জ্বলদর্চি

দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা /শেষ পর্ব/পি.শাশ্বতী

দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা

শেষ পর্ব

পি.শাশ্বতী

এই নিবন্ধের শেষ পর্বে জগন্নাথদেবের মহাভোগ বা প্রসাদ নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। আপনারা যাঁরা পুরীর মন্দির দর্শন করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জগন্নাথ দেবের মন্দিরের পাশে বিমলাদেবী তথা পার্বতীদেবীর মন্দিরও দর্শন করেছেন। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, জগন্নাথ মন্দিরের পাশাপাশি কেন পার্বতীদেবীর মন্দির? বরং প্রশ্ন জাগে এখানে তো লক্ষ্মীদেবীর মন্দির থাকাই উচিত ছিল! আসলে জগন্নাথের পাশে পার্বতীর অধিষ্ঠানের পেছনে রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনি।  হয়তো এই তথ্যও অনেকের অজানা যে, সেখানে জগন্নাথের মহাপ্রসাদ প্রথমে দেবী পার্বতীকে অর্পণ করে সাধারণের জন্য বিতরণ করা হয়।

মুনি প্রবর মহর্ষি নারদ কারণ-অকারণেই বৈকুণ্ঠ যাতায়াত করতেন। নারায়ণের দুয়ারে তাঁর অবাধ যাতায়াত। তিনি সেখানে দেবী লক্ষ্মীর রান্নাঘর থেকে প্রায়শই নানা রান্নার পদের মনকেমন করা সুগন্ধ পেতেন। সেই ঘ্রাণ তিনি আস্বাদন করতেন আর ভাবতেন, এত সুন্দর যার সুবাস, তার স্বাদ হবে নিশ্চয়ই  অতুলনীয়। যদি একবার ভগবান নারায়ণের এই মহাপ্রসাদ চেখে দেখা যেত! 

🍂

ক্রমেই তাঁর মধ্যে এই ইচ্ছে তীব্রতর হতে থাকল। কিন্তু এই ইচ্ছাপূরণ  কিভাবে সম্ভব হবে? দেবী লক্ষ্মী নিজের হাতে ভগবানের জন্য এই রান্না করেন, আর তিনি নিজেই তাঁর পতিকে রান্না করা এই মহাপ্রসাদ অর্পণ করেন।  ভগবানের ভোজনের পর সেই প্রসাদ তিনি নিজে গ্রহণ করেন। 

মহর্ষি নারদ মনে মনে ভেবে দেখলেন, একমাত্র দেবী লক্ষ্মীই তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারেন। তাই তিনি  লক্ষ্মীদেবীর তপস্যা শুরু করলেন। একে একে পেরিয়ে গেল বারোটি বছর।

একসময় লক্ষ্মীদেবী প্রসন্ন হয়ে নারদ মুনিকে দর্শন দিয়ে বললেন, “তোমার তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, বলো কী বর চাও?”

উত্তরে মুনিবর বললেন, “আমি  ভগবান নারায়ণের মহাপ্রসাদ পেতে চাই।”

লক্ষ্মীদেবী বললেন, “ঠিক আছে, তুমি এখানে অপেক্ষা করো,  নারায়ণের ভোজন শেষে তার অবশেষ প্রসাদ তুমি পাবে।”

অবশেষে নারদমুনি সেই প্রসাদ পেলেন। সেই মহান্ন সেবা করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি বীণার ছন্দে ‘নারায়ণ... নারায়ণ’ গীত গাইতে গাইতে পৌঁছে গেলেন কৈলাসের কাছাকাছি। 

দেবাদিদেব মহাদেব দূর থেকে দেখলেন নারদ যেন কীসে আত্মহারা হয়ে সব ভুলে  শুধু  ‘নারায়ণ... নারায়ণ’ বলে চলেছেন। কিন্তু এত আনন্দের কারণ কি? কৌতূহল জাগল মহাদেবের মনে। তিনি নারদ মুনিকে ডেকে পাঠালেন কৈলাসে। নারদ উপস্থিত হলে তিনি এই আনন্দের হেতু জানতে চাইলেন। নারদ মুনি তখন সবিস্তারে সমস্ত ঘটনা বর্ননা করলেন। 

সব কথা শুনে দেবাদিদেব শিবেরও সেই প্রসাদ খেতে ইচ্ছা হল। তিনি বললেন, ,”আমিও এই মহাপ্রসাদ পেতে চাই।”

মহা সমস্যায় পড়ে নারদ মুনি বললেন, “কিন্তু আমি তো সব খেয়ে ফেলেছি। এখন উপায় কি হবে?” তারপর তিনি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, হাতের একপাশে একবিন্দু প্রসাদ লেগে আছে।  মহাদেব সেটি জল দিয়ে ধুয়ে সেবা করলেন। সেই চিন্ময় প্রসাদের এমনই স্বাদ ছিল যে ওইটুকু খেয়েই শিব আনন্দে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করে দিলেন। 

ওদিকে মাতা পার্বতী এই  তাণ্ডবনৃত্যের শব্দ শুনতে পেয়ে প্রমাদ গুনে ভাবলেন, এখন তো পৃথিবীর ধংসের সময় উপস্থিত হয়নি, তবে স্বামী কেন তাণ্ডবনৃত্য শুরু করলেন!

