উড়োমেঘ
পুলককান্তি কর
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেজাজটা তেতো হয়ে গেল অতনুর। গতকাল তার হবু বাড়িওয়ালি বাড়ি ভাড়া দেবার যেসব শর্তগুলো শোনালেন, তা যেমন অসম্মানের তেমনি অপমানের। তবু এই লজের ছোট খাট আর নোংরা মশারির ভেতর থেকে বেরোতে বেরোতে অতনু মনস্থির করে ফেলল ওই বাড়িটাই ভাড়া নেবে সে।
দিন দশেক হল একটি বেসরকারি চাকরি নিয়ে এই শহরে সে এসেছে। অবশ্য শহর না বলে গঞ্জই বলা ভালো। জায়গার নামটি কিন্তু বেশ-- শীতোর। এই নামটুকু ছাড়া অবশ্য আর সবকিছুই খারাপ এখানে। না আছে ভালো কোনও হোটেল, না আছে লজ। একটা ভালো বাড়ি পর্যন্ত ভাড়া হিসাবে পাওয়া যায় না৷ যে বাড়ি পাওয়া যায়, হয় তার বাথরুম-পায়খানা নেই, নয়তো থাকলেও ত্রিশ হাত দূরে, গোয়ালের কাছে। ফ্ল্যাটবাড়ির কোনও ধারণাই নেই কোনও বাড়িওয়ালার। বরং গতকালই যে বাড়িটা দেখে এল, সেটা বেশ চলনসই। একতলায় দুটো রুম, পায়খানা-বাথরুম, সামনে নলকূপ। হাজার টাকা মাসে ভাড়া। বাড়িওয়ালি এক মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে ওপরে থাকেন। ভদ্রমহিলাকে দেখতে বেশ ভালোই। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়েস। বিধবা মানুষ। স্বামীর পেনশনের টাকা আর ঘরভাড়ার টাকায় সংসার চালান। দেখলে বেশ মাসিমা বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়। তবু কাল এমন করে চুক্তির শর্ত শোনালেন, অতনুর মনে হল, পৃথিবীর সব বাড়িওয়ালারা বোধহয় স্বভাবে এক। রাত ন’টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে, ঘরে বেশি বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা মারা চলবে না-- এসব না হয় তাও মানা যায়, কিন্তু প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশা করা চলবে না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারও সাথে আড্ডা মারা যাবে না, পাশের বাড়ির মেয়েদের সাথে কথা বলা যাবে না-- এসব শর্ত কেমন যেন অপমানজনক। বাড়িওয়ালি কি গার্জেন? কি জানি, লোকাল গার্জেন তো বটে! অতনু সাতপাঁচ ভেবে দেখল, এই লজে রাতের পর রাত না ঘুমোনোর চেয়ে ওই বাড়ি ঢের ভালো। হ্যাঁ, ওইসব শর্ত মেনেও।
পরের দিন জিনিসপত্র সব নিয়ে অতনু চলে এল নতুন ঘরে। জিনিস বলতে -- বিছানাপত্র আর কয়েকটা থালাবাটি। খাট একটা বানিয়ে নিলেই হবে। এখানে হোটেলের যা দুর্দশা, নিজে রান্না করাই সবচেয়ে ভালো। অতনু এমনিতেই পেটরোগা, তার উপর সময় কাটানোটাও তো একটা সমস্যা। রান্নাবান্নায় মেতে থাকলে সময়টাও বেশ কেটে যাবে। রান্নাবান্না করতে যদিও একটুও ভালো লাগে না তার। অবশ্য বাড়িতে মা খুব উঠেপড়ে লেগেছেন তার বিয়ের জন্য, মাস ছয়েকের মধ্যে সামনের ফাল্গুনে নিশ্চয়ই লাগিয়ে দেবেন। ততদিন পর্যন্ত তো তাকেই চালাতে হবে !
