পর্ব ১৫
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
স্বপ্ন দেখবো বলে দুচোখ পেতেছি ...
বাসন মেজে মেজে হাতে পায় হাজা ধরে গেছিল হাজু বুড়ির।ঝিনির জন্মের আগে হাজুবুড়ি নাকি তাদের বাড়িতে ঘরদোর মুছে বাসন মেজে দিত।বয়স হওয়ায় আর সে কাজ করতে পারে না। ছেলে-বৌয়ের মুখ নাড়া দিয়ে ভাত মেখে খায়। যেদিন অশান্তি তুঙ্গে ওঠে হাজুবুড়ি ঝিনিদের বাড়ি আসে। রান্না ভাতের ওপর কেউ এলে রুবিদি মুখ কালো করে।হাজুবুড়ির অবিশ্যি কিছু যায় আসে না।
বাঁকানো কোমর নিয়ে ঝাঁট দেওয়া উঠোন আপন মনে আরও একবার ঝাঁট দিয়ে জল ছড়া দেয়। তারপর কলাপাতা কেটে পিঁড়ি পেতে পেয়ারা তলায় চুপ করে বসে। মা বাড়ি থাকলে হাজুবুড়ির গরম ভাতের সাথে ডাল তরকারি পেট ভরেই জুটে যায়।রুবিদি অবশ্য মুখ বাঁকায়। কিন্তু বাপিকে নিয়ে যাওয়ার পরে হাজুবুড়ি এলে রুবিদি তেমন কিছু আর বলে না।
তাদের বাবাকে ছেড়ে দেবার যে খবর রাঙা মেসো এনেছিল সে খবর বাসি হয়ে গেছে। বাপি ফেরেনি।মার দৌড়োদৌড়িও থামেনি।আবার শুরু হয়েছে মায়ের ইস্কুল -কলকাতা -প্রেসিডেন্সি জেল আর উকিলের বাড়ি ছুটোছুটি।
ঝিনি আদ্দেকদিন ইস্কুলে যায় না। দাদাদের কথা সে শোনেও না। ক্লাস টু তে এর মধ্যে সে বেশ ক'বার মারামারি করেছে।ইসমাইল নামে যে ছেলে কাজল পরে ক্লাসে আসে একদিন হঠাৎ করেই বলল তোর বাবার তো পুলিশ ধরি নে গেছ।সন্দীপ বলল কেন রে? কী করিছ ওর বাবা?তোতোন বলল চোর ডাকাতদের পুলিশ ধরিপ্পর জেলে নে যায়।ভাবার আগেই ঝিনি ঝাঁপ দিল তোতনের ঘাড়ে এবং ভ্যাবাচ্যাকা তিনজন কিছু করে ওঠার আগেই কিল চড় কামড় আঁচড় সবকিছু একধারসে এত দ্রুত সে চালিয়ে দিল যে ডলি তাহমিনা এসে না ছাড়ালে একতরফা আরও খানিকক্ষণ চলত বোধহয়। ফোঁস ফোঁস করে সে শুধু বলছিল আমার বাবা ওরকম না।
হেডস্যারের ঘরে ডাক পড়ল।স্রোতস্বিনীর বাবা একজন রাজনৈতিক বন্দী।পুলিশ যেসব অপরাধীদের ধরে উনি তা নন। তোমরা বড় হলে বুঝতে পারবে এসব। আপাতত জেনে রেখো,যে কোনো মানুষের চেয়ে উনি সম্মানীয়। আর কখনো এসব বলবে না ওনার সম্পর্কে।আর স্রোতস্বিনী তুমি মারপিট করবে না। এটা একেবারেই ঠিক হয়নি।কিছু হলে তুমি আমাকে এসে বলবে কেমন?
