ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
পরের সকালটি ছিল বড়ো মায়াময়।ভোরবেলার গোলাপী আলোয়, ঘুমভাঙা পাখির গানে কী যেন অজানা সুর ভাসছিল মনে…
অনেক, অনেক দিন বাড়িছাড়া, এবার ঘর যেন টানছে তাঁকে, তাঁদের সবাইকেই। আর যাই হোক, তাঁরা কেউই তো আর দাদার মতো মোহমুক্ত নন। তাঁদের সংসার আছে,মায়া আছে।
গতদিন অবধিও যে পথচলার আনন্দে উন্মন ছিল মন, গৌরীকুন্ডের দর্শন শেষে ফেরার পথে সেই ছোট্ট মেয়ে ও তার ভাইটিকে দেখার পর থেকেই মন ঘুরেছে,মনে পড়ছে বাড়ির কাঁঠাল তলা, পুকুর ঘাট,দেবদেউল, প্রাত্যহিকী দিনযাপনের কথা। মনে মনে ভাবছিলেন বিরজা,পথ এবং ঘর এই দুটি টান সমান সমান থাকলেই বোধহয় জীবন কাটে সুন্দর! ভাগ্যিস দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল,তার নাহলে এসব কথা জানাই হতো না হয়তো…
ওদিকে বারান্দায় সইকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরুন্ধতী কাছে এসেছিল,কেন কে জানে,এই কয়দিনেই মেয়েটা বড়ো আপন হয়ে গিয়েছে তার!একে তো ভীষণ সুন্দর দেখতে,তায় কি ভালো ব্যবহার! পিসিমার মুখে শুনেছে পোড়ারমুখী নাকি বিরাট বড়ো জমিদারবাড়ির বৌ!কপালে সুখ না থাকলেও সম্পদ অগাধ;সে সম্পদ দিয়ে নাকি লোকসেবা করে;দানধ্যান,গরীবের মেয়ের বিয়ে,ছেলের পড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।আর নাকি খুব বই পড়ে,পড়তে ভালোবাসে।
সে কথা শুনে কত্তা মশাইয়ের কি শ্রদ্ধা তাকে! হুঁ,যত্ত সব, মেয়েমানুষের আবার পড়ালেখার সখ থাকে নাকি!
তবে স্বীকার করতেই হবে, মেয়েটা সত্যি ভালো, যদিও একটু ট্যালা! এই যে দেখনা,যেতে হবে কতদূর,পিসিমাকে,মাকে স্নান করিয়ে,জামাকাপড় পরিয়ে, নিজেদেরও সব গুছিয়ে বেরোতে হবে এক্ষুনি;আর দেখ,সে মেয়ে এখন আকাশ দেখছে…
কাছে এসে ডাকলেন,
-’ও সই!হারালি কই!’
যেন গত জন্ম ঘুরে এসে উত্তর এলো,-’এই তো…’
তারপরেই হুটোপুটি, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বদ্রীনাথ মন্দির যাত্রা…যেতে যেতে দুচোখ ভরে দেখা… অপূর্ব সুন্দর সে পথ;এখনও ছবির মতো মনে ভাসে। কানে আসে দাদার জলদগম্ভীর স্বরের কথন,’ মানুষের ধর্মবিশ্বাস বলে, স্বর্গযাত্রার পথে পঞ্চপান্ডবেরা নাকি এখানে বিশ্রাম করেছিলেন।কেউ আবার বলেন,শিবদূর্গাও নাকি যুগলে এখানে ছিলেন কখনও, এখানেই গনেশকে কুড়িয়ে পাওয়া!গনেশের নামে তাই গুহাও আছে এখানে। আছে ব্যাসদেবের মহাভারত লেখার গুহাও’
তবে প্রামান্য ইতিহাস বলে,ভগবান বদ্রীনাথের প্রাচীন মূর্তি এবং মন্দির 1750-500 খ্রিস্টপূর্বাব্দের বলে বিশ্বাস করা হয়। অদ্ভুত রহস্যময় শক্তপোক্ত গড়নের মন্দিরটি বৌদ্ধ মঠের অনুরূপ, মন্দিরটি আদি শঙ্করাচার্য এবং রাজা কনকের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিমার্জিত হয়ে ভগবান বিষ্ণুর কাছে পুনঃসমর্পিত হয়েছিল।
পরে পরে,গাড়োয়াল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় 17 শতকে পুনঃনির্মিত এবং প্রসারিত হয়েছে,কতো শত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও যা অবিকল রয়ে গিয়েছে। অধিষ্ঠিত দেবতা শিব অথবা বিষ্ণু তা নিয়ে দ্বন্দ্বে না গিয়েও এই কথা সত্যি যে মন্দিরের নির্মাণ কৌশল অনবদ্য সুন্দর।তাই হয়তো ঝড় ঝঞ্ঝা, তুষার পাত,কালের ক্ষত কিছুই তাদের ছুঁতে পারেনি কণামাত্রও।
