রাজীব শ্রাবণ
সময় কাল খৃষ্টীয় আঠারো-ঊনিশ শতক। দার্শনিক বেন্থাম ও তাঁর শিষ্য জন স্টুয়ার্ট মিল পাশ্চাত্য দেশে হিতবাদের অথবা মানুষের প্রভূততম কল্যাণ করবার আদর্শ স্থাপন করেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, বাংলা ভাষায় সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে প্যারীচাঁদ মিত্র খুব সম্ভবতঃ তাঁদের সেই আদর্শের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যে সময়ে বাংলা সাহিত্যে অক্ষয়কুমার দত্ত ও পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের সাহিত্যিক যশ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল, বিদ্যাসাগরের ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ ও ‘শকুন্তলা’র সুমধুর শব্দঝঙ্কারে এবং অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ ও ‘চারুপাঠ’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের ভাষার গাম্ভীর্য ও ওজস্বিতায় বাঙালি পাঠক-পাঠিকারা মুগ্ধ ও চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক সেই সময়েই বাংলা গদ্য সাহিত্যের ময়দানে দুঃসাহসী প্যারীচাঁদ মিত্রের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামক আখ্যানটি যখন ‘মাসিক পত্র’ নামক একটি পত্রিকায় প্রতি সংখ্যায় প্রকাশিত হতে আরম্ভ করেছিল, তখন বাংলার কেউই যেমন তাঁকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেননি, তেমনি এই আখ্যানের মধ্যে দিয়েই যে বাংলা গদ্য-সাহিত্যের একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সূচিত হয়ে গিয়েছিল— সেকথাও কেউ অনুমান করতে পারেন নি। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, অনেক পরে, ১৮৯২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান’ নামক প্রবন্ধে বিষয়টির উপরে সর্বপ্রথম আলোকপাত করেছিলেন। যাই হোক, বাংলা ভাষাকে সকলের বোধগম্য করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই ‘মাসিক পত্র’ নামক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকাটিকে ঊনিশ শতকের বাংলার দু’জন দুঃসাহসী অথচ মনস্বী সন্তান— প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদারের অক্ষয় ঐতিহাসিক কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন যে, পণ্ডিত বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমারের বাংলা ভাষা সংস্কৃতানুগামিনী হওয়ার ফলে এই ভাষার রস-আস্বাদনে সেযুগের অধিকাংশ মানুষই বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাই তাঁরা এমন একটি ভাষার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যে ভাষার সঙ্গে সেযুগের বাংলার পুরনারীরাও পরিচিত ছিলেন। এরপরে এই মহান উদ্দেশ্য নিয়েই প্যারীচাঁদ বাঙালির ঘরোয়া ভাষায় সেযুগের বাঙালির ঘরের কথা লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস-রচনার প্রচেষ্টা এবং চলতি ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টির প্রথম প্রয়াস হিসেবে ‘আলালের ঘরের দুলালের’ নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই গ্রন্থটি ছাড়া নিজের রচিত যে সমস্ত গ্রন্থে প্যারীচাঁদ সাধুরীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, সেখানেও তিনি দুরূহ ও অপ্রচলিত শব্দগুলিকে বর্জন করে এবং দীর্ঘ সমস্ত পদগুলিকে পরিহার করে বাংলা ভাষাকে সহজবোধ্য করে তুলেছিলেন। সমালোচকদের মতে, মূলতঃ লোক-কল্যাণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই প্যারীচাঁদ বাংলা ভাষায় সাহিত্য-সাধনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর প্রায় সর্ববিধ সাহিত্যিক প্রচেষ্টার মূলেই ডিরোজিওর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব ছিল।
হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর প্রখর ব্যক্তিত্ব ও অসামান্য মনীষা— সেযুগের হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে যে বিপ্লব ও উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল, সেই ইতিহাস আজও বাঙালির মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। অতি অল্প বয়সেই ডিরোজিওর মধ্যে কবিত্ব-শক্তির উন্মেষ ঘটেছিল এবং তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর কাব্যে ভারতভূমিকে ‘জননী’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। সমালোচকদের মতে ডিরোজিও ফরাসী বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং নিজের প্রচুর প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি তৎকালীন বাংলার তরুণদের প্রাণে বিপ্লবের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে তুলিতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু এই স্বল্পজীবী মনস্বী শিক্ষক কোনদিনই আত্মস্থ হওয়ার অবকাশ পাননি এবং তাঁর প্রদত্ত শিক্ষার সঠিক তাৎপর্যও তাঁর তরুণ শিষ্যরা যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তবুও তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে দেশের সেবায় নিজেদের স্বল্প অথবা বৃহৎ শক্তি নিয়োগ করেছিলেন; এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ভারতীয় সাধনা ও সংস্কৃতির দিকেও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। হিন্দু কলেজের তরুণ ছাত্রদের মনে ডিরোজিও যে কি বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সে সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ম্যাক্সমূলার লিখেছিলেন—
“Derozio, though branded by the clergy as an infidel and a devil of the Thomas Paine School, was worshipped by his pupils as the incarnation of goodness and kindness.”