তবু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কেমন আলাদা চোখে তাকায়। কি সব বলাবলি করে আর সে কাছে গেলেই চুপ করে যায়।ডলি ,তাহমিনা সঙ্গে থাকে বটে তবু বাদবাকিদের ফিসফাস তার অসহ্য লাগে।টিফিন পিরিয়ডে তাহমিনার সাথে নুন মেখে তেঁতুল খায়। তাহমিনাদের আছে বিরাট দুই তেঁতুল গাছ। সারা বছর খেলিও শেষ করতি পারবিনে সে হাসতে হাসতে বলে।রোজ সে কাগজে করে নুন আর ডেলা ডেলা তেঁতুল নিয়ে ইস্কুলে আসে।
এক একদিন ঝিনি সন্ধের পড়াও করে না। ছোড়দা টানাটানি করলে তার হাত কামড়ে দেয়। সকালবেলা বিছানা ছেড়ে ওঠেই না। দাদারা ডেকেডুকে খেয়েদেয়ে চলে গেলে সে উঠে দাঁত না মেজে আপন মনে বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।
পেয়ারা তলায় হাজুবুড়ি থাকলে তার পাশে উবু হয়ে বসে থাকে। আজকাল আ্যতো ঘনঘন আতিছ ক্যান?রুবিদির কথায় খেঁকিয়ে ওঠে হাজুবুড়ি তোর কী হচছে? আমি কি খেতি চাচ্ছি নাই তোর কাছ?তোর কাজ তুই করগে যা। তারপর প্যায়রা গাছতলায় সরু লাঠিখানা রেখে বিড়বিড় করে জামাই ফিরি এয়িছ কিনা দেখতি আসি। রুবিদি আর কিছু বলে না।একটা শ্বাস ফেলে ঝিনির হাত ধরে ঘরে এনে দাঁত মেজে চান করে নিতে বলে আর নিজের আদ্দেক ভাত বা দুটো আটার রুটি গুড় দিয়ে হাজুবুড়িকে বেড়ে দেয়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ঝিনি দেখে গোঙা গোপাল
ধান কাটা নাড়ার মাঠে একলা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। অনেক উঁচুতে বোঁওওও আওয়াজ করে
ডাকুদার ঘুড়িও উড়ছে। ডাক ঘুড়ির আওয়াজ এমন যেন ঝাঁক বেঁধে চাক ভর্তি বোলতা উড়ে যাচ্ছে ।ডাকুদা আর তার বন্ধুরা বাজে ছেলে। সেদিন মস্ত এক ডাক ঘুড়িতে থলে বেঁধে মাস্টার পাড়ার হুলো,বড় মাথার জন্য যার নাম হাঁড়ি, তাকে তুলে দিয়েছিল ঘুড়ির সাথে। চুরি করে খায় বলে যদিও খুব নামডাক আছে হাঁড়ির তবু ঝিনি ওদের বারবার বলছিল হাঁড়িকে নামিয়ে দাও। উঁচুতে ওর ভয় করছে। দাঁত বার করে হাসছিল ওরা। কালো ছোপ ধরেছে দাঁতে। লুকিয়ে নাকি বিড়ি খায় খোকন ফিস ফাস করে বলছিল,ছেড়ি দে ঝিনি, ওদের সাথ পারবি নে।শেষমেষ দশ মিনিট পর ঘুড়িসমেত হাঁড়িকে নামালে সে আর নড়ছিল না। দৌড়ে নারকেলের মালায় জল এনে হাঁড়ির চোখেমুখে ছিটোলে খানিক পর ধড়মড় করে উঠে সেই যে দৌড় দিল অনেক দিন আর এ পাড়ায় আসেনি। লে লে বলে ডাকুরা বেশ খানিক দূর হাঁড়িকে তাড়া করে ফিরে এলো।
ওর'ম কেন করলে বলো?টেন ক্লাসের ডাকুদাকে বললো ঝিনি। এভাবে কারোকে কষ্ট দেয় খারাপ লোকেরা। পুলিশ যের'ম তোদের বাবার দেচ্ছে? হতবাক তার মুখে কথা বেরোয় না প্রথমে। তুমি খুব খারাপ ছেলে বলে ডাকুদার সামনে থুতু ফেলে সে দৌড়তে শুরু করে। ওর সাথে মণি আর খোকনও ছোটে। কিছু বলিসনে ঝিনি, তার পাশে খোকন ছুটতে ছুটতে বলে ; গায়ে বিরাট জোর ওদের!মারব্যান বলো। ঝিনি দূর থেকে ডাকুদাকে ঢিল মারে,লাথি দেখায় ;গায়ে লাগে না অবিশ্যি। ডাকুদা পাত্তাও দেয় না এসবে। ঘুড়ি গুটিয়ে হাসতে হাসতে বড় ছেলের দলের সঙ্গে বল পেটাতে চলে যায়।
