জ্বলদর্চি

দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা /দ্বিতীয় পর্ব /পি.শাশ্বতী

দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা

দ্বিতীয় পর্ব

পি.শাশ্বতী

এবার আসা যাক জগন্নাথের পাশে শুভদ্রা-বলরামের অবস্থানের একটি পৌরাণিক কাহিনির কথায়। সেখানে আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করেন, তারপর তিনি আর বৃন্দাবনে যাননি। কিন্তু একবার রথে করে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে যান বৃন্দাবনবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে। বৃন্দাবনবাসীরা কৃষ্ণকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। তাঁদের দীর্ঘকালীন বিরহ যন্ত্রণা দূর করতে তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে আর ছাড়তেই চাইছিলেন না। কৃষ্ণের সঙ্গে বলরাম ও সুভদ্রাও ছিলেন। বৃন্দাবনবাসীদের এই ভালোবাসাজনিত কাতরতা দেখে তিনজনই নির্বাক হয়ে যান। তখন তাঁদের এক অমূর্ত রূপ ফুটে ওঠে। এই রূপই বর্তমান জগন্নাথদেবের রূপ। শ্রীকৃষ্ণের দ্বাপর যুগে লীলা সম্বরণের পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা তিন রূপের পুনঃউদঘাটন এক আশ্চর্য সংবাদও বটে। 

আমরা জানি, পুরীকে পুরুষত্তোম ক্ষেত্র বলা হয়। কিন্তু কেন? কারণ  পুরুষত্তোম তত্ত্বের প্রথম কথাই হল সাম্য। মানবজগতে ভেদাভেদহীন সাম্যতাই একমাত্র পরম পুরুষের সান্নিধ্য লাভ করার পথ হতে পারে। আর তাই এখানকার রথযাত্রায় কোথাও কোনো ভেদাভেদ থাকে না। ধনী-দরিদ্র, উচু-নিচু, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য সবাই সমবেতভাবে ভগবানের সঙ্গে রাজপথে নেমে পড়েন। কারণ ভগবান সকলের, ভগবান প্রাপ্তি কিংবা ঈশ্বরসেবায় সবার সমান অধিকার। আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে এই শ্রীধাম পুরুষত্তোম ক্ষেত্রে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সবাইকে নিয়ে নামকীর্তন করতে করতে রথযাত্রায় অংশ নিতেন। 

🍂

এছাড়াও প্রভাসখণ্ড থেকে জানা যায় যে, পুরীতে অভুক্ত থেকে বিগ্রহ দর্শন করা যাবে না। আগে প্রসাদ খেতে হবে, পরে দেববিগ্রহ দর্শন। সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনো এই নিয়ম চলে আসছে। পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরা পুরীকে শঙ্খক্ষেত্র বলেও উল্লেখ করেছেন। কারণ মানচিত্রে একে শঙ্খের মতো দেখতে লাগে ।

শাস্ত্রে আছে ‘রথস্থ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’। রথের ওপর খর্বাকৃতি বামন শ্রীশ্রীজগন্নাথকে দর্শন করলে তার পুনর্জন্ম হয় না— এ বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে ভোর হতেই ভক্তরা প্রাণের টানে ছুটে আসেন প্রেমরথের প্রাণের ঠাকুরকে নিয়ে স্নানযাত্রার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ রথের রশি ধরে টানতে। সবথেকে বিস্ময়ের এই যে, রথের দিন যত রৌদ্র করোজ্বল দিনই হোক না কেন রথটানা শুরু করতেই আশ্চর্যভাবে আকাশের ভারাক্রান্ত মুখ ঘন মেঘ হয়ে শ্রীক্ষেত্রের মাটিতে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে নেচেগেয়ে উচ্ছ্বাসের প্লাবনে মতোয়ারা হন সমস্ত ভক্ত। সেই সঙ্গে সমানতালে বাজতে থাকে ঘণ্টাবাদ্যি। একদিকে পুরুষেরা শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসা, ঢাক, ঢোল বাজিয়ে পরিবেশ মুখর করে তোলেন। অন্যদিকে নারীরা উলুধ্বনি ও মঙ্গলধ্বনির মাধ্যমে রথটানায় আনন্দচিত্তে সামিল হন। রথ থেকে রাস্তায় দাঁড়ানো দর্শনার্থীদের দিকে ছুড়ে দেয়া হয় কলা আর ধানের খই।

কঠোপনিষদ বলছে, আত্মা হল রথী, শরীর হল রথ, বুদ্ধি হল সারথি আর মন হল লাগাম। মহাপুরুষেরা মানব শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে দেহরথের অশ্ব হিসাবে দেখে থাকেন। আর বিষয়গুলিকে ইন্দ্রিয় সমূহরূপী অশ্বর বিচরণভূমি এবং দেহ-মন ও ইন্দ্রিয়যুক্ত আত্মাকে ভোক্তা বলেছেন। যে পুরুষের সারথি (বুদ্ধি) অসংযত মনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবিবেকী হয়ে ওঠে, তার ইন্দ্রিয় সমূহ লৌকিক সারথির দুষ্টু অশ্বের মতো আর আপন বশে থাকে না। কিন্তু যার বুদ্ধি বিবেকবান, মন সংযত, যার অন্তঃকরণ সর্বদা পবিত্র, তিনিই সেই পরম ঈশ্বরের পদপ্রাপ্ত হন। এই জগতের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে সে ব্রহ্মলোকের সন্ধান পায়। তাকে আর মরজগতের সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয় না। 