প্যারীচাঁদ মিত্র একজন বিচিত্রকর্মা পুরুষ ছিলেন। কর্ম-সাধনা ও সাহিত্য-সাধনা— উভয় ক্ষেত্রেই তিনি লোকহিতের আদর্শের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিলেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
অবশ্য, সাহিত্যিক প্যারীচাঁদের ভিতরে যতটা সম্ভাবনা ছিল, বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি কিন্তু ঠিক ততটা সার্থকতা লাভ করতে পারেননি। এর মূল কারণ হল যে— তাঁর মনে লোক-কল্যাণের আদর্শ সবসময়ে জাগরূক ছিল। হাস্যরস-সৃষ্টিতে তাঁর দক্ষতা ছিল, মানব-চরিত্র সম্পর্কেও তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু তিনি একটি আখ্যানবস্তুকে উপলক্ষ্যমাত্র করে বাঙালিকে নীতিশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে তাঁর উপন্যাস রচনা করবার প্রচেষ্টা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল বলে সমালোচকরা মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে— নইলে যিনি ঠকচাচার মত জীবন্ত একটি চরিত্রকে অঙ্কিত করেছিলেন, সেই তিনি অন্যান্য চরিত্র-সৃষ্টিতেও অধিকতর নৈপুণ্য দেখতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্রই রক্তমাংসের মানুষ না হয়ে এক একটি ভাবের বাহন বা প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিল বলে দেখা যায়। প্যারীচাঁদ তাঁর প্রত্যেকটি গ্রন্থই লোকশিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে রচনা করেছিলেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রচনা করবার অন্যতম উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছিলেন—
“The work has been written in a simple style and to foreigners desirous of acquiring an idiomatic knowledge of the Bengali language and an acquaintance with Hindu domestic life, it will perhaps be found useful.”
১৮৫৯ সালে ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত রাখার কি উপায়’ গ্রন্থে তিনি মদ্যপান, জাত্যভিমান প্রভৃতি দোষসমূহের উপরে কশাঘাত করেছিলেন। ১৮৬০ সালে রচিত ‘রামারঞ্জিকা’ গ্রন্থে তিনি সেযুগের পুরনারীদের সাংসারিক বিষয়ে উপদেশ প্রদান করেছিলেন। ১৮৬৫ সালে রচিত ‘যৎকিঞ্চিত’ গ্রন্থে তিনি ঈশ্বর, আত্মা, উপাসনা প্রভৃতি বিষয়ের উপরে আলোচনা করেছিলেন, এরপরে সেই একইবছরে লেখা ‘অভেদী’ নামক গ্রন্থে তিনি একটি নায়ক ও নায়িকাকে উপলক্ষ্যমাত্র করে বাঙালিকে অধ্যাত্ম তত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা’ গ্রন্থে তিনি প্রাচীনকালের মহীয়সী নারীদের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে তিনি ভারতীয় নারীত্বের আদর্শকে স্থাপন করেছিলেন। এরপরে আবার নারী-কল্যাণের উদ্দেশ্য নিয়েই ১৮৮০ সালে তিনি ‘আধ্যাত্মিকা’ নামক একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, এবং ১৮৮১ সালে ‘বামাতোষিণী’ নামক গ্রন্থে নীতিমূলক গল্পের সাহায্যে সেযুগের নারীদের বিবিধ গার্হস্থ্য বিষয় নিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন। বাংলা ছাড়াও প্যারীচাঁদ মিত্র ইংরেজিতেও নানা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া কৃষিবিদ্যা, আইনশাস্ত্র, জীবনচরিত, অধ্যাত্মবিদ্যা, প্রেততত্ত্ব প্রভৃতি নানা বিষয়ের উপরে তিনি বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করেছিলেন; এবং এসব ক্ষেত্রেও তিনি যে একই মহৎ আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, সেবিষয়ে সমালোচকদের কোন সন্দেহ নেই।