বাপি এলেই ঘুড়ি বানাতে হবে। মস্ত ডাক ঘুড়ি।ডাকুদার ঘুড়ির চাইতেও বড়।সে,খোকন, মণি টেনি সবাই মিলে ওড়াবে।ডাকুদার চাইতে অনেক ওপরে উঠে যাবে সেই ঘুড়ি।ঝিনি দেখে তাদের গোল্লাছুট খেলার মতো যে সব হাওয়া সহজ আকাশ ভেবে ওড়ে।খালধারে আঠা দিয়ে জোড়া টুটাফাটা ঘুড়ি হাতে ঘুড়ি হাতে রোজ গোঙা গোপাল দাঁড়িয়ে থাকে অথচ তার ঘুড়ির তো ডানা নাই।হাওয়া ধরে ধরে গোঙা শুধু লাটাই ঘোরায়।
সেজো জ্যাঠামণির বাড়ি থেকে সেবার দাদা দিদিদের সাথে বাওড়ে দুগ্গা পুজোর ভাসান দেখতে গেলে বুড়িদি তাকে কোলে নিয়ে উঁচু করে ধরেছিল। মাটির প্রতিমার মুখ চিকচিক করছিল জলে। দেখে দুঃখ লাগছিল তার ফাঁকা লাগছিল যেন মা'র সাথে ছোট মাসির ঘর ফেলে আসছে সে।লজঝড় বাস পেরোচ্ছে বান্ধব ভবন,মিলন সংঘের মাঠ। গোঙা গোপালে আর তার ছেঁড়া ফাটা ঘুড়ি দেখলেও ওর'ম লাগে ইদানিং।
ছোড়দা রেশনের গম ভাঙাতে গেলে সেও যায় পিছন পিছন।ভটভট করে হঠাৎই গমের মেশিন চলতে শুরু করলে বুক ধকধক করে ওঠে। ছোড়দা তাকে মেশিন ঘর থেকে বাইরে বার করে কাঠের পোলের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে। খবরদার জলের ধারে যাবি নে কিন্তু। দোকানে লাইনে না দাঁড়ালে গম ভাঙাতে দেরি হয়ে যাবে,অরু কেরোসিন তুলতে গেছে।ও থাকলে তোর সঙ্গে থাকতাম।বলে মিতু ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ায়।
পোলতার খালের জল খেলা দেয় হাওয়ায়। ফুলে ঢোল জড়ি পাড় মূর্তি ভাসিয়ে আনে।আধা গলা শেতলা বা কালী প্রতিমার নিঁখোজ কাঠামো চিৎ হয়ে ভাসে। ঝিনি দেখে গোঙা গোপালের কাটা ঘুড়িও ডুবে যাচ্ছে।সুতোর আলাভোলা রাস্তা খুলে খুলে জলে নেমে যাচ্ছে অবেলার বিকেল।
খাল পাড়ে বসে মুড়ি খেতে খেতে গোপালও দেখে আধডোবা ঘুড়িটা।গো গো করে কীসব বলে ঘুড়ি দেখিয়ে।নালঝোল মাখা মুড়ি ছিটকোয়।
গোঙার বাবা ডিঙিতে জাল গুটিয়ে তুলছে।তোলা উনুন ধরিয়ে গোঙাআআ বলে হাঁক পাড়ে। দিনভর শোরের বাচ্চার শুধু ঘুড়ি আর ঘুড়ি;বেরো আগে শুঙ্খির থে।তোর আজ লৌকোয় উঠতি দিই যদি আমার নামে নিজিই গে কুকুর পোষপান বলে ডিঙি সরিয়ে নেয় জলের মধ্যে।গোঙা গোপালও ছপাৎ করে জলে পড়ে সাঁতরে উঠতে চায় ডিঙিতে। সনঝি বেলা প্যাটের খোঁদল ফাঁকা লাগলি তবে গে মনি পড়িছ লৌকোর কতা কেমন? ডুবি তো মরতি পারতিছ না খালভরা কণেগার! এই পোলতার শ্মশানে তোর মুখি আগুন দে তবে আমি চিতেয় ওঠপো। নৌকোর গলুই ধরা গোপালের হাতে তার বাবা টোল খাওয়া সানকি দিয়ে বাড়ি দেয়।
