জ্বলদর্চি

দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা /তৃতীয় পর্ব /পি.শাশ্বতী

দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা

তৃতীয় পর্ব

পি.শাশ্বতী

রথীহীন রথে যাত্রা হয় না। তেমনি জীবনদেহও রথী শূন্য নয়। আমাদের মানবদেহে আছেন যে রথী। দেহ থেকে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটলে পৃথিবীর ভাষায়  তাঁকেই বলা হয় মৃত্যু। এই সত্য-শুদ্ধ-সত্তা আছে বলেই জীবের দেহরথ চলে। দেহের প্রাণ নামক সত্য সত্তাই জগন্নাথ।

দ্বারকায় অবস্থানকালে বৃন্দাবনের প্রেমকথা শ্রবণ করে শ্রীকৃষ্ণের বাসনা জেগেছিল একবার বৃন্দাবনে যাওয়ার। জগন্নাথ মন্দির থেকে জগন্নাথ বিগ্রহকে রথে চড়িয়ে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার অর্থ জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে যাত্রা।  গুণ্ডিচা মন্দিরে জগন্নাথ বিগ্রহকে সাত দিন রাখার পর আবার শ্রীমন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসার অর্থ আবার দ্বারকায় আসা। এটি ফিরতি রথ বা উল্টোরথ নামে খ্যাত। অন্তরে কৃষ্ণ, বাইরে রাধা— তিনি কলিকালে শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে হলেন চৈতন্য মহাপ্রভু। আর অন্তরে রাধা বাইরে কৃষ্ণ হলেন জগন্নাথদেব। দু-জনের মিলন হল নীলাচলে। ষোড়শ শতাব্দীতে মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস গ্রহণ করে নীলাচলে এলে জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রার উৎসব বৃহত্তর আঙ্গিকে শুরু হয়, যা আজ গোটা বিশ্বে সুবিদিত। 

অনেকে মনে করেন যে, জগন্নাথদেবের মূর্তি বুদ্ধদেবেরই রূপান্তর। আবার অনেকে মনে করেন যে, জগন্নাথদেব কোনো অনার্য জাতির দেবতা। বিবর্তনের ধারায় হিন্দুদেবতা বিষ্ণু এবং সব শেষে জগন্নাথদেব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এর পেছনে যুক্তিও আছে স্কন্দপুরাণের উৎকলখণ্ড এবং পুরষোত্তমখণ্ডে। শবরপতি বিশ্বাসুর ছিলেন নীলগিরি পর্বতের নীলমাধবের পূজারী এবং উপাসক। পরে এই নীলমাধবই এখান থেকে অন্তর্হিত হয়ে দারু নির্মিত জগন্নাথদেবের মূর্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। নীলমাধবের পূজারী শবরপতি বিশ্বাসুর যেহেতু অনার্য জাতির মানুষ ছিলেন তাই জগন্নাথদেবকে অনার্যদের দেবতা হিসেবেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে। 

আবার কেউ কেউ, বৌদ্ধ ত্রিরত্নের মধ্যে সংঘ নারীরূপে বুদ্ধের ও ধর্মের মাঝখানে অবস্থান করায় জগন্নাথদেবের মূর্তিকে ত্রিরত্নের রূপান্তর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর স্বপক্ষে স্বামী অভেদানন্দ লিখিত একটি বইয়ে একটি সূত্রও পাওয়া যায়। 

গত দিন জগন্নাথের রূপের সঙ্গে বুদ্ধের সাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল স্বামী অভেদানন্দর বক্তব্য নিয়ে। জানা যায়, স্বামীজি তিব্বতের লাদাখ অঞ্চল ভ্রমণকালে ‘বৌধখুর্ব’ গ্রামে ত্রিরত্নের যে মূর্তি দেখেছিলেন, সেই মূর্তিগুলোকে তিনি জগন্নাথদেবের মূর্তির প্রতিরূপ বলে গণ্য করেছেন। স্বামীজীর বর্ণনা অনুসারে, “লামাদের একটি ত্রিরত্ন বা ‘পরমেশ্বরা’ রয়েছে। আমাদের দেশের ইট দিয়ে গাঁথা তুলসী মন্দিরের মতো এরা তিনটি ক্ষুদ্র নিরেট মন্দির নির্মাণ করিয়া প্রথমটিতে কালো, দ্বিতীয়টিতে হলদে ও তৃতীয়টিতে সাদা রঙ লাগিয়ে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতীক নির্মাণ করে তাদের পূজারতি করেন। ইঁহারা এইগুলিকে ‘পরমেশ্বরা’ বলেন। ‘পরমেশ্বরা’ শব্দ পরমেশ্বর শব্দের অপভ্রংশ। এইগুলোতে চোখ এঁকে দিলে প্রথম কালোটিকে হস্তপদহীন জগন্নাথ, দ্বিতীয় হলদেটিকে সুভদ্রা ও তৃতীয় সাদাটিকে বলরাম মনে হয়।”

