজের গ্রন্থে তাঁদের প্রভুভক্তি ও বীরত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। এই দুটি কলঙ্ক ছাড়া ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের জীবনের অন্য কোনো ত্রুটির কথা জানতে পারা যায় না। তাঁর শাসনকালে কারাকোটা রাজবংশ গৌরবের উচ্চশিখর স্পর্শ করেছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেই সেই বংশের পতন ঘটতে শুরু করেছিল, তবে তা সত্ত্বেও আরো একশো বছর ধরে তাঁর বংশ কাশ্মীরে রাজত্ব করতে পেরেছিল।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments