৪১তম পর্ব
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
শ্রীকৃষ্ণের শানিত বুদ্ধি ও কর্মকুশলতায় দ্বারকা একসময় উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল। কিন্তু দ্বারকার অসীম সমৃদ্ধির ফলস্বরূপ যাদবগণ ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে উঠেন। আসলে শ্রীকৃষ্ণ যে দ্বারকাপুরীর স্বপ্ন দেখেছিলেন তা ক্রমশ ভেঙে গিয়েছিল। যাদবরা সৎ, সহনশীল এবং পরাক্রমশালী এক জাতিতে পরিণত হোক এই ভাবনাই ছিল শ্রীকৃষ্ণের। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন ধাক্কা খেয়েছিল। এমত অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের মনে হয়েছিল ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’। কলহপ্রিয় সুরাপানপটু যাদবেরা বেঁচে থাকলে সমাজের আরও অমঙ্গল হবে। যাদবেরা যে নিজেরাই মারামারি করে নিজেদের মৃত্যু ডেকে আনবে এ কথা শ্রীকৃষ্ণ বহু পূর্বেই জানতে পেরেছিলেন। যার জন্য মুণি-ঋষিদের অভিশাপের পরেও তিনি মুণি-ঋষিদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে যাদবদের পাঠাননি বা নিজেও যাননি।
সমস্ত ঐতিহাসিকদের অভিমত কালের প্রবাহে সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছ্বাসে শ্রীকৃষ্ণের সময়ের দ্বারকা বারংবার ধ্বংস হয়েছে। গোমতী নদীর ধারে বর্তমানে দ্বারকাধীশের যে মন্দিরটি আমরা দেখতে পাই সেখানেই একদা শ্রীকৃষ্ণের রাজদরবার ছিল এ কথা যেমন সত্য তেমনি তার বাসভূমির জায়গাটি ছিল সমুদ্রের কিছুটা ভেতরে একটি দ্বীপের মধ্যে যার নাম বেট দ্বারকা। তবে সমুদ্রের ভেতরে কোন দ্বীপ নয়, তিনি প্রায় একশো বছর গোমতী তীরের দ্বারকাতেই বসবাস করেছিলেন। যে বারো যোজন ভূখণ্ড সমুদ্রদেবতার কাছ থেকে তিনি লাভ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মানবলীলা সংবরণের পরে সেই ভূমি সমুদ্রের জলে তলিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণের আমলে দ্বারকা যে কতখানি সুরক্ষিত এবং বৈভবশালী নগরী ছিল তার প্রমাণ আমরা হরিবংশ পুরাণ, ভাগবত পুরাণ ও গর্গসংহিতায় দেখতে পাই। হরিবংশপুরানে দ্বারকা নগরীর বৈভব ও তার সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে সমুদ্রের মাঝে পুরো নগরী অনেকটা নৌকার আকৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছিল। নগরীর চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া ছিল। তারপরে সূউচ্চ মজবুত দেওয়াল। দেওয়ালের বাইরে অজস্র ছোট বড় টিলা ছিল। টিলাগুলির উপরে উঠে যাদব সেনারা দূর থেকে লক্ষ্য রাখত কোন শত্রুসৈন্য দ্বারকা আক্রমণের চেষ্টা করছে কিনা। দ্বারকায় প্রবেশের আটটি পথ ছিল। গুপ্ত সংকেত ছাড়া এই নগরীর ভেতরে কেহ প্রবেশ করতে পারতেন না। নগরীর প্রবেশের জন্য দক্ষিণ দিকের দ্বার ব্যবহৃত হত। দেওয়ালের গায়ে এমনভাবে প্রবেশদ্বার তৈরি করা ছিল যে গভীর পর্যবেক্ষণ ছাড়া তা বোঝা যেত না। নগরীর ভিতরে আটটি প্রধান সুপ্রশস্ত রাস্তা ছিল এবং সেই রাস্তায় দুটি রথ পাশাপাশি যেতে পারত। প্রতিটি রাস্তার কিছুটা দূরত্বে এক একটি সেনা চৌকি ছিল। রাস্তা দিয়ে যারা যাতায়াত করতো সেনারা তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতো। সমগ্র দ্বারকা নগরীতে ১৬টি বড় বড় চৌরাস্তা ছিল। রাস্তার দু'ধারে বড় বড় বৃক্ষ ও ফুলের বাগান ছিল।
