শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৯ / সালেহা খাতুন
নরেশবাবু যে কতখানি রসিক মানুষ তা এম.এ. পড়ার সময় অতোটা বুঝতে পারিনি। এম. এ. তে তিনি আমাদের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’র মধ্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদ পড়াতেন। তখন ভক্তিকে গদগদ থাকতাম আমরা। মাঝে মাঝে সাংসরিক জীবনযাত্রার কিছু খণ্ড চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরতেন। বিশেষ ভাবে মনে আছে সস্তায় পচা ডিম কিনে কীভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন তিনি, সেই গল্পের কথা। মধ্যবিত্তের দাম্পত্য চিত্রের খুঁটিনাটি অনেক সময় মিলে যায়। এম. ফিল. এর শান্তিনিকেতন যাত্রার নেপথ্যকাহিনি নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে বেশ রসিকতা করেন। তখন সদ্য দাম্পত্যজীবন শুরু হয়েছে আমার। সালাউদ্দিন সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন। নরেশবাবু বললেন তা কী করে হবে? তবুও তিনি যাওয়ার অনুমতি দেন এবং বলেন ছেলেদের সঙ্গে থাকতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অফিস থেকে ছুটি না পাওয়ায় সালাউদ্দিন যেতে পারেন নি। নরেশবাবু মজা করে বলেন ‘বৌ গেলে বৌ পাওয়া যাবে কিন্তু চাকরি গেলে আর চাকরি পাওয়া যাবে না। দেখেছ তোমার থেকে চাকরির দাম বেশি’। এখন ভাবি কতখানি দুঃসাহসী হয়ে সালাউদ্দিনকে শান্তিনিকেতন নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম।
এম. ফিল.-এ আমাদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার সিলেবাস এতো উন্নত এবং বৈজ্ঞানিক ছিল যে একটা সার্বিক জ্ঞান আমাদের হয়ে যায়। পরে অধ্যাপনার ক্ষেত্রে আশু ফললাভ করি। এম. ফিল.-এ নানান অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে থাকি। তুষারবাবু আমাদের একদিন নিয়ে গেলেন এশিয়াটিক সোসাইটিতে। পুথিপত্র, বই ইত্যাদি সংগ্রহ দেখার সাথে সাথে একটি সেমিনারেও আমরা অংশ নিই।
টার্ম পেপার, সেমিনার পেপার, ডিসার্টেশান পেপার তৈরিতে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ পাই অধ্যাপকদের কাছ থেকে। মনে আছে টার্ম পেপারে আমি অন্নদামঙ্গল কাব্য নিয়ে কাজ করেছিলাম। সেমিনার পেপার তৈরি করেছিলাম নজরুলের কবিতার রাজনৈতিক চেতনা প্রসঙ্গে। সেমিনার পেপারের ভাইভা নিয়েছিলেন অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার মজুমদার। তাঁর সমস্ত প্রশ্নের খুব ভালো উত্তর দিয়েছিলাম বলে তিনি আমার বেশ প্রশংসা করেন। সিনিয়ররা আমাদের বলেছিলেন উজ্জ্বলবাবুর গলা তাঁরা ক্লাসে খুব একটা ভালো শুনতে পান না। কিন্তু এম.এ. এর উপন্যাস ও ছোটোগল্প স্পেশাল পেপারের ক্লাসে এবং এম. ফিল. এর ক্লাসেও আমরা উজ্জ্বলবাবুর ক্লাস করে খুব সমৃদ্ধ হতাম। উজ্জ্বলবাবুর সঙ্গে পরে আবার একবার ইন্টারভিউ টেবিলে দেখা হয়। সেটা দুহাজার একের বিশে এপ্রিল, পি এস সির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে। সেদিন বাখতিন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আর স্যার একটা সদুপদেশ দিয়েছিলেন যে মেয়েদের জন্য পি এস সির চাকরি ভালো নয়। পাঁচ বছর অন্তর বদলির ধকল নেওয়া কঠিন। দুহাজার তিন সালে দাঁতন কলেজের এক সেমিনারে স্যারের সঙ্গে শেষ দেখা হয়। সস্ত্রীক কলকাতা ফেরার পথে তিনি আমাকে খড়্গপুর পৌঁছে দেন।
