জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক আশালতা সিংহ /নির্মল বর্মন



বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক আশালতা সিংহ 
    
নির্মল বর্মন

কথাসাহিত্যিক আশালতা সিংহ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন, সাহসী, নির্ভীক ও মননশীলতা কে পাথেয় করে সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন। ফলতঃ আশালতা সিংহের সাহিত্য জীবন আরম্ভ থেকেই  আবালবৃদ্ধবনিতা ও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণীয় হয়েছিল। বস্তুতঃ আশালতা সিংহের সাহিত্য জীবনের প্রারম্ভিক পর্বে ''অমিতার প্রেম'' উপন্যাসে সুপার হিট ও হঠাৎই  ছন্দপতন। আশালতা সিংহ সাহিত্য চর্চার প্রায় দশ বছর পরেই  ''জনসমাজ ও সাহিত্যের জগৎ'' ছেড়ে সন্ন্যাসিনী রূপে আবির্ভূত হন। তা সত্ত্বেও এই অল্প সময়ের মধ্যেই দেশ, ভারতবর্ষ, বিচিত্রা, প্রবাসী ইত্যাদি পত্রিকায় বহু লেখালেখি করেছিলেন। তিনি পরিণত বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেও লেখালেখি ছাড়েন নি এবং সন্ন্যাস গ্ৰহনের পর  নামকরণ হয়েছিল "আশাপুরী"। সন্ন্যাসী আশাপুরী এই সময়  মহাপুরুষদের জীবন সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক বিষয় কেন্দ্রিক  লেখালেখি করে সু যশের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। 

কথাসাহিত্যিক আশালতা সিংহ বিরোচিত উপন্যাসগুলি :- ''অমিতার প্রেম'' (১৯৩৪), ''দুই নারী'' (১৯৩৪), ''বিয়ের পরে'' (১৯৩৫), ''সমর্পণ'' (১৯৩৫), ''আবির্ভাব'' (১৯৩৫), ''শহরের মোহ'' (১৯৩৬), ''কলেজের মেয়ে'' (১৯৩৯), ''একাকী'' (১৯৪০), ''ক্রন্দসী'' (১৯৪০), ''বাস্তব ও কল্পনা'' (১৯৪২) প্রভৃতি। 

ছোটগল্প সংকলনগুলি বেশ কালজয়ী:- ''অভিমান'' (১৯৩৪), ''অন্তর্যামী'' (১৯৩৫), ''মধুচন্দ্রিকা'' (১৯৩৬) ইত্যাদি।

🍂

কথিত আছে "আশাপূর্ণা গুপ্তের মতো আশালতা সিংহও বাঙালির ঘরোয়া একান্নবর্তী পরিবারের চিত্রকার" তা সত্ত্বেও দুই মহিলা কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে লেখালেখির গুনগত মানের ফারাক তো আছেই। এমনকি আশাপূর্ণা দেবীর মতো আশালতা দেবী ততখানি তীক্ষ্ণ,স্থিতধি ও মননশীল শিল্পী হতে পারেন নি। আশাপূর্ণা'র উপন্যাসে "প্রধান গুণ-একটি সূক্ষ্ম, সুকুমার অনুভূতি প্রাধান্য" পাঠককে আকৃষ্ট করে তুলছিলো। তবে আশালতা সিংহ'র উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্বারা  প্রভাবিত। 
সমৃদ্ধশালী ''সমর্পণ''  উপন্যাসের নায়িকা সুরমা দেবী ও নায়ক সনাতন মূলতঃ আধুনিক জীবনাদর্শের অতি  ও আতিশয্যের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। 

আবার সনাতন এর  জীবনধারায় "একান্নবর্তী পরিবারে ঈর্ষা-দ্বন্দ্ব, পরশ্রীকাতরতা" এবং অন্য প্রান্তে আধুনিক জীবনে আধুনিকতার নামে বদ অভ্যাস, উচ্ছৃঙ্খলতা, স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচার, প্রেমের নামে ঐশ্বর্যলিঙ্গা ও অশ্লীলতা- এই উভয় দিকগুলোকে সুরমা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বরং অকল্পনীয় হৃদয় পীড়িত হয়েছে। বস্তুতঃ তাঁর ছোট বেলার জীবনের সুকুমার চিত্তবৃত্তিগুলি বাস্তবজীবনের রূঢ় জটিল আঘাতে খানিকটা আহত হয়েছে। আবার হরলাল সাহেবের অতিরিক্ত আগ্রহ কিম্বা সুপ্রকাশের ঔদাসীন্য ও অনাগ্রহ ঠিক যেন প্রেমিক প্রেমিকার  সুনিবিড় আদর্শের সঙ্গে মেলার সম্ভবনা ছিল না।
কথাসাহিত্যিক আশালতা সিংহ ওরফে সন্ন্যাসী আশাপুরী রচিত গল্পগুলিতেও প্রাচীন ও‌ আধুনিক মূল্যবোধের অবক্ষয় জনিত দ্বন্দ্ব চিত্রিত ।  তেমনি কাহিনির ঠাস বুনুনিতে গল্পরসও জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে। 
উদাহরণস্বরূপ :-
 ''অন্তর্যামী'' গল্প সংকলনের 'রমা' গল্পটি বেশ পরিপাটি। এই ছোট গল্পে ---"সস্নেহ অনুযোগের মাধ্যমে  একটি কিশোরীর মনের উপর থেকে জড়বুদ্ধি ও কুশ্রীতার আবরণ সরে গিয়ে তার মধ্যে সৌন্দর্যবোধ ও আত্মপ্রত্যয় কীভাবে সঞ্চারিত হয়েছে, তার নিপুণ বর্ণনা গল্পটিতে স্থান পেয়েছে"।
সুতরাং আশালতা সিংহ এর  কথাসাহিত্যে পাতায় বিরাজমান‌ ঘরোয়া সুখী গৃহজীবনের প্রতিছবি, পুরনো ও নতুনের কালজয়ী দ্বন্দ্ব, সুরুচি ও সৌজন্যবোধের মন্ডনকলা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের শোভা বর্ধনে সুনিপুণ বর্ণনা। কথাসাহিত্যিক আশালতা সিংহ বাস্তবয়ানের গল্পবয়নে কৃতিত্বও যথেষ্ট  গুনান্বিত হলেও কালের অমোঘে আজ বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক।
আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJune 27, 2024

    খুব ভালো লেখা, আশালতা

    ReplyDelete