প্যারীচাঁদের হাস্যরসের নিদর্শন তাঁর রচিত প্রথম দুটি গ্রন্থে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা বলেছিলেন—
“নির্মল শুভ্র সংযত হাস্য বঙ্কিমই প্রথম বাংলা সাহিত্যে আনয়ন করেন।”
সমালোচকদের মতে— বঙ্কিমচন্দ্রের মত উচ্চাঙ্গের হাস্যরস সৃষ্টি করবার বা হাস্যরসের বৈচিত্র্য-সম্পাদন করবার বিষয়ে প্যারীচাঁদের দক্ষতা ছিল না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে লঘু অথচ সংযত হাস্যরস সম্ভবতঃ প্যারীচাঁদই প্রথম নিয়ে এসেছিলেন। প্যারীচাঁদের আগে ব্যঙ্গকবিতা রচনা করবার ক্ষেত্রে ঈশ্বর গুপ্ত এবং ব্যঙ্গ-চিত্র অঙ্কন করবার ব্যাপারে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাংলা নাটক ও প্রহসনে দীনবন্ধু মিত্র হাস্যরসের অবতারণা করেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, দীনবন্ধুর প্রথম নাটকটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই কিন্তু প্যারীচাঁদের প্রথম দুটি গ্রন্থ মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল। তবে ঈশ্বর গুপ্ত বা ভবানীচরণ বা দীনবন্ধু— কেউই সময়ে সময়ে নিজেদের সংযম ও সুরুচির সীমা লঙ্ঘন করতে দ্বিধা করেননি। এমনকি বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদের অনুবর্তী কালীপ্রসন্ন সিংহও তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থে কথ্যভাষা ও উপভাষার প্রয়োগের ব্যাপারে এবং সমসাময়িক সমাজের চিত্র-অঙ্কনে অসামান্য কুশলতা প্রদর্শন করলেও, তিনিও জায়গায় জায়গায় শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং এদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদের কৃতিত্ব কিন্তু খুব একটা অল্প নয়। যদিও সমালোচকদের মধ্যে অনেকেই যেমন প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থের উপরে ভবানীচরণের ‘নববাবু-বিলাস’ গ্রন্থটির ও সমাচার-দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাবু’ উপাখ্যানের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন, তেমনি আবার তাঁর রূপক-কাহিনী ‘অভেদী’ জন বেনিয়ানের ‘Pilgrim’s Progress’–এর কিছু প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদের মর্যাদা বা মৌলিকতা কোথাও বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্ৰ যথার্থই বলেছিলেন— যে সময়ে বাংলার দু’জন প্রতিভাশালী লেখক সংস্কৃত বা ইংরেজি-সাহিত্য থেকে গ্রন্থের বিষয়বস্তু আহরণ করছিলেন, সেই সময়ে প্যারীচাঁদ তাঁর নিজের কল্পনা থেকে আখ্যানবস্তু আহরণ করে বাংলা-সাহিত্যের বৈচিত্র্য-সম্পাদন করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে প্যারীচাঁদ দ্বিবিধ কীর্তির অধিকারী ছিলেন।
প্রথমতঃ, তিনি খাঁটি বাংলা শব্দ ও চলতি বুলির শক্তি আবিষ্কার করে বাংলা ভাষাকে সর্বজনের বোধগম্য করে তুলেছিলেন।
দ্বিতীয়তঃ, আঠারো-ঊনিশ শতকের বাঙালি লেখকেরা যখন বাংলা সাহিত্যের বিষয়বস্তুর জন্য অন্যদের দ্বারস্থ হচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে প্যারীচাঁদ তাঁর নিজের কল্পনার ভাণ্ডার থেকে গল্পের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন।