দিনগুলো চলতে লাগল ভালোই। বাড়িওয়ালিকে যতটা খারাপ মনে হয়েছিল, তা তিনি নন। খুবই স্নেহশীলা। অর্ধেক দিন অতনুর খাওয়াদাওয়া হয় উপরতলাতেই। অবসর সময়ে সিনেমা দেখতে হলে কিংবা খেলা দেখা-- ওই উপরতলার টিভিই এখন অতনুর সম্বল। আস্তে আস্তে জায়গাটাও পছন্দ হয়ে গেল তার।
২
একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে চা বসাতে গেল অতনু! রবিবারের সকাল, দেরি করে রান্না চাপালে কোনও অসুবিধে নেই। এমন সময় দরজায় ঠকঠক। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলেই চমকে উঠল অতনু৷ একটি সালোয়ার কামিজ পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার দরজার সামনে। হাতে একটা বাটি। বয়স আন্দাজ চব্বিশ কি পঁচিশ, শ্যামলা রঙ, কিন্তু মুখটি বড় লাবণ্যময়। হকচকিয়ে গেল অতনু। পাশের বাড়ির মেয়ে-- দু:একবার চোখাচোখি হয়েছে যদিও, পরিচয় হয়নি তাদের। কী যেন নাম মেয়েটার? ঝিমলি? হবে বোধহয়। অতনু দরজাটা ফাঁক করে ওকে ভেতরে আসতে বলবে কি না ভাবছে, এমন সময় মেয়েটা বাটিটা ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘মা পাঠিয়ে দিলেন।‘
-- কী আছে এতে ?
-- খুলেই দেখুন না ! বিষ নেই নিশ্চয়ই।
মেয়েটা বেশ মুখরা তো! অতনু মনে মনে কিছুটা বিরক্তই হল। মুখে অবশ্য বলল, ‘এসব পাঠাবার কী দরকার ছিল?’
-- আমরা তো আপনার মতো আত্মকেন্দ্রিক নই, পাড়াপড়শির খোঁজখবর করি, বলেই হুট করে চলে গেল মেয়েটি।
একটা উপযুক্ত জবাব না দিতে পেরে কেমন যেন হয়ে গেল অতনু। তার সাথে অস্বস্তি -- যদি উপরের মাসিমা জানতে পারেন, তবে কী হবে কে জানে!
যাহোক, এবেলা কিছুই হল না৷ বিকেলে খাওয়াদাওয়া শেষ করে দিব্যি দিবানিদ্রা দিল সে। দুপুরের খাওয়াটা বেশ গুরুপাক হয়েছিল৷ ওদের বাড়ি থেকে অনেকখানি মাংস দিয়েছিল। রান্নাটাও বেশ চমৎকার। ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে উপরের দিকে গেল অতনু। একটু আশঙ্কা নিয়েই। গিয়ে দেখল সবকিছু স্বাভাবিক। মাসিমা হাসিমুখেই চা খাওয়ালেন, জলখাবার দিলেন। অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল ও। খানিকক্ষণ টিভি দেখে নীচে নামতে যাবে, এমন সময় মাসিমা বললেন, অতনু, একটু এঘরে এসো তো। তোমার সঙ্গে কথা আছে৷
বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল অতনুর। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেমন মরিয়া হয়ে যায় মানুষ, অতনু মনে মনে সেরকম শক্ত হয়েই রইল। যদিও মাসিমা স্নেহ করেন তাকে, তবু সেরকম কিছু বললে, সেও দুকথা শুনিয়ে দেবে। মাসিমা বললেন, ‘দেখো অতনু, আমি তোমার মায়ের মতন। তোমার ভালো চাই। তুমি আমার বাড়িতে ভাড়া আছো বলে তোমাকে আমি বন্দি করে রাখব, তা নয়। তবু সাবধানে থেকো, এখানকার মানুষজন ভালো নয়!’
অতনু চুপ করে রইল। কী-ই বা বলবে সে। মাসিমা বললেন, মেয়েটিকে তুমি চেনো?
-- আলাপ ছিল না, তবে পথেঘাটে দেখেছি।
-- ওর আগের কথা জানো কিছু?
-- আগের কথা মানে?
-- ওই মেয়েটার কথা বলছি। পোড়া কপাল ওর। বিয়ে হয়েছিল বছর চারেক আগে। ছ'মাসের বেশি ঘর করতে পারেনি। বাপ-মা কী দেখে যে বিয়ে দিয়েছিল, কে জানে? মাতাল, লম্পট স্বামী; খুব অত্যাচার করত মেয়েটাকে। ছ'মাস বাদে যখন মেয়েটি ফিরে এল, দেখে চেনা যায় না। সারা গায়ে মারের দাগ। ওহ্ , কী নিষ্ঠুর! বলতে বলতে শিউরে উঠলেন মাসিমা।
অতনু বলল, পুলিশ কেস হয়নি ?
-- হয়েছিল। তবে ওরা টাকাফাকা খাইয়ে সামলে নিয়েছে সব।
অতনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু মাসিমা, আমার কী দোষ ! আমি তো আগ বাড়িয়ে কারুর সাথে আলাপ করিনি।
-- তোমাকে কারুর সাথে আলাপ করতে হবে না বাবা, যেচে যেচে সবাই তোমার সাথে আলাপ করবে, তুমি চাকরি করো কিনা! অতনুর মুখের কথা কেড়ে বললেন মাসিমা।
-- কিন্তু মেয়েটির তো কোনও দোষ নেই!
-- দোষ কারুর নেই বাবা, দোষ এই সমাজের। তুমি বড় হয়েছ, ভালোমন্দ জ্ঞান তোমার হয়েছে। যা করবে, বুঝেশুনে করবে। এখানকার লোকজন ভালো নয়। মাসিমা আবার সাবধান বাণী শুনিয়ে চলে গেলেন কাজে।
দিনকয়েক যেতে না যেতেই আবার এক সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল অতনুর সামনে। ওদের বাটিটা ফেরত দেওয়া হয়নি। ওরা কী ভাবছে কে জানে? ওই বা কী করে বাটিটা ফেরত দিয়ে আসবে, অনেক ভেবেও ঠিক করে উঠতে পারল না কিছুতেই। সেদিন সকালে ঘরের দরজা খোলা রেখেই বাথরুমে গিয়েছিল অতনু। বেরিয়ে এসে দেখল ঝিমলি না কি যেন নাম মেয়েটির, এসে বসে আছে তার খাটে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে গায়ে জামা চাপাতে চাপাতে অতনু অল্প হেসে বলল, কী ব্যাপার?
-- আপনাকে আমরা আত্মকেন্দ্রিক বলে জানতাম, কিন্তু আপনি যে এতটা স্বার্থপর, তা জানতাম না।
অতনু একটু কড়া হয়ে বলল, কেন, স্বার্থপরতার কী দেখলেন আবার?
-- না, এমনিই। আসলে আমরা তো আর আপনাদের মত বড়লোক নই। হিসেবের বাটি। রোজ খোঁজ পড়ে।
-- কিন্তু আমি তো আপনাকে বাটিটা দিয়ে যেতে বলিনি।
-- ওটা আমাদের সৌজন্য। আপনার সে বোধটুকু নেই জানি, নইলে নিজে গিয়ে দিয়ে আসতেন। যাক, বাটিটা দিন৷ বলি সেটা ধুয়ে রেখেছেন; নাকি আমাকেই ধুয়ে নিতে হবে?
অতনু মনে মনে একটু রেগে গেল। মুখে বললো, -- আপনি তো ভারি ইয়ে। -- ঠিক আছে, আজ সন্ধেতেই আমি আপনাদের বাটি দিয়ে আসব।
মেয়েটি এবার খুব মধুর করে হাসল, বাবুর দেখছি খুব রাগ হয়েছে! না, না; আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না, আমিই নিয়ে যাচ্ছি।
ওই হাসির পর আর রাগ করে থাকা যায় না। অতনু এবার বিনয়ী গলায় বলল, ‘সত্যি, আমারই দিয়ে আসা উচিত ছিল; কিন্তু ...
-- বুঝেছি। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি এরকমই। আসলে আপনি তো কোনওদিন আমাদের বাড়িতে যাননি, আমরাই ডাকিনি। আপনার এমনি এমনি যাওয়া যে অসম্ভব, সে আমি বুঝি।
-- উঁ, ভারী বোঝেন! সকাল থেকে মিছিমিছি কত কটু কথা শোনালেন!
-- খুব অন্যায় হয়ে গেছে। তবে আজ আপনি নিজেই আমাদের বাড়ি যেতে চেয়েছেন, যাবেন তো? সন্ধেয় একটু চা খেয়ে আসবেন৷
এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা যায় না৷ অতনু তো অভদ্র নয়। উপরের মাসিমা যাই মনে করুন না কেন ...
৩
সেদিন সন্ধ্যায় একটু মিষ্টি কিনে নিয়ে অতনু গেল পাশের বাড়িতে। সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্তের ঘর। পাকা দেয়াল, উপরে টালি। গেট পেরিয়ে ছোট্ট একটা বাগান। তার পরেই বাড়ির দরজা। টোকা দিতে না দিতেই খুলে গেল দরজা। ওই মেয়েটাই খুলল। ওকে দেখে একমুখ হেসে ফেলল মেয়েটি।
-- যাক, এলেন তাহলে!