এদিকে মহাদেবের সেই নাচ দেখে ভয়ে নারদ মুনি তড়িঘড়ি কৈলাস ত্যাগ করলেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেবী পার্বতী দেখতে পেলেন তাঁর পতি মহানন্দে একলাই নাচ করে যাচ্ছেন। তিনি পতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আবার কি হল? তুমি এই অসময়ে নাচ শুরু করলে যে?”

মহাদেব তখন নাচ থামিয়ে সমস্ত ঘটনার  বিবরণ দিলেন। সমস্ত ঘটনা  শুনে মাতা পার্বতী বললেন, “আমিও  নারায়ণের প্রসাদ পেতে চাই।”

কিন্তু তখন তো আর কোনা ভাবে সেটা সম্ভব ছিল না। পার্বতী দেবী পতির ওপর অভিমান করলেন যে, তিনি পত্নী হওয়া সত্ত্বেও কেন তার স্বামী নারায়ণের প্রসাদ একা সেবা করেছেন!

এরপর মাতা পার্বতী  নারায়ণের ধ্যান শুরু করলেন। 

দেবী পার্বতীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে   নারায়ণ তাঁকে দর্শন  দিয়ে বললেন, “বলো পার্বতী, তুমি কী চাও?”

তখন মাতা পার্বতী বললেন, “হে  নারায়ণ, আপনি তো সবই জানেন। তবে আমার আরও প্রার্থনা আছে। এই জগতের সবাই আমার সন্তান। হে ভগবান, সন্তানদের রেখে আপনার প্রসাদ শুধু আমি একা পাব তা কখনোই হতে পারে না। তাই আপনার মহাপ্রসাদ যাতে জগতের সবাই পায়, সেই ব্যবস্থাই আপনাকে করতে হবে। 

এই কথার উত্তরে ভগবান বললেন, “কলিকালে আমি যখন জগন্নাথদেব রূপে লীলা করব, তখন আমি সকলের মধ্যে অকাতরে আমার মহাপ্রসাদ বিতরণ করব। তবে সেই প্রসাদ প্রথমে তোমাকে দেওয়া হবে, পরে তা জগতের সবাইকে দেওয়া হবে।” 

পুরীর মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে বিগত কয়েকশো বছর ধরে এই প্রথাই চলে আসছে।

এই প্রসঙ্গেই চলে আসে পুরীর মন্দিরে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের পবিত্র মহাভোগের কথা। পৃথিবীর বৃহত্তম এই পাকশালায় প্রতিদিন ছাপ্পান্ন রকমের নিরামিষ ভোগ রান্না করে নিবেদন করা হয়। কেবলমাত্র পুরুষ ব্রাহ্মণ  বাবুর্চিরাই এই ভোগ রন্ধনের অধিকারী। এঁরা প্রতিদিন ধোয়া সাদা বস্ত্রে চুলদাড়িহীন অবস্থায় ভোগ রান্না করে থাকেন। এই রন্ধন পদ্ধতির ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য। প্রতিদিন নতুন মাটির পাত্রে সব রকমের ব্যঞ্জন রান্না করা হয়। হিন্দু সনাতন ধর্ম অনুযায়ী নতুন লাল রঙের মাটির পাত্র সব সময়েই শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক।

যেহেতু মাটির পাত্র তাপ কুপরিবাহী, তাই মাটির পাত্রে রান্না করা যে-কোনো খাবার সঠিক পদ্ধতিতে ঢাকা দিয়ে রাখলে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত গরম থাকে। 

পুরীর ভোগ রান্নার আরও একটি বৈশিষ্ট হল যত রকমের ভোগ রান্না হয়, ঠিক সেই সংখ্যার হাঁড়ি এক সঙ্গে একাধিক কাঠের জ্বালের উনুনের উপর একটার উপর একটা করে সাজিয়ে দেওয়া হয়। সব থেকে উপরের হাঁড়িটিই সবার আগে সুসিদ্ধ হয়। এইভাবেই ওপর থেকে পর পর একটা একটা করে রন্ধন সমাধা হয়। 

জগন্নাথদেবের এই মহাভোগে নিবেদন করা হয় বিভিন্ন রকমের ভাত, বিভিন্ন তরকারি, ডাল, চাটনি। এছাড়া গজা ও অন্যান্য মিষ্টান্ন দ্রব্য তো থাকেই। 

(সমাপ্ত)

Post a Comment

0 Comments