শিল্পকলার বিচারেও এই নগরীর সৌন্দর্য ছিল দর্শনীয়। নগরীর ভেতরে তিনটি দুর্গ ছিল। প্রতিটি দুর্গের ভেতরে ও বাইরে সোনা-রুপার কারুকার্য করা ফল ফুল ও লতাপাতা আঁকা ছিল। দুটি দুর্গের মাঝখানে শ্রীকৃষ্ণের নিজস্ব দুর্গ। প্রথম দুর্গের ভেতরে মহাদেবের একটি বিরাট মন্দির ছিল। শ্রীকৃষ্ণের দুর্গের সামনে লীলা সরোবর নামে একটি গভীর জলাশয় ছিল এবং তার কোণে একটি রাধা মন্দির ছিল। তৃতীয় দূর্গে কৃষ্ণের বিশেষ অস্ত্রাগার ছিল। সেই অস্ত্রাগারেই তাঁর সুদর্শন চক্র রাখা থাকত এবং কড়া সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল সেখানে। যে দুর্গে শ্রীকৃষ্ণ থাকতেন সেখানেই তাঁর পাটরানীদের জন্য আলাদা আলাদা মহল ছিল এবং প্রত্যেকের মহলের রঙ ছিল বিভিন্ন। যেমন রুক্মিণীর মহলের রঙ ছিল স্বর্নবর্ণের, সত্যভামার শ্বেত বর্ণের, জাম্ববতীর মহলের রঙ ছিল সূর্যকিরণের মতো, নগ্নাজিতের মহলের রঙ ছিল আগুনরঙা, মিত্রাবৃন্দের মহল ছিল হলুদ রঙের এবং লক্ষণার মহল ছিল সূর্যকিরণের মতো। এই দ্বারকা নগরীর ভিতরে অনেকগুলি ছোট ছোট পাহাড় ছিল। কৃষ্ণের মহল ছিল যে পাহাড়ে সেই পাহাড়ের নাম ছিল 'বৈজ'।
🍂
শ্রীকৃষ্ণের কাছে দ্বারকা নগরীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারানগরীতে ৩০৮টি সেনা চৌকি ছিল। প্রত্যেক চৌকিতে তিনজন করে সেনা থাকতেন। দশটি চৌকির পরে মাঝারি আকারের একটি করে চৌকি থাকতো সেখানেও তিন জন সেনা থাকতো তবে প্রয়োজনে সেই তিনজন সেনাকে বাড়িয়ে দশজন করা হতো যারা প্রত্যেকেই কুশলী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন। মাঝারি চৌকিগুলিতে ছোটখাটো অস্ত্রাগারও থাকতো। বড় চৌকিগুলিতে ১০০ হাতি ৫০০ ঘোড়া এবং পঞ্চাশটি করে রথ থাকত। পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকতেন একজন দুর্গপাল। এই দুর্গপালের অধীনে বহু সংখ্যক সেনা থাকতেন। দ্বারকানগরীর আনাচে কানাচে অনেক গুপ্ত পথ ছিল। এসব গুপ্তপথের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খবরা-খবর শ্রীকৃষ্ণের মহলে প্রত্যেক দিন পৌঁছে যেত। নগরীর আয়তন কত ছিল সে সম্বন্ধে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন মত ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে একটি অনুমান অনুসারে বলা যায় নগরীর ক্ষেত্রফল ছিল ১৩৫ বর্গকিলোমিটার।
বেট দ্বারকাকে অনেকে ভেট দ্বারকা বলেন। এখানেই কৃষ্ণসখা সুদামা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে এলে তাঁকে নানা বস্তু ভেট বা উপঢৌকন হিসাবে প্রদান করেন শ্রীকৃষ্ণ। তার থেকেই এই নগরীর নাম হয় ভেট দ্বারকা। কৃষ্ণ সুদামার সাক্ষাৎকারটি ছিল এই রকম। বহুদিন পূর্বে কৈশোর অবস্থায় অবন্তিকা নগরে গুরু সন্দীপনী মুণির কাছে কৃষ্ণ, বলরাম ও সুদামা বিদ্যাভ্যাস করতে গিয়েছিলেন। বিদ্যাভ্যাস শেষ হওয়ার পরে কৃষ্ণ, বলরাম মথুরাতে ফিরে যান এবং সুদামা নিজগৃহ পোরবন্দরের কাছে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। এরপরে বহুদিন তাঁদের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিল না। ইতিমধ্যে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা নগরী স্থাপন করেছেন এবং প্রভূত ধন সম্পদের অধিকারী হয়েছেন। একদিন সুদামা পত্নী সুশীলা সুদামাকে