ডিসার্টেশান পেপারে আমি পুথি নিয়ে কাজ করি। এবিষযে গাইড করবেন কে? আমার স্যার শ্যামল সেনগুপ্ত বললেন, ‘তুমি নির্মলের কাছে কাজ করো। মধ্যযুগের কাব্যপাঠের এক অসামান্য নির্দেশক ও’। নির্মল অর্থাৎ ড. নির্মল দাশ। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক তিনি। তিনি বললেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেম্বার হয়ে যাও। চিঠি লিখে দিলেন তৎকালীন লাইব্রেরিয়ান অরুণা চট্টোপাধ্যায়কে। যাতে আমাকে পুথি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়। গরমের দিনে কোনো প্রকার পাখা না চালিয়ে পুথি পাঠ করতাম। ধর্মমঙ্গল কাব্যের চব্বিশটি বিভিন্ন পালা – স্থাপনা পালা,ঢেকুর পালা,রঞ্জাবতীর বিবাহ পালা প্রভৃতি থেকে বেছে দিলেন সীতারাম দাসের ধর্মমঙ্গলের হস্তীবধ পালাটিকে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ৫৩৩ সংখ্যক পুথিটি নিয়ে কাজ শুরু করি। অজস্র পুথি চাক্ষুষ করি। বিশ্বভারতীতে রক্ষিত পুথি, এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত পুথির সম্ভার প্রত্যক্ষ করি।
তবে আদর্শ পাঠ নেওয়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুথি দেখতে গিয়ে চরম সমস্যার সম্মুখীন হই। তখন যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিশালার রক্ষনাবেক্ষণ করছেন তিনি সারাদিন বসিয়ে রাখেন। বিকেলে তাঁর ঘরে যখন ডাকলেন প্রথমেই প্রচণ্ড বকুনি দিলেন,আমার হাতে বিভিন্ন পুথিশালার পুথির তালিকা সমন্বিত একটি রেজিস্টার সদৃশ খাতা দেখে। বললেন এটি তুমি কোথায় পেলে? কে দিল? তিনি ভেবেছিলেন এটি তাঁর সংগ্রহশালার রেজিস্টার। কিন্তু ওটি আমার নিজস্ব ছিল। রেজিস্টার সদৃশ খাতাটি আমাকে সালাউদ্দিন দিয়েছিলেন গবেষণার কাজে লাগানোর জন্য। বিভিন্ন পুথিশালার পুথির তালিকা আমি ঐ খাতায় লিখে রেখেছিলাম। যাই হোক আমার কাজ ও পরিশ্রম দেখে তিনি প্রীত হলেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিশালার পুথি ব্যবহার করতে দিলেন। সীতারাম দাসের ধর্মমঙ্গলের অন্যান্য কয়েকটি পালা ওখানে পেলাম ঠিকই কিন্তু হস্তীবধ পালা না পাওয়ায় আদর্শ পাঠ নিতে পারলাম না।
নির্মলবাবু খুব যত্ন নিয়ে আমার গবেষণার কাজে সাহায্য করেন। তিনি শনিবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। সেদিন ছাড়া অন্য কোনো দিন হলে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হতো তাঁর পরামর্শ নিতে বা লেখা দেখাতে। একবার প্রচণ্ড দুর্যোগে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারিনি কিন্তু তিনি আমার জন্য বসে আছেন। অন্যরা স্যারকে চলে যেতে বললেও স্যারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমি যেভাবেই হোক তাঁর কাছে পৌঁছবো। এক একটা বাস ধরে একটু একটু করে এগিয়ে প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে রবীন্দ্রভারতীর বি টি রোড ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেখি স্যার বসে আছেন। তিনি বললেন 'আমি জানতাম তুমি আসবেই'। পরে জেনেছি আমাকে কাজ করিয়ে স্যার খুশি হয়েছিলেন।
সৌভাগ্যক্রমে তিনি আমার পি এইচ ডির থিসিসেরও পরীক্ষক ছিলেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