-- কেন, আপনি কী ভাবছিলেন? আসব না?
-- সেরকম ভাবাটা ভুল নাকি? যা স্বার্থপর আপনি! বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল সে। একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে আবার বলল, রাগ করবেন না যেন, আমি এরকমই। আসুন, ভেতরে আসুন।
ঘরের ভেতরে দারিদ্রের ছাপ বেশ স্পষ্ট। মেয়েটির বাবার একটা দোকান আছে। মোটামুটি চালু দোকান। ভদ্রলোকও বেশ চালু টাইপের। পরে দেখেছে সে। মেয়েটির মা বেশ ভালো মানুষ৷ মেয়েদের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। বড় মেয়েটির নাম ঝিমনি, ঝিমলি নয়। বোধহয় ছোটবেলায় খুব ঝিমোত, ঝিমুনি থেকে ঝিমনি হয়ে গেছে। ওরা তিন বোন৷ মাঝের বোনটির বিয়ে হয়ে গেছে, কাছেই থাকে। ছোট বোন, ছন্দ মিলিয়েই বোধহয় ইমনি। বেশ মেয়েটি। ক্লাশ নাইনে পড়ে। ঝিমনির যে বিয়ে হয়েছিল, সে কথাও কথায় কথায় বের হয়ে গেল। প্রসঙ্গ লঘু করার জন্য অতনু বলল, আমি ভেবেছিলাম আপনার নাম ঝিমলি।
-- আপনার এমন ভাবার কারণটা কী জানতে পারি? আপনি কি হাত গুণে নাম জেনে যান?
-- না, এই নামে কেউ ডাকাডাকি করলে আপনি সাড়া দেন কিনা, তাই !
-- ও, ভেতরে ভেতরে তাহলে আমাদের প্রতি আপনার মনোযোগ ছিল বলুন!
মেয়েটি কথায় যেন একেবারে বৃহস্পতি। ভীষণ অপ্রস্তুত করে দেয়। খুব হাসিখুশিও। এমন একটি মেয়ের জীবনে এমন একটা অন্ধকার অধ্যায় আছে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য ঝিমনিকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সে এজন্য দুঃখ পায়। অতনু বলল, আপনার আপত্তি না থাকলে আমি আপনাকে ঝিমলি বলেই ডাকব।
-- ও, আপনি এরপরও সম্পর্ক বাড়াতে চান বুঝি? আমি তো ভাবছিলাম আমাদের অকারণ সৌজন্য দেখে আপনি আমাদের সংস্রবই ত্যাগ করবেন।
-- এই দেখুন, এটা কিছু ঝগড়ার কথা। সকালবেলার কথা নিয়ে এখন টানাটানি করার কী দরকার? তাই যদি হত, তবে আজ এখানে আসতাম কি?
-- আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে। এইবার সত্যি করে বলুন তো সেদিন মাংসটুকু খেয়েছিলেন, না কি রাগ করে ফেলেই দিয়েছিলেন?
-- আবার ঝগড়া? আমি কিন্তু সবটুকুই তৃপ্তি করে খেয়েছিলাম, একটুও ফেলিনি। কে রেঁধেছিলেন, মা?
ঝিমনি কিছু না বলেই হাসল। বলল, কেন, খেতে ভালো হয়েছিল বুঝি?
৪
এভাবেই চলতে লাগল দিন। ঝিমনিদের সাথে মাখামাখিটা ইদানীং একটু বেড়েছে। মাসিমা অবশ্য আর কিছু বলেন না। ঝিমনি মাঝে মাঝে আসে এটাওটা নিয়ে। কখনও বা অতনুর থেকে বইপত্র নিয়ে যায়, সময়মতো দিয়েও যায়। অতনুও যায় মাঝেমাঝে। বাড়িতে ওর জন্য মেয়ে দেখা চলছে জোর কদমে। দিনকয়েক আগে ডাক মারফত কয়েকখানা মেয়ের ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মা। অতনু বসে বসে সেই ছবিগুলোই দেখছিল। হঠাৎ ঝিমনি এসে হাজির।
-- অতনুদা, মা বললেন আজ ওবেলা একটু আমাদের বাড়িতে যেতে।
-- কেন?
