ইস্কুল ফিস্কুল
পর্ব ৯
সৌমেন রায়
চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি
পায়েমারি শিক্ষা (২)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সরকারও কি নবীন শিক্ষার্থীদের পায়ে মারে? প্রাথমিক শিক্ষকদের বিশেষত প্রধান শিক্ষকদের অনেক শিক্ষা বহির্ভুত কাজ থাকে। যেমন মিড ডে মিলের হিসাব নিকাশ, ব্যবস্থাপনা, পোর্টালে রেজাল্ট করা, ভোটের কাজ করা ইত্যাদি। বেশিরভাগ করতে হয় কম্পিউটারে। যদিও তাদের কম্পিউটার দেওয়া হয়নি। কেউ করেন মোবাইলে। কেউবা সাইবার ক্যাফেতে। কোন কোন হেডমাস্টার মহাশয় স্কুল টাইমের বাইরে করেন। যাতে পড়ার সময় নষ্ট না হয়। কিন্তু সবাই নিশ্চয়ই তা করতে পারেন না। এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার অর্থ কার্যকর ভাবে স্কুলে শিক্ষক কমে যাওয়া। আরো সমস্যা গ্রামাঞ্চলের অনেক স্কুলে শিক্ষকের অভাব। চারটি ক্লাসে দুজন শিক্ষক। একজনও আছেন। দুজনের একজন ছুটি নিলে অন্যজন মিড ডে মিল ইত্যাদি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একজনের একজন ছুটি নিলে তো স্কুলে তালা। চারটা ক্লাস দুজনে সামলানো কঠিন। মানে সামলানো যাবে , পড়ানো যাবে না। আবার শহরের কাছাকাছি স্কুলগুলোতে বাড়তি শিক্ষক। কম শিক্ষকের স্কুল থেকে একজন শিক্ষককে তুলে নিয়ে বেশি শিক্ষকের স্কুলে দিতে আধিকারিকের কলম কাঁপেনি। তিনি ম্লান মুখ শিশুগুলির দিকে না দেখে কি দেখেছেন তিনিই জানেন। ভেবে দেখুন হয়ত আপনিও জানেন ! এই পায়ে মারি শিক্ষাকে সবাই গুরুত্বহীন মনে করে। সেই কারণেই এখানে স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি।
এখন আবার একটি নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সরকারী বিদ্যালয়ে অব্যবস্থার সুযোগে গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠছে প্রাইভেট স্কুল এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। সেগুলোর সরকারী অনুমোদন নেই। সেগুলিতে যারা পড়ান তারা পরিশ্রম করেন কিন্তু তাদের বাচ্চা পড়ানোর অভিজ্ঞতা কম। প্রায়ই পাল্টে যান শিক্ষক শিক্ষিকা। পড়াশোনা হবে ভেবে অনেকেই সেই সমস্ত স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করছেন। কিন্তু যেহেতু তাদের অ্যাফিলিয়েশন নেই তাই সেখানে পড়লে শিক্ষা পোর্টালে শিশুর নাম উঠবে না। পরে সমস্যা হবে। তাই গ্রামের সরকারি স্কুলেও বাচ্চাগুলি ভর্তি হচ্ছে। সকালে প্রাইভেট স্কুলে যায়, দুপুরে সরকারি স্কুলে। একটি কোমল মনের বাচ্চা কিভাবে মানিয়ে নেয় জানা নেই। অভিভাবকরা এই দ্বৈত ব্যবস্থাকে কিন্তু সুন্দরভাবে ভাগ করে নিয়েছেন। সকালেরটা পড়ার স্কুল। দুপুরেরটা খেলার স্কুল। বুঝুন কোথায় যাচ্ছে সরকারি স্কুল।
এস এস কে ( শিশু শিক্ষা কেন্দ্র) গুলির হাল আরও খারাপ। সেখানে একজন , দুজন শিক্ষিকা। তিনি খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজ করেন। আবার চারটি ক্লাস কে পড়ান। ক্লাস পিছু পাঁচজন হলেও কি এত ভ্যারাইটির কাজ করা যায়? তার জন্য তারা যা করার তাই করেন। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজ সময়ে করেন । না হলে অফিস ধরবে। খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। না হলে অভিভাবক খোঁজ করবে। তিনি জানেন কেউ পড়ার খোঁজ নেবে না। তাই তিনি ঐটি বাদ রাখেন। একবার এক হাইস্কুলে দেখা গেল ক্লাস ফাইভে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায় আসছেই না। কমিটিকে জানানো হল। কমিটির সদস্যরা বললেন যে ওরা সব এস এস কে র স্টুডেন্ট। সেখানে যায়, খেলাধুলা করে, খায় দু ঘন্টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। এখানে এই যে আপনারা সারাদিন ধরে পরপর ক্লাস নেন সে চাপ ওরা নিতে পারে না। তাই দুদিন আসে, চার দিন বন্ধ করে ! এখানেও হয়ত দু চারজন আছেন যারা এত সব ঝামেলা সত্বেও দু চারটে ছেলে মেয়েকে বেছে নিয়ে মন প্রাণ ঢেলে পড়ান । কিন্তু সে সংখ্যা খুবই কম।
প্রাইমারি শিক্ষকরা কি বলছেন? তারা বলছেন যাদের বাড়ি সচেতন তাদেরই পড়া হচ্ছে। বাকিদের অনুপস্থিতি ও অনীহার কারণে কিছু করা যাচ্ছেনা। এক প্রাইমারি শিক্ষককে চেপে ধরা গেল। তিনি অবিবাহিত, পিছুটান নেই। ছেলেদের সুর করে পড়ান। খেলাধুলা করান। স্টুডেন্টদের প্রতি একটা টান আছে। স্কুল তো অক্ষর পরিচয় করানোর জন্য। আপনারা পারছেন না কেন? বললেন অভিভাবক সচেতন না হলে হবে না। অভিভাবক পড়াতে না পারুক পড়তে বসছে কিনা, পড়াশোনা করছে কিনা সেগুলো দেখতে পারে। কাছে বসতে পারে। অর্থাৎ একটা পড়ার পরিবেশ তাকে দিতে পারে। সেটা না দিলে স্কুল অসহায় হয়ে পড়ে। কাউকে ধরে পড়াতে গেলে সে তো স্কুল আসাই বন্ধ করে দিচ্ছে। ছেলেটা বা মেয়েটা যে স্কুল আসছে না সেটা কি অভিভাবক জানেনা? ছোটো বেলায় কেউ পড়তে চায়না। একটু জোর করতেই হয়। আমার মনে আছে স্কুল আসব না বলে পুকুর পাড়ে পাড়ে দৌড়াচ্ছি, পিছনে লাঠি হাতে বাবা। সেটা অভিভাবক না করলে আমরা কি করব? তাছাড়া একদম ধরে ধরে শেখাতে গেলে একটা ক্লাসে দশ জনের বেশি স্টুডেন্টকে দেখানো যায়না। তাহলে দশ জন ছাত্র পিছু একজন শিক্ষক দিতে হবে। যা সম্ভব নয়। ছেলেমেয়েরা মোটামুটি চার ঘন্টা স্কুলে থাকে, বাড়িতে কুড়ি ঘন্টা। আমরা সব শিখিয়ে দেবো বললে কি করে হবে ? আর শিখিয়ে দিলেই হবে? অভ্যাস না করলে মনে থাকবে?নিয়মিত পড়াশোনা না করলে শেখা কোনভাবেই সম্ভব নয়। অভ্যাস বাড়িতেই করতে হয়।
বললাম গরীব মানুষের অত সময় কোথায়? তার তো অন্ন চিন্তা চমতকারা! তিনি বলেন দেখুন এখনতো ভিড় বাসে পা মাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে অজুহাত হিসাবে লোকে বলছে কী করব গরীব মানুষ! সবে এই গরীব মানুষ যুক্তিটা খাটেনা। গরীব বলেই আরো বেশি করে পড়াটা দেখা উচিত, যাতে তার সন্তানও গরীব না থেকে যায় । এই তো অক্ষয় বলে একটি ছেলের বাবা নিয়মিত স্কুলে খোঁজ নিতে আসতেন। শুধু প্রাইমারি নয়, দেখেছি হাই স্কুলেও যেতেন। তিনিও গরীব, নিজে বিরাট কিছু পড়াশোনাও জানতেন না। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। কিন্তু সন্ধ্যায় ছেলের কাছে বসতেন। ছেলেটি খুব বুদ্ধিমান ছিল এমন নয়। কিন্তু এখন রেলে চাকরি করছে। গার্ডিয়ান কে স্যাক্রিফাইস করতে হবে। সকাল সন্ধ্যা পড়তে বসার অভ্যাসটা করানো তো তার দায়িত্ব। না এটাও আমাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে করতে হবে? এইতো একজন হাই স্কুলের মাস্টারমশাই বলছেন জৈন বুক ব্যাংক থেকে ফ্রি তে কিছু বই দেয়। সে বই নাকি অনেক পড়ে আছে। কেউ নেয়নি। সবাই যদি এতই গরীব বইগুলো নেয়নি কেন?