গো গো করে কঁকিয়ে উঠেও সে ডিঙিতে উঠে যায় গোপাল।জলের ভেতর সন্ধের তারা ঝুঁকে এলে টেমির আলোয় জেলে নৌকোও সামান্য কাত হয়ে পড়ে।যেন হাড়ি ডেক হাতায় টকেওঠা সন্ধে রাত্তির আর গোঙা গোপালের ঘুড়ি একসাথে ডুবে আছে।
ঝিনিইইই !গরম আটার থলে হাতে ডাক দেয় মিতু। ভাইবোন তারার আলোয় বাড়ির দিকে রওনা দেয়। পেছন ফিরে শুধু দেখে গোপালের বাবা বিড়ি খাচ্ছে আর ভেজা প্যান্ট পরেই আটা মাখতে বসে গেছে গোঙা। বাঁ হাতের চেটোয় নাল মুছলেও চোখ দিয়ে জল পড়ছে কিনা বোঝা যায় না অবশ্য।
ইস্কুলে না গেলে, হাজার ডাকাডাকি করেও রুবিদি দুপুরে শোয়াতে পারে না তাকে।কাঠি দিয়ে সে মাটি খোঁচে আমড়াতলায়,ঘাটলায় উপুড় হয়ে পুকুরের জলে হাত দেয়, লিচুতলায় তার খেলনা বাটির ঘর থেকে সামান্য তফাতে পাতাপোতার ওপর বসে থাকে।বাড়ির চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে এক দুপুরে দেওয়ালের হাঁ করা ইটের ফাটলে ঝিনি দেখল রুপোলি আঁশের মতো চকচক করছে কি যেন। ঠিক ইলিশ মাছের মতো বলে আপনমনে ফাটলে আঙুল ঢুকিয়ে সে খোঁচাখুঁচি করেও বার করে আনতে পারল না। মাছটা ফাটলের আরও ভেতরে সেঁধিয়ে গেল।
কিছুদিন পর দেখল ফাটল থেকে লম্বা খোলস ঝুলে ঝুলে বাতাসে দোল খাচ্ছে । দাদামনি বলল বিষ!বিষ!ধরিস নে,সাপের খোলস। দিনকয়েক আগে সে তাহলে মাছ ভেবে আঙুল দিয়ে সাপটাকেই খুঁচিয়ে গেছে?দানি চেঁচামেচি করবে বলে সে আর বলল না। তাছাড়া দেওয়ালের ফাটলে যে মাছ থাকে না, থাকে সাপ এটা ভাবার জন্য ওরা তাকে বোকা ভেবে হাসতেও পারে! সাপ জেনেও তার অবিশ্যি ভয়ও করে না। ইদানিং অন্য কোনো কিছুতেই তার বিশেষ ভয় করে না,ভয় ভাবলেই শুধু ঘুম ঘুম পায়।
ঘুমের ভেতর বাড়ি বদলে যাওয়ার কোনো সমাধান আছে নাকি? হয়তো ঘুম ভাঙলেই এই ঠান্ডা চুপচাপ স্বভাবে পাল্টে যাওয়া বাড়িটা আবার আগের মতোই হয়ে যাবে।তাইই ঝিনির এত ঘুম পায় সব সময়।অথচ শুতে পারে না।সারাদিন সে ছটফট করে কেবল ঘুরপাক খায় বাড়ির চারধারে।
তোমাকে দেখিনি অনেকদিন । ভারী মাথাটা
হালকা লাগে শুধু ঘুমের ভেতর। ঠান্ডা আর
নিঃসঙ্গর ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে তোমাকে। গালাগালি,মারপিট,মিথ্যে কথার ভেতর ঘুরতে ঘুরতে তোমার ফেরার কথা ভাবি।কাবিলপুরের বাঁধ বা ঘোষপাড়া পেরিয়ে ,খালধার হাটখোলা পেরিয়ে বাস গুমটির পোড়া মোবাইল ইদানিং ভরে যায় পানের পিক আর দুঃখী ছেঁড়া কাগজে অথচ নীরবতা আর ভয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়ানোর আগেই কাটা পড়ে তোমার ছায়া। রাত্তিরে ভারী ইটের ঘায় সাপের থ্যাঁতলানো মাথার মতো ঘুম এসে যায়। হারিয়ে যাওয়া বা ভয়ের স্বপ্ন নয় ঘুমের ভেতর ফিরে পাওয়ার ঝলমলে কোনো স্বপ্ন দেখবে বলে সে না জেনেই অবুঝ নিঃসঙ্গ তার চোখদুটি পেতে রাখে ।
0 Comments