বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩০
বেনাঘাস
ভাস্করব্রত পতি
"ভ'য়েসকী সাম্না মে বীন্ বজানা"। অর্থাৎ এ যেন মহিষের সামনে বীণা বাজানো। এটাই বাংলায় প্রবাদে বলে থাকি "বেনা বনে মুক্তা ছড়ানো" (উলুবনে মুক্তো ছড়ানো)। অর্থাৎ যে কাজের কোনও ফল মেলে না। এই বেনাঘাস গ্রামবাংলার এক অতি পরিচিত গাছ। 'কারাম উৎসবের অন্তরালগদ্য'তে সালেক খোকন লিখেছেন -- 'হঠাৎ সে দেখল তার কাছে চলে এসেছে একটি গাই গরু। গাইটিকে সঙ্গে নিয়ে, ডুংরীর বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশি নামিয়ে, বেনাঘাসের ওপর থেকে পাওয়া কাপড় দিয়ে মাথায় পাগড়ি বেঁধে, সে ফিরল বাড়িতে'।
বেনাকে সংস্কৃতে বলে 'উষির'। যার প্রকৃত অর্থ 'প্রেরণা ও সম্প্রসারণ'। অথর্ববেদের বৈদ্যককল্পের ২৫। ১১২। ২৭ সুক্তে রয়েছে --
"ইয়ত্তি ধূমং অরুষং ভরিভ্রদ শুক্রেণ শোচিষা।
রাস্তায় ঝুঁকে বেনাঘাস
বৈদিক তথ্যানুযায়ী এটি আর্যদের গ্রাহ্য ও গবেষিত ভেষজ। ধোঁয়াকে অপসারণ ক'রতে যেমন বায়ুর প্রয়োজন হয়, তেমনি অন্তঃস্থ মালিন্যকে দূর ক'রে নির্মল শুক্রের দীপ্তি আনতে উশীরের প্রয়োজন। দূষিত পিত্তের সংক্রমণ হ'লেই বমনের উদ্রেক ঘটে। তখন এই উশীরের প্রয়োজন।
এছাড়া একে হিন্দিতে খস, মারাঠিতে বালা, কন্নড়ে বালদেবেরু, তামিলে ভোট্টভার, তেলুগুতে বট্টিবেল্ল, মালয়লামে ভোট্টভার এবং বাংলায় খশখশ। সংহিতার যুগের একটি নাম 'বীরণ'-এর অর্থ বিশেষরূপে ঈরণ। অর্থাৎ প্রেরণা বা ঠেলা দেওয়া। এর লোকায়তিক নাম হল 'খসখস'। এই নামটি আসলে ফারসী শব্দ। এই গাছটি একটু কাঁকরপ্রধান বা বালুকাপ্রধান জমিতেই বেশি জন্মায়। এই খসখস নামটি এসেছে স্থানবাচক হ'য়ে। অর্থাৎ খশ / খস নামে যে দেশ - যার বর্তমান নাম গাড়োয়াল, তারই উত্তর প্রান্তের পার্বত্য ভূমিটির নাম খস। হয়তো তা থেকেই এসেছে 'খাসিয়া' নামটি। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে এই গাছটি ছিল বলেই তার নামকরণ হয়েছে 'খস'। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম andropogon squarrosus lin। এটি পোয়েসি পরিবারের অন্তর্গত।
রাস্তার দুপাশে বেনাঘাসের বন
এদের কান্ড ২-৩ ফুট পর্যন্ত হয়। শেকড়গুলো দেখতে হাঁসের পালকের মত। পাতাগুলো ২-৩ ফুট সরু এবং অগ্রভাগ বেশ লম্বা। এদের শেকড় গ্রীষ্মকালে দরজায় ঝুলিয়ে রেখে তাতে জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে গোটা ঘর শীতল হয়ে যায়। এই রীতি আগে প্রচলিত ছিল। তখন এয়ারকণ্ডিশন মেশিন আবিষ্কৃত হয়নি। সেসময় জানালা দরজায় এই খসখস টাঙানো থাকতো ঘর ঠাণ্ডা রাখার জন্য। বর্ষাকালেই এদের ফুল ও ফল হয়। নদীর পাড়ে এবং নীচু স্থানে প্রচুর জন্মায়। জমির আল বা সীমানা নির্ধারণ করার জন্য জমির মালিকরা আলপথে বেনেঘাস লাগায়। মেদিনীপুরের কবি খুকু ভুঁইয়ার 'এক মুঠো ঘাসের কাছে থাকতে দাও' কবিতায় আলপথে জন্মানো বেনাঘাসের খোঁজ মেলে --
"আলের গায়ে যে বেনাঘাস, যাকে তুমি ব্যবহার করেছ অবৈধ মিলনের মতো অনাদরে অবজ্ঞায় তার কাছে বোসো
জিজ্ঞেস করো সে কেমন আছে!"
এই বেনাবন চন্দ্রবোড়া, কালচিতি এবং গোখরোদের সবচেয়ে প্রিয় বাসস্থান। তেমনি মুনিয়া সহ অন্যান্য অনেক পাখির নিরাপদ বাসস্থান বেনাঘাসের বন। বর্ষার সময় নদী তীরবর্তী এলাকাগুলি বেনাঘাসের বনে ভরে ওঠে। বেনাঘাসকে উশীর, বারণ, জলবাস, হরিপ্রিয়, বেণীগমূলক, মৃণাল, শিতিমূলক, রণপ্রিয়ও বলা হয়। ক্ষীরাই নদীর পাড়ে বেনাঘাসের বন
আমবাত, মূত্ররোগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গাত্র দুর্গন্ধ, মূর্ছা লাগা, জ্বর, সর্দি কাশি, বলক্ষয়, বায়গোলা রোগ নিরাময়ে বেনাগাছ বেশ দরকারী। এর মধ্যে যেসব রাসায়নিক উপাদান মেলে সেগুলি হল -- Laevojujenol, ẞ-vetivene, a-calacorance, Zizanene-(+), a-amorphene, β-vetivenene, y-vetivene, zizanene, cyclocopacamphene. and ẞ-vetispirenes, Cyclocopacamphenols, zizanol, vetiselinenol, khusinol, khusimyl acetate, elemol এবং ẞ-eudesmol। বেনাঘাস থেকে গ্রামের মহিলারা সুন্দর ঝাড়ু তৈরি করে। এছাড়াও নানা ধরনের লৌকিক গহনা তৈরি হচ্ছে ইদানীং।
🍂
0 Comments