আচ্ছা কখনো কখনো পেপারে, সমাজমাধ্যমে যে দেখি ছেলেমেয়েরা এই ব্যবস্থাতেই কত সুন্দর শিখছে। কত আকর্ষক ভাবে তাদের শেখানো হচ্ছে। তিনি বললেন ওসব ছাড়ুন। বেশিরভাগটাই লোক দেখানো। দেখবেন সবাই পড়ানোর ভিডিও দেয়। আউটকাম কি সেটার ভিডিও দেয়না। দিলেও এডিট করতে কতক্ষণ! তাছাড়া দু একটা মডেল সাধারণ নিয়ম নয়। আপনি আমার সামনে করে দেখান তো! আপনার পাশেই তো আমার স্কুল। আপনি না পারেন ডেকে আনুন যারা পারেন। আমার চোখের সামনে করে দেখাক। একদিন দুদিন দেখিয়ে দিলে হবে না। ওটা সবাই পারে। অগত্যা রণে ভঙ্গ দিতেই হল।
নিজের শৈশব বা আপনার নিজের সন্তানের শৈশবের কথা মনে করে দেখুন একবার। স্কুলে এবং বাড়িতে নিরন্তর, নিয়মিত কত অনুশীলনের ফলে শেখা গেছে রিডিং পড়া। কত ভাগ তার; আ কার, এ-কার ও কার, য-ফলা রেপ, যুক্তাক্ষর - সব মনে রাখতে হয়েছে। যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ কত ছোট ছোট নিয়ম সে সবের। এখন আপনার সোজা লাগলেও বাচ্চার কাছে কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সোজা না। কড়া তত্ত্বাবধানে নিয়মিত অনুশীলন করলে তবেই শেখা সম্ভব, অন্যথায় নয়। অথচ প্রাথমিক শিক্ষাই সবথেকে বেশি অবহেলিত। সবাই অত্যন্ত ছোট চোখে দেখে প্রাথমিক শিক্ষাকে। সকলে মিলে শিশুদের পায়ে মারে। অবোধ শিশু বুঝতেই পারেনা যে সকলে মিলে তাকে খোঁড়া করছে। সে দিব্যি আনন্দে এদিক ওদিক ঘুরে, প্রায় কোন রকমের কোন বিদ্যা আহরণ না করেই মূল্যবান শৈশবটি ব্যয় করে ফেলে। ভবিষ্যতে তারা আর কোনদিন উঠে দাঁড়াতে পারে না শিক্ষার ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে ধর্মগুরুরা অতি সহজে লোককে বশে আনতে পারে। অগণিত মানুষ নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে পদপৃষ্ট হয়ে মারা যেতে পারে গুরুর দর্শন লাভের আশায়। অতি সহজে তাদের প্ররোচিত করা যায় প্রতিবেশীর রক্তে হাত রাঙাতে, আইন বিরুদ্ধ কাজ করতে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সামান্য চেষ্টায় বায়াস করে দিতে পারে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে। কেন পারে তার মূলটি এই অশিক্ষাতেই নিহিত। তবে হতাশ হবেন না। শুধু একবার ভেবে দেখুন এই দেশে মোটামুটি দুশো বৎসর আগে জন্মেছিলেন বিদ্যাসাগর, দুশো পঞ্চাশ বছর আগে রামমোহন।
7 Comments
Boro bhalo laglo 🙏🙏🙏🙏