🍂
আরও পড়ুন 👇
গাড়ি চলতে চলতে,এই সব শুনতে শুনতে সারাদিন ধরে শুধু বদ্রীনাথ মন্দিরটি নয়, তাঁরা দেখেছিলেন পথিমধ্যে অপূর্ব সব জলপ্রপাত,মানা গ্রাম, বেদব্যাস গুহা,গনেশ গুহা,ভীমপুল,মাতা মুর্তি,চরনপাদুকার পবিত্র স্থান আরও কতো কি …সব সব মনে পড়ে এখনও ছবির মতন,না ফুরানো গল্পের মতো। তবে সব গল্পের শেষ তো মধুর হয়না। জীবনের প্রথম ভ্রমণ পরিক্রমাতেও মনখারাপের ক্ষত বিরজার পিছু ছাড়েনি। ফেরার আগের দিন রাতে হঠাৎ করে সইয়ের বাবা কাকাবাবুর বুকে ব্যথা শুরু হয়।খবর পেয়েই ওরা দুইজন কোন বিধিনিষেধ না মেনেই পুরুষদের আবাসে পৌঁছে সাধ্যমতো সেবা শুরু করে।গরম জল, তেল মালিশ,স্থানীয় টোটকা, ওষুধ বিষুধ সমস্ত রকম চেষ্টাতেও কোন উপশম হয়নি।
তখনকার দিনে তো সবজায়গায় ডাক্তার বা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা ছিল না,তায় ওমন দুর্গম জায়গা…. অবস্থা ক্রমশ আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে অগত্যা রাতেই ট্রাঙ্ক কল করে পরের ভোরেই সইয়ের বরের অফিসের গাড়ি ডাকিয়ে তাঁরা দিল্লীর দিকে রওনা হয়ে যান,একা পড়ে যান বিরজারা।তাই পরের দিনের তীর্থ দর্শনে আর মন লাগে নি তাঁদের । কোনক্রমে যোশীমঠ,রুদ্রপ্রয়াগ এবং কালেশ্বর হয়ে সন্ধ্যার মুখে যখন তাঁরা হরিদ্বারে গুরুদেবের আশ্রমে ফিরলেন,সবার মনেই উদ্বেগের কালো ছায়া।তখনো গুরুদেবের কাছে কোন খবর এসে পৌঁছায় নি,দাদাও সইয়ের বরের অফিসের ফোন নম্বর জানতেন না…
অবশেষে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে খবর নিয়ে জানা গিয়েছিল দুঃসংবাদ,গাড়ি যোশীমঠের কাছে এসেই নাকি কাকাবাবুর… অল্পভাষী সদাশয় মানুষটির অন্তিম যাত্রাও যেন ছিল নীরব ও সংহত।বিরজার চোখে ভাসছিল কাকিমার বিরজার মনে ভাসছিল কাকিমার সেই সাদা সিঁথি ভরা ফর্সা টুকটুকে মুখখানি…সবাই বলাবলি করছিল,সেই পূণ্যভূমিতেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াদি সেরে,সদ্য বিধবা মা এবং মুন্ডিতমস্তক ভাইটিকে নিয়ে অরু নাকি ফিরে গিয়েছিল তার স্বামীর কর্মক্ষেত্রে, বাবার আর দেখা হয়নি মেয়ের গিন্নীপনা,বিরজারও আর দেখা হয়নি কাকিমার সঙ্গে।বাড়ি ফিরে আসার কয়দিন পরেই সইয়ের চিঠি এসেছিল মায়ের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে; দীর্ঘ পথের সঙ্গীর এমন অতর্কিত বিদায় মেনে নিতে পারেনি সতীর দুর্বল হৃদয়…
সবাই তো আর বিরজা নয়!
যাইহোক,শুরুর উন্মাদনা, আনন্দ অথবা পূণ্য,যাই বলো না কেন, সবকিছু পাহাড়েই ফেলে রেখে ফিরেছিলেন তাঁরা ভগ্নহৃদয়ে।পিসিমাকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছিয়ে বিরজাকেও ফিরতে হয়েছিল আপন বাড়িতে, সামনেই বর্ষা আসছে,ধান রোঁয়া, চাষবাসের কাজ শুরু হোল বলে;সম্বৎসরের খোরাকী… তিনিই এসব দেখাশোনা করেন।জায়গাজমি,তার মালিক শ্বশুরবাড়ি বা বাবার বাড়ি যারাই হোক না কেন, রক্ষনাবেক্ষনের আসল দায়িত্ব যে বাড়ির ঘোমটাপরা মেয়েগুলিরই, একথা স্বীকার না করলেও অস্বীকার করার দায়ও হয়তো নেই এই সমাজের।…(ক্রমশ)
0 Comments