এই রূপকধর্মী ব্যাখ্যার কারণ হল, পরম ব্রহ্ম অভীষ্ট লক্ষ্যের পথ অতি দুর্গম, এর জন্য উপযুক্ত ‘যান’-এর প্রয়োজন। ‘রথ’ সেই যাত্রার একটি প্রকৃষ্ট যান। এ রথের সুযোগ্য চালক বা সারথি প্রয়োজন, তার সঙ্গে প্রয়োজন শক্তিশালী, বশীভূত  ও বিশ্বস্ত অশ্ব এবং সুদৃঢ় লাগাম। শাস্ত্রকাররা রূপক ছলে বলেছেন, অবিদ্যাবশে সংসারী জীবনের এ দেহটাই ‘রথ’ এবং রথের অধিষ্ঠাতা আত্মীয় ‘রথী’। সুতরাং, প্রাণ থাকা পর্যন্ত দেহকে অবহেলা করতে নেই। তাই ঋষিরা বলেছেন, ‘আত্মা নং বিদ্ধি’--- আত্মাকে জানো। রথযাত্রায় এই চরম আধ্যাত্মিক রহস্যকে সূক্ষ্ম রূপে তুলে ধরা হয়েছে। প্রেমিবিগলিত জগন্নাথের দেহটির বর্ণনা গৌড়ীয় দর্শনের আচার্যরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে: ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকালীলায় ষোল হাজার আটজন প্রধান মহিষীকে নিয়ে চরম বিলাস করছেন। কিন্তু প্রায়ই রাতে ‘রাধা’ ‘রাধা’ বলে চিৎকার করে কাঁদতে দেখে একদিন সত্যভামা-সহ অন্যান্য মহিষীরা স্বামীর কান্নার কারণ জানার জন্য মা রোহিনীর কাছে উপস্থিত হলেন এবং জানার প্রত্যাশা নিবেদন করলেন। কৃষ্ণমহিষীদের ব্যাকুলতা দেখে অন্তঃপুরের দরজায় মেয়ে সুভদ্রাকে পাহারা দেবার দায়িত্ব দিয়ে বৃন্দাবনের প্রেমলীলাতত্ত্বের ওপর বলতে শুরু করেন তিনি। এই প্রেক্ষাপটে বলরাম আকর্ষিত হয়ে দরজায় এসে উপস্থিত হন।। সুভদ্রা বললেন, মাতা রোহিনীর নিষেধ রয়েছে ভেতরে যেতে। এরপর কৃষ্ণ এসে হাজির হন সেখানে। বোনের নিষেধে বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে রইলেন দ্বারের বাইরেই। সুভদ্রার ডান দিকে দাদা বলরাম, বামদিকে কৃষ্ণ, ভেসে আসা লীলাকথা শুনতে থাকলেন। এ মধুময় প্রেমতত্ত্বের আলোচনা শ্রবণ করে তিনজনই প্রেমবিগলিত হয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে গেলেন। এই অবস্থায় দেবর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হলে তিন মূর্তির এমন প্রেমবিগলিত স্বরূপ দর্শন করে তিনিও হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “বহুদিন পরে ব্রজলীলার কথা শুনতে পেলাম। আজ বড় আনন্দের দিন। নারদ, এই অবসরে তুমি কিছু বর প্রার্থনা করো।” ভক্তপ্রবর দেবর্ষি নারদ বললেন, “প্রভু, এই প্রেমবিগলিত স্বরূপ যেন জগতবাসী জীবের নয়ন গোচর হয় এই প্রার্থনা।” শ্রীকৃষ্ণ বললেন, দারুব্রহ্মস্বরূপ জগতবাসী অবশ্যই এই রূপ দেখতে পাবে। এবং তোমার ও শিবপার্বতীর ইচ্ছায় আমার অন্য ব্রহ্মরূপও প্রকাশ পাবে। নীলাচল ধামে তিনটি মন্দির হবে। শ্রীকৃষ্ণ রাধাভাবে শ্রীকৃষ্ণের জন্য কেঁদেছেন যেখানে সেই স্থানে হবে গম্ভীরা মন্দির, রাধার বিরহে কৃষ্ণ স্বয়ং যেখানে কেঁদেছেন সেটি হবে জগন্নাথ মন্দির আর রাধা কৃষ্ণ বিরহে কেঁদেছেন যে স্থানে, সেটি হবে গুণ্ডিচা মন্দির। আর সেখানে এদের রথে আরোহণ করে যাত্রা হবে বলেই প্রতিষ্ঠিত হবে রথযাত্রা।

(ক্রমশ)

আরও পড়ুন 

বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments