বাংলাদেশ সফর
পর্ব-২
রোশেনারা খান
ভোরের সময় বাস আরামবাগ পৌঁছাল।এটা ঢাকার একটা বাইপাস। এখান থেকে আমরা কক্সবাজারের বাসে উঠলাম, এসি বাস। আমার পাশে বসা মায়াদি জানালার ধারে বসার জন্য অনেকক্ষণ ঝোলঝুলি করলেন।কিন্তু আমি নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয়ে সিট ছাড়লাম না।আমার একটা ফোবিয়া আছে, বদ্ধ জায়গায় থাকতে পারি না। তেমন পরিস্থিতি হলে মনকে কিছু বোঝাতে হয়, ফ্লাইটে মনকে বোঝায় মাথার ওপর এসি থেকে অক্সিজেন আসছে। ঘুমনোর সময় রুমের দরজা খোলা রাখি।বাসের সাইডে বসলে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে ভুলে যাব বাসের মধ্যে বন্দি অবস্থার কথা।
বাস ছুটছে তো ছুটছেই। বিরামহীন ভাবে ছুটে চলেছে। কত লোকালয়, জনপদ, নদী বন্দর, সবুজ শস্যক্ষেত, বাগান পার হয়ে চলেছি।এ সমস্ত পার হয়ে এক সময় আমাদের বাস চট্টগ্রাম প্রবেশ করল। আমিও জানিনা কখন ইতিহাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। চট্টগ্রাম নামটা ‘অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’এর ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্য সেনের (মাস্টারদা)নেতৃত্বে অসীম সাহসী বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বিপ্লবীরা টেলিফোনের তার কেটে দিয়েছিলেন আগেই। অতর্কিতে হানা দিয়ে বিপ্লবীরা দ্রুত অস্ত্রাগারের দখল নেয়। শহরের অন্য প্রান্তে থাকা পুলিশ ও ব্রিটিশ যোদ্ধারা কিছুই জানতে পারেনা। টেলিগ্রাফের তার কেটে দেওয়ার ফলে ট্রেন যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।এই কাজে ৬৫ জন বিপ্লবী যোগ দিয়েছিলেন। কাজে সফল হওয়ার পর বিপ্লবীরা সমবেত হয়ে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারি স্যালুট দেন। সূর্য সেন ওখানে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন বলেও জানা যায়।
কর্ণফুলী নদীর কোলে চট্টগ্রাম শহর।কর্ণফুলী নদীর ওপর দিয়েই এলাম, অথচ তার কথা বলতেই ভুলে গেছি। এই নদীটির জন্ম আমাদের দেশে মিজোরামে।চট্টগ্রামের ওপর প্রভাবিত হয়ে কর্ণফুলী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এর মোহনাতেই চট্টগ্রাম বন্দর অবস্থিত। কর্ণফুলী এই কারণে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী।
গুরুত্বের দিক দিয়ে ঢাকার পরেই চট্টগ্রাম। আমার তাই মনে হয়েছে। চট্টগ্রাম শুধু আয়তনে দ্বিতয় বৃহত্তম শহরই নয়, গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দরও।যে জন্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের বানিজ্যিক রাজধানী বলা হয়।বহুযুগ পূর্বে চট্টগ্রামের নামছিল চাটিগাঁও। মোগলরা রেখেছিল ইসলামাবাদ, তবে চাটিগাঁও নামটিও প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশরা চাটিগাঁও নাম ব্যবহার করে। সংস্কৃত ভাষায় নাকি চাটিগাঁও এর উচ্চারণ চট্টগ্রাম।এখানকার বিখ্যাত ফল হল পেয়ারা।পেয়ারার সাইজ খুব বড়।এত বড় পেয়ারা আগে দেখিনি। বাসের মধ্যেই কিনে খেলাম, দারুণ স্বাদ। তবে সবরকমই ফলই এখানে হয়। যাই হোক সমুদ্র, পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা চট্টগ্রাম পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।আমার ভাবনাকে অতিক্রম করে বাস কখন চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে গেছে, টের পাইনি। আর ভালো লাগছে না। গতকাল সকাল ৮টা ৩০শে বাড়ি থেকে রওনা হয়েছি। আরও কত পথ বাকি, জানিনা। মাঝে বার দুই রাস্তার ধারে রেস্টুরেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখেমুখে জল দিয়েছি, ব্রাশ করা হয়নি। একের পর এক জনপদ পার হয়ে চলেছি। নদী বন্দর পার হলাম।পথের যেন শেষ নেই। ভরদুপুরে গন্তব্য স্থলে, মানে কক্সবাজার পৌঁছালাম। বাস থেকে নেমে শাকিল ফোন করে জানলেন আমাদের থাকার ব্যবস্থা কোথায় হয়েছে? মিনিট পাঁচ’এর মধ্যে পৌঁছে গেলাম।আমাদের থাকার রুমগুলি তিন তলায়, কোনও লিফট নেই। নামাওঠা করতে অসুবিধা হবে, কিন্তু কিছু করার নেই।আমি আর শ্রাবন্তী রুম সেয়ার করেছি।
সুটকেস থেকে স্যাম্পু-সাবান বের করে স্নানে গেলাম।শ্রাবন্তী পরে যাবে। আজই তো বিকেল চারটের সময় কবিতা উৎসব শুরু হবে। আমি স্নান করে বেরিয়ে দেখলাম লাঞ্চের প্যাকেট দিয়ে গ্যাছে।প্যাকেট খুলে দেখি বাদশাভোগ(এখানে চিনিগুঁড়া বলে)চালের ভাত আর চিকেন। সঙ্গে কয়েক টুকরো শসা। চিকেন খেতে ইচ্ছে করছিল না,বাধ্য হয়েই খেলাম।একটুখানি বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হত, কিন্তু তা সম্ভব নয়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
সবাই চলে গিয়েছিল। আমি শ্রাবন্তী পৌঁছে দেখলাম অনুষ্ঠান চলছে। শুরুর আগে পৌঁছাতে পারিনি, তাই প্রথম পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল। সভাপতি কবি কামরুল হাসান প্রাথমিক আলাপ শেষ হলে, গত বার আসতে পারিনি, তাই আমার জন্য রাখা টুপি ব্রোচ উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করলেন। তারপর ঘোষণা করলেন, ‘এবার আমরা অনুষ্ঠানের মূল পর্বে প্রবেশ করব’। অনুষ্ঠানটিকে অনেকগুলি পর্বে ভাগ করা হয়েছে।প্রত্যেক পর্বে সভাপতি এবং সঞ্চালক বদলে যাচ্ছে। আমাদের সবার হাতে একটি করে লাল গোলাপ দেওয়া হয়েছিল। সেই গোলাপ হাতে নিয়ে সবাই নিচে নেমে এলাম। সহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে লাল সাদা বেলুন উড়িয়ে বৈশাখী কবিতা উৎসবের সুচনা হল।
'বঙ্গবন্ধু জাতীয় কবিতা পরিষদ' এর বৈশাখী উৎসবের সূচনা।
আমরা আবার দোতলায় অনুষ্ঠান গৃহে ফিরলাম। আবার আমাদের মঞ্চে বসানো হল।আমার হাতে ‘আলোকিত ফজিলাতুন্নেসা’ সম্মাননা তুলে দিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এম এম সিরাজুল ইস্লাম,সঙ্গে থাকলেন জেলাশাসক মালেক মুস্তাকিন,কবি কামরুল ইসলাম,কবি(ইঞ্জিনিয়ার)মামুন খান বাচিক শিল্পী পারভেজ চৌধুরী ও আরও অনেক বিশিষ্ট জনেরা। এই অনুষ্ঠানে ডায়মণ্ড হারবার প্রেস ক্লাবের সাহিত্য পত্রিকা কুসুমে ফেরা পত্রিকাটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল। একই সঙ্গে সেরা লিটিল ম্যাগাজিনেরও স্বীকৃতি পেল। স্মারকটি গ্রহন করলেন পত্রিকার সম্পাদক শাকিল আহমেদ (কবি ও সাংবাদিক)।
পরের পর্বে শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।অনেক মহিলারাও উপস্থিত ছিলেন। একটি অল্পবয়সি মেয়ে আকাধারে টিভির সঞ্চালিকা এবং বাচিক শিল্পী আবৃত্তি শোনালো। কামরুল হাসানের স্ত্রী আবিদা নূর চৌধুরী নজরুলগীতি ও আধুনিক গান শোনালেন।গলার কাজ অসাধারণ।মুগ্ধ হতেই হবে।এখানেই শেষ নয়, ঢাকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাচিক শিল্পী পারভেজ চৌধুরী অসম্ভব ভাল কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। বিশেষ করে পারভেজ চৌধুরীর কণ্ঠে কবি কামরুল হাসানের লেখা কবিতাটির জন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।আমি শুনে শিহরিত হয়েছি, মুগ্ধও হয়েছি। যেমন হৃদয় নিংড়ানো লেখা, তেমন শিল্পীর কণ্ঠস্বর ও তাঁর বাচন ভঙ্গি! মনকে নাড়িয়ে দেওয়ার মত ততোধিক জোরাল। আমাকে কিছু বলতে বলা হলে অনেক দিনের জমানো কিছু কথা, কিছু ব্যথা, কিছু প্রশ্ন মুখ দিয়ে ঝর্ণার মত বেরিয়ে এল।উপস্থিত অতিথি শ্রোতাগন আমার সাথে একমত হলেন বলেই মনে হল। আমি স্বরচিত কবিতাও শোনালাম। একদিকে অনুষ্ঠান চলছে আর একদিকে চলছে ফোটো সেশন। আমার সঙ্গে অনেকেই ছবি তুল্লেন, কার্ড নিলেন, দিলেনও। এখান থেকে বেরিয়ে আমরা সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।প্রথমে হেঁটে যাওয়ার কথা ভাবা হলেও আমি রাজি হলাম না।গরমে শাড়ি পরে হাঁটা খুব মুশকিল।আমরা আপত্তি করাতে সবাই টোটোতেই রওনা দিলাম।
ক্রমশ
0 Comments