জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৩/বিজন সাহা

বুদ্ধ শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবন

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৩

বিজন সাহা 

এলিস্তার বৌদ্ধ বিহারে 

এলিস্তা অনন্য তার ভিন্ন রকমের গঠনশৈলীর জন্য। আর এটা প্রায় পুরোটাই জড়িত বৌদ্ধ সংস্কৃতির সাথে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে তার ছোঁয়া সর্বত্র। তবে সেখানে যে কালমিকির মরুভূমির ছাপ নেই তাও কিন্তু নয়। যার ফলে দীর্ঘ ৪০ বছর ইউরোপিয়ান স্থাপনা দেখে অভ্যস্ত চোখ প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায় না রাশিয়ায় এমনটি সম্ভব। তবে এটাও সত্য – এসব মূলত নতুন রাশিয়ায় তৈরি। সোভিয়েত আমলে এ ধরণের স্থাপনার কথা কল্পনার বাইরে ছিল। 

পরের দিন শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখেই আমরা সময় কাটাবো বলে ঠিক করলাম। এখন আর ভোলগা তীরের বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নেবার তাড়া নেই। শুধুই মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটানো। বাড়ি ফেরার মেজাজ সবার মধ্যে। রিল্যাক্স! আমরা প্রথমেই গেলাম আলতন সুমে বা বুদ্ধ শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবনে। এটা কালমিকি তো  বটেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় প্যাগোডার একটি। এই প্যাগোডার উচ্চতা ৬৩ মিটার যার ভেতরে রয়েছে ৯ মিটার উঁচু বুদ্ধের মূর্তি। এটা রাশিয়া ও ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি। ইউরোপের সবচেয়ে বড় বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে কালমিকির অন্য এক শহর লাগানে। লেনিন স্ট্রীটের পুরানো সিমেন্ট কারখানার স্থানে এই প্যাগোডা তৈরি করা হয়। তিব্বত, মঙ্গোল ও রুশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আধ্যাত্মিক গুরু চতুর্দশ দালাই লামার উপস্থিতিতে ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। স্থপতি কুরনিয়েভ, গিলিয়ান্দিকভ ও আমনিনভের প্রচেষ্টায় মাত্র ৯ মাসে এই এর কাজ সম্পন্ন হয়। জুল নামক কালমিক জাতীয় উৎসব ও ১৯৪৩ সালে কালমিকদের সাইবেরিয়া ও দূরপ্রাচ্যে নির্বাসনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ২০০৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর এই ভবনের উদ্বোধন করা হয়। কালমিকির বৌদ্ধ গুরুদের পাশাপাশি তিভা ও বুরিয়াতির বৌদ্ধ গুরুরাও এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। ছিলেন নেপালের রাষ্ট্রদূত এবং ভারত, জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের অতিথিবৃন্দ। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তু নেপালে অবস্থিত বলেই মনে হয় নেপালের রাষ্ট্রদূতের আগমন।

ভগবানের কাছে চিরকুট

বুদ্ধ শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবন এলিস্তার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এই ভবনের পরিসীমা বরাবর লোহার শিকের তৈরি বেড়ায় প্রতি পাঁচ মিটার অন্তর অন্তর রয়েছে সর্ব সাকুল্যে ১০৮ টি বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্থাপনা শ্বেতশুভ্র স্তূপ। এই কমপ্লেক্সে প্রবেশের প্রধান ফটক দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। ভবনের চতুর্দিকে রয়েছে মোট চারটি প্রবেশ দ্বার। মঠটির পুরো স্থাপত্য পরিকল্পনাটি একটি মন্ডলের আকারে করা। মূল ভবনটিকে ঘিরে আছে ১৭ টি প্যাগোডা যার প্রতিটিতে বসে আছেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন মহান বৌদ্ধ গুরু। অবশ্যই তাঁদের মূর্তি। সেখানে লেখা আছে তাঁদের বাণী। কিছু লেখা ছিল সংস্কৃতে। অন্তত অক্ষর দেখে আমার তাই মনে হয়েছে। সেখানে অনেক পরিচিত নাম দেখে দেশের কথা মনে হচ্ছিল। এখানে একটি পাথরে লেখা আছে 

“ওম মানি পদ্ম হুম। চতুর্দশ দালাই লামা ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর এই খুরুল নির্মাণের জন্য স্থানটি পবিত্র করেন যা কালমিকিতে বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুজ্জীবন ও সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে থাকবে।” 

