জ্বলদর্চি

মানস কুমার চিনি (কবি, খড়গপুর)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১৩
মানস কুমার চিনি (কবি, খড়গপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

বাস্তবিকই সেটা ছিল একটা কবিতার বাগান। রেলশহর খড়গপুরের বুকে যেন একখণ্ড 'কবিতার নার্সারি'। বলা যেতে পারে, কবিদের আড্ডাঘর। দক্ষিণ পূর্ব রেলের প্রাক্তন করণিক তথা কবি মানস কুমার চিনি একসময় তাঁর বসতবাটিতেই বানিয়েছিলেন 'লিটল ম্যাগের কবিতার বাগান'। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনের নিরাপদ আস্তানা ছিল একসময়। অন্যান্য ভাষার পত্রিকাতেও ছিল ঠাসা। সেই কবিতার বাগান আজ নিঃস্ব, রিক্ত, শুষ্ক এবং দীর্ণ। 

মানস কুমার চিনি সরকারি নথি অনুযায়ী ১৯৬৫ র ২৫ শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভগবানপুরের কলাবেড়িয়া গ্রামে। তবে তিনি নিজে দাবি করেন, তাঁর জন্ম ১৯৬৩ এর ২৪ শে অক্টোবর। বাবা ছিলেন বলাইলাল চিনি এবং মা ঊষারাণী চিনি। তবে পরবর্তীতে শৈশবকাল কেটেছে হাওড়ার নলপুরে। এরপর বাল্যকাল এবং কৈশোরকাল কেটেছে মেছেদাতে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবিতা যাপন শুরু। সেসময় গ্রামের এবং স্কুলের লাইব্রেরী থেকে কবিতার বই নিয়ে কবিতার লাইনেই বুঁদ হয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। সেই সময় থেকেই কবি জীবনানন্দ দাশকে ভাল লাগতো তাঁর। সেই ভালোলাগা আজও তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। 

রেলশহর খড়গপুরে চাকরি করার দরুন রেলস্টেশনের দক্ষিণে বাবুলাইনের রেল কোয়ার্টারে কেটেছে কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়। এখানে বসেই তাঁর কবিতা যাপন। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালা। আর মনিশঙ্করি বুকস্টল তাঁর কবিতার আড্ডাঘর। ২০১০ থেকে খড়গপুর ছেড়ে এখন তিনি কলকাতাবাসী। কবির অনুভবে 'একক ছিন্নমূল শরনার্থী জীবন'। 
"চিবুকের দাগে যে ছবি চেনা যায়
সে ছবি তোমার।
যতবার তাপে পুড়ে যাই 
প্রথম জীবন আয়নায় মুখ দেখে 
নিজেকে লুকোয়। 
যতবার প্রেম আসে 
সঞ্চারিত করে ভীতি 
আমিই মেনেছি 
সংযমের ভাষা, তুমি দ্বিতীয় প্রহর"। (অপেক্ষা) 
হলদিয়া কবিতা উৎসবে

১৯৮৮ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর থেকে পথচলা খড়গপুরে। কবি হওয়ার জন্যেই তাঁর লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি প্রেম যেন একটু বেশিই ছিল। সেইসব ম্যাগাজিনগুলো যাতে না হারিয়ে যায়, তার জন্য তিনি বানিয়েছিলেন এই সংগ্রহশালা। একটা শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন সেইসব পত্র পত্রিকার সঙ্গে --
"গর্ভধারণের কালে তোমাকে
খোলস ছাড়ানো সাপ মনে হয়
স্পর্শহীন রাতগুলো
রক্তের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে শারীরিক গন্ধ।
উন্মাদনায় করতলে ধ্বনি শোনে"! (শারীরিক) 

শুধুমাত্র পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের ২০০০ টির বেশি সংখ্যা ছিল তাঁর জিম্মায়। রাজ্যের অন্যান্য এলাকা থেকে প্রকাশিত পত্র পত্রিকার প্রায় তিন হাজার সংখ্যাও রেখেছিলেন নিজের ঘেরাটোপে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃত্তিবাস, জগদীশ ভট্টাচার্যের কবি ও কবিতা, বিমল করের গল্পপত্র, অরুণ ভট্টাচার্যের উত্তরসুরি, তুষার চৌধুরীর কবিতা দর্পণ, শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কালি ও কলম, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাপ্তাহিক বাংলা কবিতা, রঞ্জন কুমার দাশের শনিবারের চিঠি, কুমারেশ ঘোষের যষ্টিমধু, সুশীল রায়ের ধ্রুপদী পত্রিকাগুলি তিনি রেখেছিলেন তাঁর খড়গপুরের কোয়ার্টারে। 
কবির সঙ্গে লেখক

এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের নামকরা লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ করেছিলেন সেসময়। যা বহু গবেষকদের কাজে লাগতো। কোরক, সমতট, ধ্রুবপদ, এক্ষন, নাট্য একাডেমি পত্রিকা, বাংলা একাডেমী পত্রিকা, বিজ্ঞাপন পর্ব, বর্ত্তিকা, কবিপত্র ইত্যাদি। লোকসংস্কৃতি, লোককথা এবং উপকথা বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন তিনি রেখেছিলেন যত্ন সহকারে। মূলতঃ লিটল ম্যাগাজিনের প্রচার ও প্রসার ঘটানোর জন্য এই সংগ্রহশালার কাজ করেছিলেন তিনি। শুধু লোকসংস্কৃতি সংগ্রহ নয়, তাঁর কবিতার কঙ্কালেও ঠাঁই পেয়েছে মেদিনীপুরের নির্যাস। লালমাটি, বুনো ঘাস, শাল মহুল আর টুসু ভাদু ঝুমুর গান যেন অনুরণিত হয় তাঁর লেখনিতে --
"এই সব গ্রামের ভেতর
বেঁচে থাকবে পাতার উৎসব
শালপাতার ঠোঙায় পড়বে
তোমার জীবনের আলো
নেমে আসা হিম অন্ধকারে
শিশিরের ধ্বনি, তীর ও ধনুকে
তোমাদের খাদ্য আজ গেঁথে যায়
চুল বেঁধে তুমি গাইছো ভাদু গান"। (মকর) 

তাঁর এই সংগ্রহশালা থেকে কাজ হয়েছে 'সান্বয়' নামে একটি পত্রিকার তিনটি সংখ্যা। ১৯৯০, ১৯৯১ এবং ১৯৯২ তে প্রকাশিত হয় সেগুলো। ১৯৮৮ থেকে তিনি প্রকাশ করতেন নিজস্ব লিটল ম্যাগাজিন 'কবিতা মোনালিসা'। যদিও তা ২০০০ সাল থেকে বন্ধ হয়ে যায়। 
মেদিনীপুরের কবিদের প্রকাশিত বইপত্র তিনি সংগ্রহে রাখতেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তাঁর এই কবিতার বাগানে এসেছেন ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক, তমালিকা পণ্ডাশেঠ, অনুত্তম ভট্টাচার্য, সন্দীপ দত্ত, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, অংশুমান কর, প্রভাত মিশ্র, অনিল ঘড়াই প্রমুখ বিদগ্ধজনেরা। 

মেদিনীপুরের বুকে বসে লিটল ম্যাগাজিনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে সাংসারিক জীবনে অনেক কিছু হারাতে হয়েছে তাঁকে। বেঁচে থেকেও প্রতিনিয়ত দেখতে পান আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে গাছেদের পাতার ফাঁকে। আর শুকনো পাতাগুলো হারাতে বসেছে নিজেদের অবয়ব। 
"শুকনো পাতার উৎসব 
নিচে জ্বলছে হাড় ও আগুন
খসে পড়ছে শীতের শাঁস
গাছে গাছে নেমে আসা চাঁদ 
ফিরে আসে আবাদের দেশে 
নিঝুম পাহাড়ের কোলে রাত্রি নেমেছে 
বুনে দেবে ঝিনুকের মতো ঢেউ"। (ঢেউ) 

আজ সেই সংগ্রহশালা নেই। সেই রেল কোয়ার্টার আজ আর 'কবিতার বাগান' বলে দাবি করে না। সেখানে থাকা সব সম্ভার বিলিয়ে দিয়েছেন অন্যদের। আজ তিনি ঝোলা কাঁধে বোহেমিয়ান কবি। চরম অসুস্থ হয়ে শিয়ালদহের বি আর সিং হাসপাতালে বন্দী। কবিতার কথা নয়, এই হাসপাতাল থেকে মুক্তির আর্তনাদ এখন তাঁর কন্ঠে --
"আমার যন্ত্রণায় জেগে থাকে 
তোমার সহস্র স্বপ্ন
কখনও কান্না হয়ে ফোটে 
ভাতের থালায়।
বাঁচার শর্ত ছিল ধানের গোলায় 
যখন ঘাম হয়ে রক্ত ঝরে পড়ে 
নিজের মুখ আয়নায় চিনতে পারি না
তোমার মোবাইলে তখন 
কত ইচ্ছে ডানা মেলে"। (রঙিন ডানা) 

কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হল নোনাবালি (১৯৯০), স্রোতের ছায়া (১৯৯৩), নতজানু চিররাত্রি  (১৯৯৪), জার্নাল (১৯৯৫), পাখিদের জন্য আয়না (১৯৯৬), ঘুম রোগের খাদ্যতালিকা (১৯৯৭), ঢেউ সমগ্র (২০০০), একক সঙ্গীত সন্ধ্যায় (২০০৫), স্বপ্নের পুনর্বাসন (২০০৬), শারীরিক সংকীর্তন (২০০৭), শরনার্থী শিবিরে কীর্তনীয়া (২০০৮), অক্ষরের জাদুবিদ্যা (২০০৯), পোড়া শরীরের মায়া (২০১০), ফকিরের দোতারা (২০১), পাণ্ডুলিপি রক্ত হয়ে আছে (২০১০), দেখে এলাম কারিগরের হাট (২০১৩), স্বপ্নলেখার কবিতা (২০১৩), রেলব্রিজে সন্ধ্যা (২০১৪), পথের পুরোনো ধুলো (২০১৪), সন্ন্যাসীর স্তব (২০১৪), হলুদ তুলোট পাতা (২০১৪), পটুয়াপাড়ার ঈশ্বর (২০১৫), পালকি চড়ে পরি (২০১৫), রেশমাকে লেখা কবিতা (২০১৫), রেশমা এবার পরচুলা খুলে রাখি (২০১৬), ছায়া বনে বনে (২০১৭), কি কথা তাহার সাথে (১৪২৪), অজ্ঞাতবাস কবিতাগুচ্ছ (২০১৭), ধ্বংসস্তূপের স্মৃতি (২০১৮), স্তব্ধ আলো, নিকটে এসো (২০১৮), স্বপ্নপূরাণ (২০১৯), আত্মরক্ষার অস্ত্র রেখেছি খামারে (২০১৯), পথের শেষে দেখি (২০১৯), বিষন্ন প্রেমিকার বেহালা (২০২০), ছায়াযুদ্ধ (২০২০), ছিন্ন পদাবলি (২০২২), আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন (২০২২) এবং আরও। 

রেলস্টেশনের অবিশ্রান্ত শব্দ আর খড়গপুরের লাল ল্যাটেরাইট মাটি তাঁর কবিতার চাষকে বিঘ্নিত করতে পারেনি প্রথমে। তিনি অপেক্ষা করে গিয়েছেন এমন একটা ট্রেনের জন্য, যে ট্রেনটা তাঁর জীবনের স্তব্ধতাকে জ্যোৎস্নার আলোয় স্বপ্ন মেদুর করে তুলবে। তাই তিনি উচ্চারণ করেন --
"রেলব্রিজে জ্যোৎস্না এসে পড়ে। 
অবিরাম পক্ষিগুচ্ছ ওড়ে আর 
গাছের প্রবাদগুলো স্পর্শ করে 
দূর থেকে শোনা যায় 
অলীক পেঁচার ডাক কর্কশ নিষ্ঠুর 
তাহাদের পাঁজরে দেবতার অনন্ত মুখ -
স্টেশনের পাশে ভাঙা স্কুলঘর 
শুধু বালক বয়স জলে নেমে 
শাপলা তোলে, বন ডুমুরের গন্ধ 
সকালবেলায় মেঠোপথ জেগে ওঠে,
তুমি শূন্যতা জড়িয়ে কুরচি ফুলের 
কাছে এলে, দেখো সাঁকোর মুখে অন্ধকার 
একটি ট্রেনের অপেক্ষায় সারা জীবন 
আলোর বিছানায় শুয়ে কাঁপছে হৃদয় 
তবু তুমি পিপাসার গাঢ় রৌদ্রে একঝাঁক হরিণ
কোথা থেকে ভেসে আসে হুইসেল 
মহাশূন্যের চাঁদ শুধু মাটিতে আঁচড় দিচ্ছে 
ধোঁয়া উঠছে স্তব্ধতার চারপাশে"। (স্তব্ধ জ্যোৎস্নায় এসেছি) 

কবি মানস কুমার চিনির কবিতা আঁকার ক্যানভাস রছলশহর খড়গপুরও তাঁকে আজ স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারেনি নিজের কোলে। ছেড়ে দিয়েছে বেদনার সঙ্গী হয়ে। আজ তাই বোহেমিয়ান জীবন নিয়ে তাঁর জীবন্মৃত বেঁচে থাকা। যে কবিতার অঙ্কুরোদগম হয়েছিল সাদা পাতায় কালো অক্ষরে, সেই কবিতার যাবতীয় স্বপ্ন জেগে থাকে পুতিগন্ধময় লাশকাটা ঘরে। যেখানে সবই মৃত, গলিত! শুধুমাত্র লাশকাটা ডোমেরাই জীবিত। অথচ আজ তাঁর মনে সুখ নেই কবিতা লেখার --
"আজ এক গ্রহে মানুষের মুখ 
সে দ্রবীভূত হয়েছে মৃত্যুমুখী 
শরীর ধ্বংস করে আকাশ ছুঁয়েছে যারা 
রক্তাক্ত পথ পেরিয়েছে তারা।
ফুলের জন্য রাত জাগে বাগান 
চারপাশে পাখিদের ঘ্রাণ চকচকে 
বাতাসে যে মেঘকণা শুয়ে আছে 
প্রেম শব্দ, স্রোতের কেশর।
বৃষ্টি নামলে ছায়া ভিজে যায় 
সে লুপ্ত মায়া জলের ভেতর স্থির 
শূন্যতার টানে শরীর জেগে থাকে 
সে প্রতিকৃতি অলীক বন্দরের তীর"। (টেরাকোটা পদাবলী)

🍂

Post a Comment

0 Comments