-- কেন তার আমি কী জানি? সেটা মা ই জানেন। আপনার যেতে কোনও আপত্তি আছে কি? রবিবারে পড়ে পড়ে ঘুমোনো আর টিভি দেখা ছাড়া আর কোন রাজকার্য করবেন শুনি?
-- কাজ নেই ভাবছেন? মস্ত একটা কাজ আছে৷ রাজকন্যে বাছতে হবে৷ রাজ্যপাট চালানোর লোক তো চাই !
-- এখন বসে বসে সেই চেষ্টাই করছেন বুঝি? আপনি বললে আমরাও একটু সাহায্য করতে পারি।
অতনু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় বাইরে বেশ হইচই শোনা গেল। সে তখন কিছু বুঝতে না পেরে ঝিমনিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার, পাড়ায় কোনও গোলমাল হয়েছে না কি?’
কোলাহল ক্রমশ ঘনীভূত হতে লাগল। কৌতুহল নিয়ে অতনু দরজার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল ওর ঘরের দরজার সামনে অন্তত তিরিশজন যুবক দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে একজন বখাটেমার্কা ছেলে মুখ বেঁকিয়ে একটু রহস্য করেই বলল, ‘বাহ্, বেশ বৃন্দাবন বানিয়ে তুলেছ দেখছি। বাহ, বাহ, বেশ, বেশ।‘
অতনুর কান, মাথা বেশ গরম হয়ে গেল। একটু তেরিয়া হয়ে বলল, ‘মানে ! কী অসভ্যের মত যা তা বলছেন?
-- ছেলের মুখের ভাষাটি তো বেশ কড়া৷ এমন এক গোঁত্তা দেব না, সব কড়কড়ানি থেমে যাবে ; শালা লুচ্চা কোথাকার! বহুদিন থেকে লক্ষ্য করছি, বেশ ফরর ফরর করছ। আজ দেব শালা দু'জনকেই বেঁধে, উড়ে বেড়ানো জীবনের মত বন্ধ!’ এই বলেই দরজার শিকল বাইরের থেকে লাগিয়ে দিল ছেলেগুলি। তারপর অতনুর উদ্দেশে অশ্রাব্য গালিগালাজ, রঙ্গ-রসিকতা চালাতে লাগল রসিয়ে রসিয়ে। রাগে, অপমানে লাল হয়ে গেল অতনুর মুখ। সে বেশ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, ‘এসব কী ব্যাপার ঝিমলি?’
-- বিশ্বাস করুন, আমি কিচ্ছু জানি না। এসবের কিচ্ছু জানি না আমি। ঝিমনি কাঁদছে, গলা ঠেলে যেন উঠে আসতে চাইছে এক বুক বন্যা।
-- মাসিমা আমাকে আগেই সাবধান করেছিলেন। আমি শুনিনি। ছি ছি, তোমরা এরকম অসৎ! এভাবে তোমরা আমাকে ফাঁসানোর মতলব করেছ ? আমি ভাবতেই পারিনি। ছি, মানুষকে বিশ্বাস করাও পাপ !
-- আপনি বিশ্বাস করুন অতনুদা, আমি এসব কল্পনাই করতে পারি না। কাঁদতে কাঁদতে অতনুর পায়ের কাছে বসে পড়ল ঝিমনি।
-- তাহলে ওরা দরজার শিকল তুলে দিল কেন ?
-- তার আমি কী জানি ।
রাগে, বিরক্তিতে অস্থির হয়ে দরজা ধরে নাড়াতে লাগল অতনু, ‘দরজা খুলুন। শুনছেন?’
-- খুলব, খুলব৷। ঠিক সময়েই খুলব। পুরুত আসুক, ওর বাপ আসুক। আপনি এখন পাড়ার জামাই কিনা! একটু জামাই আদরও তো করতে হবে, সময় লাগবে না ?
দরজার পাশেই একটা চেয়ারে স্থানু হয়ে বসে পড়ল অতনু। অনুভবে বুঝল তার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে আছে কিছু, পায়ের পাতা ভেজা ভেজা লাগছে। বাইরের কোলাহল ক্রমশ কলরবের মত বোধ হতে লাগল তার। আলাদা করে আর কিছু তার কানে ঢুকছে না, চোখও আর নতুন করে কিছু দেখছে না। সময় যেন একটু একটু করে অলস বাতাসের আড়াল তুলে দিতে লাগল চারপাশটাতে।
0 Comments