চলিত শব্দ ও চলিত বুলির মধ্যে যে ভাবপ্রকাশের অপূর্ব শক্তি নিহিত রয়েছে এবং খাঁটি বাংলা ভাষায় যে যথার্থ সাহিত্য-রচনা করা সম্ভব— এই সত্যি আবিষ্কার করবার প্রতিভা প্যারীচাঁদের মধ্যে ছিল। তবে সমালোচকদের মতে— অবশ্য, প্যারীচাঁদের রচনার বিভিন্ন জায়গায় সাধু ও চলতি ক্রিয়াপদের মিশ্রণ অসতর্ক পাঠক-পাঠিকারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু একইসাথে একথাও সত্যি যে, বাংলা চলতি ভাষায় যিনি সর্বপ্রথম উপন্যাস-রচনা করবার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর পক্ষে এইধরণের ত্রুটি মার্জনীয়। ঊনিশ শতকে রচিত বাংলা গদ্যসাহিত্যে যেমন প্যারীচাঁদ, কাব্যে তেমনি বিহারীলাল চক্রবর্তী প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে— অনেক জায়গায় তদ্ভব, দেশী বা বিদেশী শব্দের মধ্যে যেমন ভাব-প্রকাশের শক্তি নিহিত রয়েছে, তৎসম শব্দে তেমন কিছু নেই। কাব্যে প্রচুর ধ্বন্যাত্বক শব্দ ও বিশিষ্টার্থক চলতি শব্দের প্রয়োগ করে বিহারীলালও অনেকাংশে প্যারীচাঁদের মতোই দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।
অতীতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্যারীচাঁদ মিত্রের গদ্যভঙ্গির দোষগুণ সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করেছিলেন। সমকালীন প্রাচীনপন্থী পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন প্যারীচাঁদের আলালী ভাষার নিন্দা করলেও, রাজনারায়ণ বসু ও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিন্তু তাঁর গ্রন্থটির প্রশংসা করেছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থের ভূমিকা অংশে দেখা যায় যে, সেযুগের পাশ্চাত্য পণ্ডিত জন বীমসও প্যারীচাঁদের গ্রন্থটির বহু গুণের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
বাস্তবে প্যারীচাঁদ তাঁর গ্রন্থে প্রচুর ফারসি ও আরবি শব্দের সঙ্গে ধ্বন্যাত্মক শব্দ ও প্রবাদ বাক্যের প্রয়োগ করে চলিত ভাষার শক্তিকে প্রমাণিত করেছিলেন। যেমন—
“ক্রমে ক্রমে পাড়ার যত হতভাগ্য লক্ষ্মীছাড়া ঊনপাঁজুরে বরাখুরে ছোঁড়ারা জুটিতে আরম্ভ হইল।” (আলালের ঘরের দুলাল, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংস্করণ, পৃ- ১৩)
বাংলা প্রবাদ বাক্যের প্রয়োগ বিষয়ে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকে আরও কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ—
অরণ্যে রোদন করা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, গোকুলের ষাঁড়, কাঁচা কড়ি, চাড় পড়িলেই ফিকির বেরোয়, পাকা ধানে মই, পেতনীর শ্রাদ্ধে আলেয়া অধ্যক্ষ, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, দেঁতোর হাসি, তেলা মাথায় তেল, তীর্থের কাক, ঢেঁকির কচকচি, ঝোপ বুঝে কোপ, জল উঁচু নীচু, মাণিকজোড়, মরার উপর খাঁড়ারই ঘা, যেমন দেবা তেমনি দেবী, ভিজে বেড়াল, বিড়াল তপস্বী, বুদ্ধির ঢেঁকি, বুড়িতে চতুর কিন্তু কাহনে কাণা, বালির বাঁধ, বাটিতে ঘুঘু চরা, বাঘে গরুতে জল খাওয়া, হাড়ে ভেল্কি হওয়া, সরষের ভিতর ভূত, শিবরাত্রির সলিতা, শাঁকের করাত, চণ্ডীচরণ ঘুটে কুড়ায় রামা চড়ে ঘোড়া— ইত্যাদি।
‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থের পাঠক-পাঠিকামাত্রেই অবগত রয়েছেন যে, মানব-চরিত্র সম্বন্ধে প্যারীচাঁদের প্রচুর অভিজ্ঞতা ছিল। সংসারে যে শুধুমাত্র বরদাবাবুর মত আদর্শ পুরুষই নেই; ঠকচাচা, বাহুল্য ও বাঞ্ছারামের মত শয়তানরাও রয়েছেন, এবং বক্রেশ্বরের মত স্বার্থান্বেষী ও তোষামোদকারী শিক্ষকও রয়েছেন— একথা কিন্তু ভূয়োদর্শী প্যারীচাঁদ বেশ ভালো করেই জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি চরিত্র সৃষ্টিতে তেমন কোন সার্থকতা লাভ করতে পারেননি। ভণ্ড, ধর্মধ্বজী, স্বার্থান্বেষী ঠকচাচার চরিত্রও তিনি পাপের পরিণতি প্রদর্শন করবার জন্যই অঙ্কিত করেছিলেন। তবে আলোচ্য গ্রন্থে প্রাকৃতিক দৃশ্যাদির বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং জায়গায় জায়গায় উপমার প্রয়োগের ব্যাপারেও প্যারীচাঁদ নিজের নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসটি রচনা করবার কারণ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্যারীচাঁদ গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখেছিলেন—