🍂

মূল ভবন বা খুরুল সাতটি স্তর নিয়ে গঠিত। প্রথম স্তরে আছে লাইব্রেরী, মিউজিয়াম ও কনফারেন্স হল। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে ৯ মিটার উঁচু বুদ্ধের মূর্তি। এটা উপাসনালয় বা দুগান। বুদ্ধ শাক্যমুনির মূর্তির ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন পবিত্র জিনিস – যেমন মন্ত্র, আগরবাতি, গয়না, কালমিকির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আনা মাটি, কালমিকির বিভিন্ন অঞ্চলের গাছ ও শস্য। এছাড়া মূর্তিটি সোনার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত ও হীরা দিয়ে অলঙ্কৃত। তৃতীয় স্তরে রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ যেখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা, তিব্বতের একজন চিকিৎসক ও জ্যোতিষীরা দর্শনপ্রার্থী বিশ্বাসীদের কথা শোনেন, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন, উপদেশ দেন।  এছাড়াও এই স্তরে রয়েছে প্রাশাসনিক অফিস। চতুর্থ স্তর কালমিকির বৌদ্ধদের প্রধান তেলো তুলকু রিনপচের আবাস ভবন। সেখানে একটি ছোট কনফারেন্স হলও আছে। পঞ্চম স্তরে রয়েছে চতুর্দশ দালাই লামা তেঞ্জিন গায়সর বাসভবন। ষষ্ঠ স্তরে রয়েছে ইউটিলিটি রুম। আর সপ্তম স্তরে ধ্যান কক্ষ যেখানে শুধু মাত্র ধর্ম গুরুরা যেতে পারেন। পরিসীমা ববাবর লোহার বেড়ায় ঝুলছিল বিভিন্ন ধরণের রুমাল বা কাপড়ে লেখা বিভিন্ন বাসনা। এ দেশে বিয়ের পর অনেকেই কোন ব্রীজে তালা ঝুলিয়ে চাবি নদী বা জলাশয়ে ফেলে দেয় যাতে বিবাহ বিচ্ছেদ না ঘটে। অবশ্য তা কোন কাজে আসে বলে মনে হয় না। ককেশাসের পাহাড়ে বা জলপ্রপাতের পাশে দেখেছি অনেকেই কাপড়ের টুকরো ঝুলিয়ে রাখে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবার আশায়। অর্থোডক্স চার্চে অনেকেই কাগজে লেখে তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা। বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে গিয়ে এরা স্ট্যাচুর নাক বা শরীরের কোন অংশ ঘষে দেয় বা ফোয়ারায় পয়সা ফেলে আবার সেখানে ফিরে আসবে সেই আশায়। সেদিক থেকে এখানে এ রকম কাপড়ের পাহাড় দেখে অবাক না হলেও কিছুটা অভিনব লেগেছিল। এই প্রথম এ দেশে কোন ধর্মীয় স্থাপনায় ঢুকতে গিয়ে জুতা খুলতে হল। তবে ভেতরে ঢুকে একটু নিরাশ হলাম। কেননা অর্থোডক্স চার্চের ভেতরটা দেখার মত তার শৈল্পিক কারুকার্যের জন্য। কোন কোন চার্চে তো ৭০০ - ৮০০  বছরের পুরানো আর্ট এখনও বিদ্যমান। তাই সেখানে যাওয়া মানে অনেকটা আর্ট গ্যালারিতে যাওয়া। কিন্তু প্যাগোডার ভেতরটা সাদামাটা। গৌতম বুদ্ধের ছবি, তাঁর শায়িত মূর্তি আর চতুর্দিকে বসে থাকা ভক্তদের ভিড়। আমরা তৃতীয় স্তর পর্যন্ত গেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল যদি কেউ কথা বলতে রাজী হন। তবে বুঝলাম দর্শন পেতে হলে অনেক অপেক্ষা করতে হবে। তাই খুব বেশি দেরি না করে নীচে নেমে এলাম। সব মিলে খুব এটা ভালো লাগলো না। অল্প একটু দাঁড়িয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম খুরুল থেকে থেকে। এই অর্থে শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবন বাইরে থেকে যতটা চিত্তাকর্ষক ভেতরটা একেবারেই সাদামাটা। তবে এটাই মনে হয় বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা। 


শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবন থেকে আমরা গেলাম ওল্ড টেম্পল নামে অন্য এক খুরুলে। এখানে আসার কথা অবশ্য আমাদের শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবনের এক লামা বলেছিলেন। এখানে হোস্টেল মত আছে যেখানে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকে, তাই তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা আমাদের সাথে শেয়ার করলে করতেও পারে। ওল্ড টেম্পল বা সিয়াকিউসন সিউমে এলিস্তা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বৌদ্ধ মঠ যা আরশান নামক জনপদের পাশে অবস্থিত। এই ধর্মীয় স্থানের অফিসিয়াল নাম “গেলুগ স্কুলের থিওরি ও প্র্যাক্টিসের পবিত্র ভবন” বা “জ্ঞানী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পবিত্র ভবন"। এই নাম মঠ পেয়েছে চতুর্দশ দালাই লামার কাছ থেকে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠারও আগে। ১৯৮৯ সালে কালমিকিতে খুরুল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর সেজন্য এলিস্তা ও তার উপকণ্ঠে বেশ কিছু জায়গা দেখা হয়। যেহেতু এই খুরুল শুধু উপাসনালয়ই হবে না, হবে বৌদ্ধ ধর্মের আধ্যাত্মিক শিক্ষার কেন্দ্র তাই প্রয়োজন ছিল বেশ বড় জায়গা যেখানে মঠের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। আর এ কারণেই আরশান নামক জনপদের পাশে এই জায়গাটি বেছে নেয়া হয়। চতুর্দশ দালাই লামা দ্বিতীয় বার কালমিকি সফরের সময় ১৯৯২ সালে সেপ্টেম্বরে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কালমিকির প্রথম প্রেসিডেন্ট কিরসান ইলিউমঝিনভ ও কালমিকির জনগণের নিজেদের খরচে ৪ বছর ধরে এই নির্মাণ কাজ চলে। মঠ তৈরি হয় মাত্র এক বছরে। ১৯৯৬ সালের ৫ অক্টোবর খুরুল উদ্বোধন করা হয়। ২০০৫ সালে বুদ্ধ শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবন তৈরির আগে পর্যন্ত এটাই ছিল কালমিকির সবচেয়ে বড় খুরুল। ২০০৪ সালে কালমিকি ভ্রমণের সময় চতুর্দশ দালাই লামা এই খুরুল পবিত্র করেন।   

ওল্ড টেম্পল বা গেলুগ স্কুলের থিওরি ও প্র্যাক্টিসের পবিত্র ভবন

আমরা যখন ওল্ড টেম্পলে এসে পৌঁছুলাম সব দেখে মনে হল সেখানে লাঞ্চ বিরতি চলছে। স্তেপের মাঝে বিশাল এলাকা নিয়ে এই কমপ্লেক্স। পার্ক, বাগান। ফুল ফুটে আছে সেখানে। খুরুল বেশ বড় বলেও শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবনের মত এত জাকজমক পূর্ণ নয়। আমরা যখন এদিক সেদিক ঘুরছি তখন  বছর তিরিশের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু এগিয়ে এলেন। তিনিই আমাদের প্যাগোডার ভেতরের দিকটা দেখালেন আর বললেন এখন সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে, আমরা যেন শব্দ না করি। বেশ কয়েকবার অনুরোধের পরে ইন্টার্ভিউ দিতে রাজি হলেন, তবে অফ ক্যামেরা। এমনকি ওডিও রেকর্ড করাও বারণ। রুশ অর্থোডক্স সেমিনারিস্টদের মত এরাও এই ধর্মীয় স্কুলে আসতে পারে ১৮ বছর পূর্ণ হলে যখন যে কেউ নিজে থেকে নিজের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার পায়। তিনি নিজে থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেন। বাবা মা কখনোই ধর্মের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। তবে ও দীক্ষা নেবার পরে মাঝেমধ্যে আসেন ছেলেকে দেখতে। তিনি বেশ কিছুদিন ইন্ডিয়া ছিলেন এক আশ্রমে। বললেন যে সেখানে ছোট ছোট বাচ্চারাও আশ্রমে ভর্তি হতে পারে। রাশিয়ায় সেটা সম্ভব নয় বলে একটু দুঃখ করলেন, তবে স্বীকার করলেন যে সেটাই বরং ভালো। কারণ কেউ যদি পরে এখান থেকে চলে যেতে চায় তার পক্ষে সমাজে নিজেকে মানিয়ে চলানো বা কাজ খুঁজে পাওয়া সহজ হবে।  

বৌদ্ধ শহর এলিস্তা
https://www.youtube.com/watch?v=PYBx7-UCH_Y&t=3134s

ছবিতে এলিস্তা 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=266


Post a Comment

0 Comments