শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৭ / সালেহা খাতুন
‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’- এ প্রবাদ আমার জীবনে সত্য হয়েছে। ছোটোবেলায় সব সময় ওড়ার স্বপ্ন দেখতাম। উড়ে উড়ে এ ছাদ থেকে ও ছাদে গিয়ে বসতাম। আর বাস্তবেও বহুবার ছাদ বদলে বদলে গেছে। আর জুট ইন্ডাস্ট্রির কোয়ার্টারের জীবনে এই বদল অহরহ ঘটতে দেখতাম। যখনি কোনো নতুন পরিবার আসতো একটা বড়ো ট্রাকে বা ম্যাটাডোরে সারা সংসারের জিনিস নিয়ে তাঁরা চলে আসতেন। একবার একটা পরিবার তাঁদের পোষা গরুও নিয়ে আসেন। গৌরীশঙ্কর জুটমিলের গৌতম মুখার্জিদা এ প্রসঙ্গে মজা করে বলতেন, ‘এক একটা সার্কাস কোম্পানি আসছে’। জুট ইন্ডাস্ট্রির কোয়ার্টার এরিয়াগুলি ছিল মিনি ভারতবর্ষ। কেননা সেখানে ভারতবর্ষের প্রায় সব প্রদেশের মানুষজনের দেখা মিলতো। আর আমার সম্পদ বেড়ে উঠতো। মানুষই আমার সম্পদ। এ সম্পদ জমানোর নেশাতেই আমার জীবন কাটছে।
কতকগুলি ছোটো ছোটো শিশু ছিল আমার খুব ভক্ত। ওরা চলে আসতো গল্প করতে। একটি পাকাবুড়ি ছিল দলে, আমাকে প্রশ্ন করতো; ‘ আন্টি আপ স্কুল মে পড়াতে হ্যায় কেয়া?’ সে বাংলা ভাষা বুঝতে পারে। আমি বাংলাতেই তার সঙ্গে কথা বলতাম। জিজ্ঞেস করলাম কী করে জানলে? বললো আমি জানি, ‘মিস রা এমনই দেখতে হয়’। একসঙ্গে অনেকগুলো ভাষায় ওরা পারদর্শী হয়ে উঠেছে পরিবেশের কারণে। পিয়াংশী নামে আর একটি বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে ওর বাবা মা ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায়। স্কুলে ভর্তি নেওয়ার সময় বাচ্চাদেরও ইন্টারভিউ দিতে হতো। ওকে আদর করে ম্যাডামরা গায়ে হাত দিয়ে কথা বলায় বলে, ‘ মুঝে হাত মত লাগাও’।
আর যে ক্ষুদেটি আমার কোয়ার্টারের সব থেকে কাছে থাকতো সে বাপী। একেবারে পাশাপাশি আমরা থাকতাম। ওর মা-বাবা আমার কাকলিদি এবং উত্তমদা। সিঁড়িতে বসে কাকলিদির সাথে গল্প হতো। বাপীকে ছড়া শেখাতাম। আমার সাজগোজের কোনো জিনিস ছিল না তখন। অথচ ড্রেসিং টেবিল মাঝে মাঝেই ভরে যেতো। বাপী তার মায়ের মেকআপের সব জিনিসপত্র আমার ড্রেসিং টেবিলে এনে সাজিয়ে দিতো। সালেহা নামটা ওর উচ্চারণে সালহামে রূপ নিতো। আমাকে এতোই ভালোবাসতো যে দুটো ডিমের ঝোল দেখে বলতো, ‘আন্টি তুই দুটো ডিমই খেয়ে নিবি, কাকুকে পেঁয়াজ দিয়ে ভাত দিবি’। আরো বলতো, ‘তুই বাসন মাজবি না, কাকুকে দিয়ে বাসন মাজাবি’।
বাপী তো আর জানে না আন্টি বাজার করা থেকে শুরু করে রান্না করা সমস্ত কাজ নিজে হাতে করে। তার উপর আছে পড়া এবং পড়ানো।
🍂
আরও পড়ুন 👇