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDeleteমানুষ শিক্ষা চান কিছু আমদানীর জন্য, চাকরী হবে বলে। স্কুলে খাবার পাওয়া যাবে বলে। আর তো কোন কারণ নেই শিক্ষার। শিক্ষার জন্য গার্জেনকে সারা দিন খাটনির পরে কেন আবার পরিশ্রম করতে হবে তার সন্তানের জন্য? আর ভাল ইস্কুলে পড়লে ভালো কলেজে পড়া যাবে, ভালো কলেজে পড়লে ভালো কোম্পানী থেকে ডাক আসবে। সরকারী চাকরি বা শিক্ষক হিসেবে চাকরির কথা নাই বা বললাম। আপনার লেখায় গলদ গুলো সমস্যা গুলো খুব সুন্দর ও বিশদভাবে ফুটে উঠছে। যারা ভুক্তভোগী তারাই হয়ত পড়ছে ও মাথা নাড়ছে, কিন্তু এর বিহিত কে করবে? বড় বড় শিক্ষিত অধ্যাপক অধ্যক্ষ মন্ত্রীরা কি তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা, বিদেশ যাত্রা ও নীচু স্তরে কোচিং করে ধনী হবার চেষ্টাই করে যাবেন? শিক্ষার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে না উঠলে আর এই হাজার রকম ইস্কুল ফিস্কুল বন্ধ না হলে, আমরা কিছু এলিট ছাত্র হয়ত পাবো কিন্তু তাতে বিশ্বসংসারের কারো কোন উপকার হবে না। আরো লিখে যান স্যার, সবাই একটু ভাবুন।
ReplyDeleteনা বিহিত কিছু নেই। এই তুলে ধরাটা একধরনের আত্মসুখ।চুলকুনি সারানোর উপায় না থাকলে যেমন চুলকে আরাম হয়।আপনারা পড়ছেন এই আমার পরম পাওয়া।
Deleteঅভিভাবক কেন বাড়তি শ্রম করবে এটা সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে পড়তে বসার অভ্যাস অভিভাবক না করলে সে ছেলে হারিয়ে যাচ্ছে। স্কুলেই তৈরী হয়ে যাবে এমন স্কুল আমাদের নেই। সমন্বয় না থাকলে হওয়া মুশকিল। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া
লড়াইয়ের ময়দানে এখন টিকে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে।
ReplyDeleteকবে, কীভাবে যে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে যে সরকারি স্কুলে পড়াশোনা কিচ্ছু হয়না, সব হরি ঘোষের গোয়াল হয়ে উঠেছে তা আমার জানা নেই। তবে বুঝতে পারি এসব হলো নব্য সমাজের ফসল। অভিভাবকদের অনেকের কাছেই শিক্ষার নিহিতার্থ
স্পষ্ট নয়। এরফলে এই সময়ের শিক্ষায়তন গুলোতে
এক বড়ো রকমের অপূর্ণতা তৈরি হয়েছে।
অভিভাবকদের অনেকের কাছেই শিক্ষার নিহিতার্থ
স্পষ্ট নয়। এরফলে এই সময়ের শিক্ষায়তন গুলোতে
এক বড়ো রকমের অপূর্ণতা তৈরি হয়েছে। সর
শিশুরাও আজ এক বড়ো রকমের দোলাচলের শিকার। অভিভাবকদের অনেকের কাছেই সন্তানেরা এক্সপেরিমেন্ট করার উপকরণ। ফলে সকালে শেখার আর বেলায় পাবার স্কুলে হাজিরার পর সন্ধ্যায় ঝালাইয়ের কারখানায় যোগদান। আমাদের সময়ের সঙ্গে কোনোভাবেই এই সময়কে মেলানো যাবে না।
ReplyDeleteনষ
ঠিকই বলেছেন।কোনভাবেই মেলানো যায় না।
Deleteসবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেছেন।শিক্ষার নিহিতার্থ অনেক অভিভাবকই বোঝেন না।