বললেন "শুনেছি তোমার বন্ধু কৃষ্ণ দ্বারকা নগরীতে অতুল ধনসম্পদের অধিকারী। তুমি তাঁর কাছে যেয়ে আমাদের এই দারিদ্রের কথা উল্লেখ করে কিছু ধনসম্পদ নিয়ে এসো যাতে আমাদের এই কষ্ট দূর হয়"। সুদামা প্রথমে যেতে রাজী হননি কিন্তু বন্ধুর সাথে দেখা হবে এই আনন্দে তিনি যাবার উদ্যোগ করলেন। যাবার সময় সুশীলাকে বললেন "বন্ধুর কাছে যাব। কি নিয়ে যাব"? সুশীলা বললেন "ঘরে তো কিছুই নেই, সামান্য খুদ আছে তাই তুমি নিয়ে যাও"। এই বলে সুশীলা একটি কাপড়ে কয়েক মুষ্টি খুদ বেঁধে দিলেন।
দ্বারকাতে যেয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৈভব দেখে সুদামা অবাক হয়ে গেলেন। দুর্গদ্বারে দুর্গপ্রহরীকে বললেন ‘আমি কৃষ্ণের সখা তাঁর সাথে দেখা করব’। তারা যেয়ে শ্রীকৃষ্ণকে খবর দিলেন। তিনি তখন পাটরানী রুক্মিণীর সঙ্গে পালঙ্কে বসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ বন্ধুর আগমনের সংবাদ পেয়ে দুর্গপ্রহরীকে বললেন তাঁকে সেখানেই নিয়ে আসতে। রাজ অন্তপুরে প্রবেশ করার পরে সেখানের সাজসজ্জা দেখে সুদামা অবাক হয়ে চারিদিকে দেখতে দেখতে শ্রীকৃষ্ণের মহলে যেয়ে পৌছালেন। সুদামাকে দেখে শ্রীকৃষ্ণ পালঙ্ক থেকে নেমে এসে দুই বাহু প্রসারিত করে তাঁকে আলিঙ্গন করে তাঁকে নিয়ে যেয়ে পালঙ্কের উপরে বসালেন এবং তিনি নিজে এবং রুক্মিণী উভয়ে মিলে একটি পাত্রে অগুরু, কুঙ্কুম, চন্দন প্রভৃতি সুগন্ধি দ্রব্য মিশ্রিত জলে সুদামার পা ধুয়ে দিলেন। যোগ্য অর্চনার পরে বন্ধুর আহার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। আহারের সময় স্বয়ং দেবী রুক্মিণী সখীদের নিয়ে সুদামার নিকটে বসে পরিচর্যা করলেন এবং তাঁর বিশ্রামের সময় তিনি ব্যাজন দ্বারা পরিচর্যা করলেন। বিশ্রামের পরে শ্রীকৃষ্ণ বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন "বন্ধু, তুমি এতদিন পরে এলে আমার জন্য কি এনেছো"? সুদামা ইতস্তত করে তাঁর কাছে কাপড়ে বাঁধা খুদগুলি তাঁকে দিয়ে বললেন "আমার গৃহের থেকে তোমার জন্য যৎসামান্য এই খুদগুলি এনেছি"। সেই খুদগুলি দেখে শ্রীকৃষ্ণ পরম পরিতোষ সহকারে তা গ্রহণ করলেন। অন্তপুরবাসীরা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণী দেবী এই মলিনবেশী ব্রাহ্মণের সর্ববিষয়ে পরিচর্যা করছেন দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। সুদামা অত্যন্ত নির্লোভ ছিলেন। যার জন্য খুদগুলি দেওয়ার পরে তিনি আর কিছু চাইতে পারলেন না। কিন্তু অন্তর্যামী ভগবান তিনি তো সব জানেন। কয়েকদিন থাকার পরে সুদামা ফিরে আসার সময় শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণী তাঁকে প্রচুর উপঢৌকন দিলেন এবং সুদামাকে একটি রথে করে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সুদামা বাড়ির নিকটে এসে নিজের বাড়িকে আর চিনতে পারলেন না। তার সেই পর্নকুটিরের জায়গায় এক বৃহৎ অট্টালিকা ফুলে ফলে সুশোভিত। তাঁকে দেখে তাঁর স্ত্রী সেই অট্টালিকা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন। সুদামা বুঝতে পারলেন কৃষ্ণের ইচ্ছাতেই এই বৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণ হয়েছে। অন্তর্যামী ভগবান এইভাবে বন্ধুর দারিদ্র দূর করে এক প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিলেন।
0 Comments