“অন্যান্য পুস্তক অপেক্ষা উপন্যাসাদি পাঠ করিতে প্রায় সকল লোকেরই মনে স্বভাবত অনুরাগ জন্মিয়া থাকে এবং যে স্থলে এতদ্দেশীয় অধিকাংশ লোক কোন পুস্তকাদি পাঠ করিয়া সময় ক্ষেপণ কারতে রত নহে সে স্থলে উক্ত প্রকার গ্রন্থের অধিক আবশ্যক, এতদ্বিবেচনায় এই ক্ষুদ্র পুস্তকখানি রচিত হইল।”
তাঁর এই বক্তব্য থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সেযুগের অধিকসংখ্যক পাঠক-পাঠিকার যাতে কল্যাণ হয়, সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্যারীচাঁদ নিজের গ্রন্থ-রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।
ঊনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদের ব্যবহৃত ভাষার দুটি নমুনা নিম্নরূপ—
(ক) “রবিবারে কুঠীওয়ালারা বড় ঢিলে দেন—হচ্ছে হবে—খাচ্ছি খাব—বলিয়া অনেক বেলায় স্নান আহার করেন। তাহার পরে কেহ বা বড়ে টেপেন—কেহ বা তাস পেটেন—কেহ বা মাছ ধরেন—কেহ বা তবলায় চাঁটি দেন—কেহ বা সেতার লইয়া পিড়িং পিড়িং করেন—কেহ বা শয়নে পদ্মনাভ ভাল বুঝেন—কেহ বা বেড়াতে যান—কেহ বা বহি পড়েন।”
(খ) “বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধে লোকের বড় শ্রদ্ধা জন্মিল না, যেমন গর্জন হইয়াছিল তেমন বর্ষণ হয় নাই। অনেক তেলা মাথায় তেল পড়িল—কিন্তু শুক্রা মাথা বিনা তৈলে ফেটে গেল। অধ্যাপকদিগের তর্ক করাই সার, ইয়ার গোচের বামুনদিগের চৌচাপটে জিত। অধ্যাপকদিগের নানা প্রকার কঠোর অভ্যাস থাকাতে একরোকা স্বভাব জন্মে—তাঁহারা আপন অভিপ্রায় অনুসারে চলেন—সাটে হাঁ না বলেন না। ইয়ার গোচের ব্রাহ্মণেরা সহরঘেসা—বাবুদিগের মন যোগাইয়া কথাবার্তা কহেন—ঝোপ বুঝে কোপ মারেন, তাঁহারা সকল কর্মেই বাওয়াজিকে বাওয়াজি তরকারিকে তরকারি! অতএব তাঁহাদিগের যে সর্ব স্থানে উচ্চ বিদায় হয় তাহাতে আশ্চর্য কি!”
পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে যেসব লেখকরা প্যারীচাঁদের গদ্যভঙ্গীর অনুসরণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কালীপ্রসন্ন সিংহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি প্যারীচাঁদের মত কোন উপন্যাস রচনা না করলেও, নক্সা-অঙ্কনের ব্যাপারে নিজের অদ্ভুত দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তবে কালীপ্রসন্ন অবশ্য তাঁর রচনায় প্যারীচাঁদের মত সাধু ও চলিত ক্রিয়াপদের মিশ্রণ ঘটাননি, এবং উপভাষার প্রয়োগের ব্যাপারে প্যারীচাঁদের থেকেও বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদের সবথেকে বড় কৃতিত্ব হল যে— তিনি চলতি ভাষায় উপন্যাস-রচনায় প্রবৃত্ত না হলে পরবর্তী সময়ে বঙ্কিমচন্দ্ৰ এত সহজে গদ্যরীতির আদর্শটি আবিষ্কার করতে পারতেন না। এপ্রসঙ্গে একথাও উল্লেখােগ্য যে, সজনীকান্ত দাস তাঁর ‘বঙ্কিম-স্মৃতি’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে— বঙ্কিমচন্দ্র সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় যে উপন্যাসটি রচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তাতে কিন্তু প্যারীচাঁদের সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল। কিন্তু এই প্রতিভাশালী লেখক স্বল্পকালের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্যারীচাঁদের ভাষা সর্ববিধ ভাব-প্রকাশের পক্ষে অনুপযোগী, তাই এরপরে তিনি সেই পথে আর বেশি দূর পর্যন্ত অগ্রসর হননি।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments