জ্বলদর্চি

কাঁঠাল /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ২৭
কাঁঠাল

ভাস্করব্রত পতি

"আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়"।
     -- আবার আসিব ফিরে (জীবনানন্দ দাশ) 

রামায়ণের অযোধ্যা কান্ডে রয়েছে, একসময় শ্রীরামচন্দ্র সীতা ও লক্ষ্মণ সহ অযোধ্যা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ১৪ বছরের জন্য বনবাস ভোগ করছেন। এমতাবস্থায় ভরত অযোধ্যা থেকে সৈন্যসামন্ত সহ রাজকীয় মর্যাদায় আবার শ্রীরামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনতে বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তায় সাক্ষাৎ হ'লো গুহকের সাথে। তিনিই পথপ্রদর্শক হ'লেন শ্রীরামচন্দ্রকে খুঁজে আনার। কিছুদূর আসার পর তাঁরা এলেন ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে। সেখানে তাঁকে খুব খাতির করলেন ঋষি। কিন্তু সঙ্গে প্রচুর লোকজন, তাই আশ্রমের অসুবিধা হবে ভেবে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু ঋষি যেতে দিলেননা। বরং দেখতে পেলেন ঋষির যোগবলে ভরতের সঙ্গে থাকা  হাতি ঘোড়া সৈন্যসামন্ত সকলের খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল! এমনকি নানা ধরনের মদও পৌঁছে গেল। রাজা ভরত আরও অবাক হয়ে দেখতে পেলেন অসময়ের বহু ফলমূলও চলে এসেছে তাঁদের কাছে। তখন তিনি সেসবের উৎস খুঁজতে ঋষি ভরদ্বাজের বিশাল বাগান ঘুরে দেখলেন। অযোধ্যা কাণ্ডে সেই বাগানের বর্ণনায় পাওয়া যায় --
"তস্মিন্ বিলাঃ কপিথাশ্চ পনসা বীজপুরকাঃ। 
আমলক্যো বহুবচ চুতাশ্চ ফলভূষিতাঃ"॥
অর্থাৎ বেল, কয়েৎবেল, কাঁঠাল, বাতাবিলেবু, আম প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছে ভরপুর ভরদ্বাজের বাগান।

আবার শ্রীরামচন্দ্র যে চিত্রকূট পাহাড়ে রয়েছেন, সেখানেও অসংখ্য ফল ফুলারির সম্ভার। অযোধ্যা কাণ্ডের এই অংশেও বর্ণনা করা হয়েছে অন্যান্য ফলের সাথে কাঁঠালের কথা --
"আম্র জম্মসনৈ লোধ্রৈ পিয়ালৈঃ পনসৈরপি। 
অঙ্কোঠৈর্ভব্য তিনিশৈ বিল্ব তিন্দুক বেনুভিঃ"।
অর্থাৎ আম, জাম, অসন, লোধ, পিয়াল, কাঁঠাল, ধব, চালতা, তিনিশ, তিন্দুক (গাব ও কেন্দু বা কে'উদা), বেল ইত্যাদি রয়েছে চিত্রকূট পাহাড়ে। শ্রীরামচন্দ্র যখন চিত্রকূট ছেড়ে পঞ্চবটীতে এসে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করছিলেন, সেখানে তিনি অনেক ফলের গাছ দেখেছেন।  সেই বর্ণনাতেও বিভিন্ন ফলের সঙ্গে কাঁঠালের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল -- 
"স্যন্দনৈ শ্চন্দনৈ নীপৈঃ পনসৈঃ লকুচৈ রপি। 
ধবাশ্চ কর্ণখদিরৈঃ শমী কিংশুক পাটলৈঃ"। 
অর্থাৎ চন্দন, কদম, কাঁঠাল, লকুচ (ডেইয়া), ধব, পলাশ, শমী, খদির, পাটল (পারুল) প্রভৃতি গাছ রয়েছে। অর্থাৎ কাঁঠালের প্রাচীনত্ব নিয়ে সংশয় রাখা চলেনা। বাংলার বিভিন্ন লৌকিক উপচারে কাঁঠাল পাতার ব্যবহার আজও রয়েছে। সেঁজুতি ব্রতের ছড়ায় আম কাঁঠালের পিঁড়িতে হাত দিয়ে বলা হয় --
"আম কাঁঠালের পিঁড়িখানি
ঘি চপ্ চপ্ করে। 
আমার ভাই রাজ্যেশ্বর
সেই বসতে পারে"।
কাঁঠাল পাতা