জুটমিলে ডেজিগনেশন অনুযায়ী কোয়ার্টারের সাজসজ্জা এবং আকার হয়। ম্যানেজার পদে যাঁরা থাকতেন তাঁদের কোয়ার্টার বাংলোর মতো হতো। এরপর পদ অনুযায়ী সাজসজ্জা হতো। তবে সবগুলিই ফার্নিশড হতো। আলো জলের চব্বিশঘন্টা ব্যবস্থা। অতএব এম. ফিল. এর পড়াশোনা আর কেরোসিনের আলোয় করতে হলো না। তবে রান্না আমাকে কেরোসিনের স্টোভেই করতে হয়েছে। তখন আবার নীল আর সাদা কেরোসিন দুটোই পাওয়া যেতো। একবার ভুল করে নীল কেরোসিন আনায় সালাউদ্দিন আমায় রাতেই আবার দোকানে পাঠান কেরোসিন ফেরত দিতে। বয়স্ক দোকানদার বলেন, ‘ মা তুই কেন এলি? আমি কাল সকালেও ফেরত নিতাম’। বোধের কত তফাত ! তখন তো দুচোখে ঠুলি পরে আছি।
সেই ছোট্ট বাপী আজ অনেক বড়ো হয়ে গেছে।
এম. ফিল.- এর ক্লাস করে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে এসে শ্যামনগর স্টেশনে নেমে বিকেলে বাজার করে ফিরতাম। কখনো কখনো বাজার ঠিকঠাক বসার আগেই পৌঁছে যেতাম। বাজারের লোকজনের খুব সমস্যা হতো। কেননা তখন ওঁরা বেগুন পটল ইত্যাদি সব আলাদা আলাদা রঙের তরলে ডোবানোর কাজে ব্যস্ত। আমাকে নদীর ধারে অপেক্ষা করতে বলতেন ওঁরা। বাজার করতে আজো ভালো লাগে। বাজারের গল্পে পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুলতে পারি আমি। কোথায় কোথায় না বাজার করেছি!এখনও কলেজের ব্যাগে সব সময়ই একটা দুটো এক্সট্রা ব্যাগ থাকে। ঝাঁপিয়ে পড়ি বাজারে। ট্রেনের লেডিস কম্পার্টমেন্ট থেকেও বাজার করি।
আমার এক কলিগ যিনি মিউনিসিপ্যালিটির একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও ছিলেন তিনি একবার আমায় বলেন তাঁদের বাড়ির মেয়েরা বাজারে যায় না, ওটা পুরুষদেরই কাজ। তসলিমার লেখাতেও দেখেছি যে মেয়েরা বাজার করছে বলে নিজেদের স্বাধীন ভাবে তাদের তিনি স্বামীর বিনাপয়সার চাকরই বলেছেন। তাই- ই হবে হয়তো। নাহলে এম. ফিল. এর এক্সকার্শনে যখন শান্তিনিকেতন যাই তখন তিনি কেন বললেন যে, 'আমাকে রান্নার লোক দিয়ে যেতে হবে'।
যাক গে সে কথা! আমার আছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন জীবনটা আসলে লীলা। এর সুখ দুঃখ সব আছে। সংগ্রাম বললে পুরোটা বোঝানো যায় না। ফেরা যাক পড়াশোনায়। তখন এম. ফিল. – এর বন্ধুরূপে পেলাম বিতান, পারমিতা, নমনা, অলোক, শান্তনু, সুধাংশু, আশুতোষ, মিঠু, ইন্দ্রাণী, শুক্লাদি, নীলাঞ্জনা আরো অনেককে। এম. ফিল. পড়াকালীন নীলাঞ্জনার মাতৃবিয়োগ হয়। ফলে ও শান্তিনিকেতন যেতে পারে নি। কিন্তু আমাদের সবার অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেকটা পূর্ণ হয়।
0 Comments