এম. ফিল. - এ পুথি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুব হ্যাপা পোহাতে হয়। নির্মলবাবু বলেন পুথির দু-এক পৃষ্ঠার আলোকচিত্র দিতে। তখন স্মার্ট ফোন ছিল না আর আমরাও এতোটা স্মার্ট ছিলাম না। তার উপর পুথি জেরক্স করা যাবে না। মড়মড়ে পাতাগুলো হাতে নিলেই গুঁড়িয়ে যায়। জেরক্স মেশিনে তোলা তো দুষ্কর ব্যাপার। বাবা ব্যবস্থা করে দিলেন। এক স্টুডিওর ফোটোগ্রাফারকে সমস্ত খরচ দিয়ে পাঠালেন। লাইব্রেরিয়ানের অনুমতি নিয়ে টাকা জমা দিয়ে তবেই পুথিটির দুটি পৃষ্ঠার আলোকচিত্র নেওয়া সম্ভব হয় । তখন কম্পিউটারে টাইপের অতোটা চল ছিল না। টাইপরাইটারেই টাইপ করাতে হতো। সূর্য সেন স্ট্রিটে টাইপ করাই। বন্ধুদের মধ্যে অলোকই মনে হয় একমাত্র যে কম্পিউটারে টাইপ করেছিল। আমার ডিসার্টেশান পেপারটি বাঁধাই করে দেন প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের লাইব্রেরির এক স্টাফ। তিনি নলপুরে থাকতেন। তাঁর বাড়িতে গিয়ে বাঁধাই করে আনি। আর আমাদের বাপ্পাদার ( অধ্যাপক নীলাঞ্জন সেনগুপ্ত) সুন্দর হাতের লেখায় ডিসার্টেশান পেপারের টাইটেল পেজটি সজ্জিত করি। বাপ্পাদাকে বহুদিন ভাইফোঁটা দিয়েছি। বাপ্পাদা আমার স্যার শ্যামল সেনগুপ্তের ভাইপো এবং আমার বন্ধু বিশাখার স্বামী। অর্থনীতির অধ্যাপক। অগ্রজের মতোই তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ গ্রহণ করেছি।
ভোরের শান্তিনিকেতনে প্রভাসদা ও নরেশবাবুসহ আমরা বন্ধুরা
এম. ফিল.- এর লিখিত পরীক্ষাগুলি শ্যামনগর থেকেই দিই। কোয়ার্টারে নিরুপদ্রবে পড়াশোনা করা যায়। কিন্তু স্টাডি লিভে থেকে বার এবং তারিখ গুলিয়ে যেতে থাকে।পাশের কোয়ার্টারে গিয়ে জেনে এসেছি আজ কী বার এবং কত তারিখ ইত্যাদি। কোথায় পরীক্ষার দিন ঠিকঠাক পৌঁছতে পারবো না। কেননা বারকয়েক হয়েছে সালাউদ্দিন যেদিন ছুটি সেদিন কাজে গেছেন আর কাজের দিন ছুটি ভেবে ঘরে বসে থেকেছেন। তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়েই দিন কেটে যেতো। রাত বারোটাতেও ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গেছে সালাউদ্দিনকে। কোনো স্টাফ হয়তো আসেনি, সেই জায়গায় ডিউটি করতে। অথচ উনি ফিরেছেন রাত দশটা পর্যন্ত ডিউটি করে। কোয়ার্টারে পুরো গরু ছাগলের মতোই যেন পুষে রাখতো। ব্যক্তিগত জীবন বলে সেখানে কিছু নেই। শুধু ইন্ডাস্ট্রিতেই নয় পরে কলেজের কোয়ার্টারে থেকেও দেখেছি সেখানে পার্সোনাল লাইফ বলে কিছু ছিল না। অন্যের আজ্ঞা পূরণে সর্বদা তটস্থ থাকতে হয়েছে।
এম. ফিল. – এর পরীক্ষার সময় অবশ্য সালাউদ্দিন আমাকে রান্না করে খাইয়েছেন। তবে নিরামিষ। উনি আমিষ বানাতে পারেন না। শ্যামনগরের দিনগুলো আসলে পিকনিকের মতোই কাটতো। এক ছাব্বিশে জানুয়ারিতে হালিশহরে দুজন মিলে চলে যাই রামপ্রসাদের জন্মভিটেতে। অন্নকুট উৎসবে যোগ দিই। বিভিন্ন কিংবদন্তি, গল্প শুনি। শ্যামনগরের কাছাকাছি এক কালীমন্দিরে প্রতিমার পাশ ফেরানো মূর্তি দেখি। প্রচলিত একটি কাহিনি শুনি যে রামপ্রসাদ যখন গঙ্গাবক্ষে নৌকা করে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন তখন মা নিজেই মুখ ঘুরিয়ে কান পেতে তাঁর গান শুনতে থাকেন।
1 Comments
আমিষের চেয়ে নিরামিষ তৈরি অনেক কঠিন
ReplyDelete