কাঁঠালের কথা চরকের সূত্রস্থানেও রয়েছে --
"সম্পক্কং পনসং মোচং রাজ্যদান ফলানি চ। 
স্বাদুনি সকষায়াণি স্নিগ্ধশীতগুরুণি চ"।
অর্থাৎ কাঁঠালের পাকা ফল শুধু সুমিষ্ট নয়, সামান্য কষায় রস স্নিগ্ধগুণে এবং শীত বীর্য। চরকের আরেকটি সূত্রস্থানে পাই --
"পনসং স কষায়ংতু স্নিগ্ধং স্বাদুরসং গুরু"।
অর্থাৎ কাঁঠাল ফল পেকে গেলে স্বাদুরসযুক্ত হলেও সামান্য কষায়ধর্মিতা থাকেই। এটি বিপাকে (পরিপাকান্তে) গুরুতা আনে। 

কাঁঠাল পরিচিত পনস, চম্পকোষ, চম্রানু, রসাল, কণ্টকিফল, কণাজ, অপুষ্পফলদ, চুতফল, স্থল, অতি বৃহৎফল, ফলবৃক্ষক, মহাসজ, ফলিন, কণ্ঠফল, পনস, পনসতালিকা, মূলফল, মৃদঙ্গদল ইত্যাদি নামেও। এটি মোরেসি পরিবারের অন্তর্গত। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম -- Artocarpus integrifolia। এছাড়াও রয়েছে Artocarpus heterophyllus Lam, Artocarpus nanca Noronha, Artocarpus brasiliensis Ortega, Artocarpus philippensis Lam, Artocarpus maximus Blanco ইত্যাদি নামের প্রজাতি। 
গাছে ঝুলছে পাকা কাঁঠাল

প্রবাদের আঙিনায় অনেক জায়গায় পাওয়া যায় কাঁঠালকে। আমরা প্রায়ই বলে থাকি "কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো"। এছাড়াও বলি "গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল", "এ যেন কাঁঠালের আঁঠা, ছাড়তেই চায়না", "পিরিতের আঠাকাঠি যেন কাঁঠালের আঠার" ইত্যাদি। রাজবংশী ধাঁধাতে রয়েছে -- 
"এ্যাক না বাপোই সারা গায়ে আটোই"! 
বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের মানুষ লোকের জ্ঞান পরীক্ষা নিতে বলে -- 
"এত কাডার ভিতরে বেত কাডা 
এর ভিতরে সুন্দর ওগ্গো বেডা"! 
ময়মনসিংহ এলাকায় শোনা যায় -- 
"উপরে কাঁডা (কাঁটা) 
ভিতরে আডা (আঁঠা)"! 
রথের মেলা এলেই আরও গুরুত্ব বেড়ে যায় পাকা কাঁঠালের। দেদার বিকোয় কাঁঠালের কোষ বা কোয়া। কাঁঠালের কোষ নিয়ে ধাঁধায় রয়েছে -- 
"চাইর কিনার দি লোয়ার কেঁডা 
মইধ্যে বই বৈয়ে বৈরাগ্যা বেলা"! (কেঁডা = কাঁটা) 

এই গাছ সাধারণত ঘন সবুজ পাতাযুক্ত হয়। বড় গাছের উচ্চতা প্রায় ৫০-৬০ ফুট পর্যন্ত হয়। উপরের কাঠ ফিকে এবং ভিতরের কাঠ হলুদ রঙের হয়। গুঁড়িটি ১০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা ও মোটা হয়। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর রেলস্টেশনে মা সারদার স্মৃতিধন্য একটি অতি প্রাচীন কাঁঠাল গাছ এখনও সযতনে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। এই গাছের সাথে থাকা সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে -- 
"শ্রীশ্রী মা সারদা দেবী কলিকাতা যাইবার পথে এই কাঁঠাল বৃক্ষ তলে বিশ্রাম লইতেন। मा सारदा की एतिहासिक चवतरा, MOTHER SARADA DEVI USED TO SEAT HERE ON HER WAY TO CALCUTTA"! 

কুমিল্লাতে একটি ছড়ায় কাঁঠালের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে লোকঠকানো বিদ্যায় বলা হয় --
"ক'কারুদি নাম তার / ক'য়েতে আকার
কাঠার কাটিয়া মুণ্ড, / মধ্য দিয়া তার
লতার প্রথম অক্ষর, / সনে মিশাইয়া
ইহাতে যে দ্রব্য হয় / দিবেন পাঠাইয়া"। 
সমধর্মী আরেকটি ধাঁধায় কাঁঠাল সম্পর্কে রহস্য তৈরি করে বলতে শোনা যায় --
"কামারের মার মারিয়া 
পাঁঠায় মারিয়া পা 
লবনের বন মারিয়া 
বাহার করিয়া খা"! 
ঠিক এরকমই আরেকটি ছড়া শোনা যায় এপার বাংলার রসিক মানুষজনের মুখেও -- 
"কায়স্থ অস্থ ছাড়া, 
পাঁঠা ছাড়া পা 
লবঙ্গের বঙ্গ ছাড়া, 
আনে দিবে তা"! (পুরুলিয়া) 

কাঁঠাল ফলের গায়ে থাকে কাঁটা। তা নিয়ে বলা হয় -- "একটা বুড়ির গোটা গায়ে ফুসকুড়ি"! 
আরেকটি ছড়ায় আছে -- 
"কন্টকে আবৃত দেহ সজারু সে নয় 
মানুষে পাইলে গন্ধ তখনি ছেদ হয়"! 
এরকমই ছড়ায় রয়েছে -- 
"পাখি নয় গাছে রয় / অঙ্গ তার চারু 
গায়ে কাঁটা আগাগোড়া / নয় সে সজারু 
বাদুড় নহেক তারা / ফুলে ফুলে ঝুলে  
সৌরভ গৌরব ফলে / নাহি কিছু ফুলে"! 
এই কাঁটাযুক্ত কাঁঠালের জনপ্রিয়তা নিয়ে মেদিনীপুরের লোকছড়ায় মেলে -- 
"তেল চিক চিক পাতা, ফলে ধরে কাঁটা 
পাকলে মধুর মধুর, বীজ গোটা গোটা"! 
নোয়াখালীর লোকেরা বলে -- 
"ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁটা 
এইনি রাজার খাটা  
বালদি বাইনছে ঘর 
এইনি রাজার টংগের ঘর"! 
চট্টগ্রামের চাটগাঁ ভাষার মানুষজন কাঁঠালের কাঁটা নিয়ে বলেন -- 
"গাড়ুর খুড়ুম সর্ব গায়ে শিং 
অণ্ডকোষের ঠিকানা নাই 
এ্যাকেটা তার শিং (মোচা)
মোচলমানে খাইলে আদোব মোতোন খায় 
আর হেন্দুই খাইলে হাত নাইংলা নাগায় (হাত দিয়ে খায়)"! 

ছাগলের অতি প্রিয় খাদ্য হল এই কাঁঠাল পাতা। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, "দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে"! বাঙালির হেঁসেলে কাঁঠাল অতি পরিচিত এক উপাদান। কাঁচা অবস্থায় কাঁঠালকে বলে 'এঁচোড়'। তাই নিয়ে প্রবাদে রয়েছে "এঁচোড়ে পাকা"! আর পাকা কাঁঠালের তো জুড়ি মেলা ভার। তবে কাঁঠালের মধ্যে থাকা ভুতুড়ি খাওয়া হয়না। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় পাকা কাঁঠালের সুমিষ্ট গন্ধ নিয়ে একটি ধাঁধায় জিজ্ঞেস করা হয় -- 
"এপারেতে বুড়ি মরে, ওপারেতে গন্ধ ছাড়ে"! 
অন্য জায়গায় আবার বলা হয়ে থাকে -- "এ ঘরে মড়া মরেছে, ও ঘরে গন্ধ ছড়াচ্ছে"! 
অর্থাৎ, কাঁঠাল পাকলে তার গন্ধ দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। চারিদিক ম ম করে ওঠে। পাকা কাঁঠালের বর্ণনা মেলে ঢাকা এলাকার একটি ছড়ায় -- 
"যৌবনে নাহিক রস রসিক যুবতী
বৃদ্ধকালে হয় সে অতি রসবতী
বুঝহে ইহার ভাব রসিক সুজন
ভাবিলে অবশ্য হবে রসের মিলন"। 

কাঁঠাল একটি অন্যতম উপকারী ফল। ক্লান্তি নিরসনে, অরুচির পরিবর্তনে, যৌন দৌর্বল্যের হাত থেকে বাঁচতে, নানা চর্মরোগ যেমন দাদ হাজা চুলকানির নিরসনে, রক্তপিত্ত কমাতে, অত্যধিক মাংস খাবার দরুন সৃষ্ট বাত থেকে রেহাই পেতে কাঁঠালের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রান্না করা কাঁঠালের স্বাদ মাংসের ঝোলের মতো হওয়ায় খাদ্যরসিকদের কাছে এটি -- 'গাছপাঁঠা'।

🍂

Post a Comment

0 Comments