উড়িষ্যার অনেক বৈষ্ণব ভক্তকবিও জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের মূর্তি বা অবতার বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস শ্রীকৃষ্ণই বুদ্ধরূপে জগন্নাথ নামে অধিষ্ঠিত। জগন্নাথ দাসের ‘দারুব্রহ্ম’ ও অচ্যুতানন্দ দাসের ‘শূন্য সংহিতা’য় এই তত্ত্ব স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ঈশ্বর দাস ও অচ্যুতানন্দ জগন্নাথদেব এবং শ্রীচৈতন্যদেবকেও বুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন।

উৎকলখণ্ডের বর্ণনা অনুসারে আবার জগন্নাথদেব শঙ্খ-চক্রধারী, সুতরাং দ্বিভূজ। কিন্তু প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে বিশ্বকর্মা জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরি করার সময় কারও প্রবেশ ছিল নিষেধ, এমনকি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নেরও না। বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরি করার আগেই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অধৈর্য হয়ে বন্ধ দরজা খোলার জন্য মূর্তি অপূর্ণ থেকে যায়। 

‘উৎকলখণ্ড’ এবং ‘দেউল তোলা’ নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে-সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তিকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন।

🍂

জগন্নাথের মূর্তিগুলো হাত-পা বিহীন, বড়বড় চোখের এবং অদ্ভূতদর্শন কেন, এবিষয়ে একটি ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে। বৈষ্ণবীয় দর্শন মতে, জগন্নাথের মূর্তিগুলো হাত-পা বিহীন, বড়বড় চোখের এবং অদ্ভূতদর্শন হওয়ার কারণ হিসাবে অন্য দর্শনের কথাও বলা হয়েছে।

রথযাত্রা সম্পর্কে আরও একটি প্রচলিত ধারণা আছে। এখানে সেই আলোচনাটিও প্রাসঙ্গিক। সেটি হল একসময় দ্বারকায় কৃষ্ণের মহিষীগণ রোহিনী মাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে এত সেবা করার পরও তিনি কখনো শ্রীদাম-সুদাম, কখনো মা যশোদা-নন্দ বা কখনো ব্রজবাসীগণ বলতে বলতে মূর্ছা যান। তার কারণ কী?

তখন মাতা রোহিণী সুভদ্রাকে বললেন, “তুমি একটু দরজার বাইরে থাকো। এ বর্ণনা তুমি সইতে পারবে না।” সুভদ্রাকে বাইরে রেখে মাতা রোহিণী মহিষীদেরকে বলতে লাগলেন কৃষ্ণ বিহনে বৃন্দাবনের তরু-লতা-পশু-পাখি কিভাবে হা-কৃষ্ণ হা-কৃষ্ণ বলে কাঁদছে। কিভাবে মূর্ছা যাচ্ছে নগরবাসীরা। সখাগণ অনাহারে অনিদ্রায় কালাতিপাত করছে। মা যশোদা, পিতা নন্দ প্রতিদিন ছানা-মাখন নিয়ে গোপাল গোপাল বলে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছেন। কৃষ্ণবিহনে ব্রজগোপীগণ প্রাণান্তপ্রায়। 

এদিকে ভগিনী সুভদ্রাদেবীকে একটি ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৃষ্ণ এবং বলরাম তাঁর কাছে এসে দাঁড়ালেন। কক্ষাভ্যন্তর থেকে ভেসে আসা ধ্বনি, রোহিনী মাতার বর্ণিত ব্রজবাসীদের কৃষ্ণ-বিরহ কথা শ্রবণ করতে করতে কৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রা— তিনজনই বিকারগ্রস্ত হতে লাগলেন। তাদের হস্ত-পদ শরীরাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হতে লাগল। চক্ষুদ্বয় বিস্ফারিত হতে লাগল।

এমতাবস্থায় সেখানে নারদ মুনি উপস্থিত হয়ে সেই রূপ দর্শন করলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁরা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলে নারদ মুনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করলেন, “হে ভগবান, আমি আপনার যে রূপ দর্শন করলাম, যে ভক্ত বিরহে আপনি স্বয়ং বিকারগ্রস্ত হয়ে থাকেন, সেই করুণার মূর্তি জগতবাসীর কাছে প্রকাশ করুন। নারদ মুনি প্রার্থনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, দারুবৃক্ষ রূপে তিনি শ্রীক্ষেত্র বা পুরীতে আবির্ভূত হবেন।

(ক্রমশ)

আরও পড়ুন 

বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments