মায়ের জন্য সব করতে পারি
চিন্ময় দাশ
মা আর এক ছেলে হেনরি, এই দু’জন নিয়েই তাদের পরিবার। অভাবের সংসার। হেনরি তেমন বড় হয়নি এখনও। মা খেটেখুটে সংসার চালায়।
হঠাৎ একদিন মা পড়ল অসুখে। অসুখ বলে অসুখ। কিছুতেই সারে না। শেষে, গঞ্জে গিয়ে এক বদ্যিকে ডেকে আনল হেনরি। অনেক সময় নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল বদ্যিমশাই। হাত দেখে, পা দেখে। চোখ দেখে, কান দেখে। বুক দেখে, মুখ দেখে।
শেষে বলল—বড় কঠিন ব্যারাম, হে। সহজে সারবার নয়।
মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ল হেনরির। মা না থাকলে, দুনিয়া অন্ধকার। নিজেও তো বাঁচবে না সে। কেঁদে বুক ভসাতে লাগল।
বদ্যিমশাই বলল—একটা মাত্র উপায় আছে। কিন্তু সে কি তুমি পারবে, বাছা। একটু কঠিন কাজ।
--তুমি বলো, কী সে কাজ? মায়ের জন্য সব করতে পারি আমি।
--তিন-চারটে গ্রাম পেরিয়ে একটা বন। বনে ঢুকবার আগে একটা পাহাড় আছে। সেই পাহাড়ের মাথায় আছে একটা লতা। তার মূল তুলে আনতে হবে তোমাকে। তাতেই তোমার মাকে বাঁচাতে পারি।
বন পাহাড় সে তো অনেক দূরের পথ। কিন্তু ঘাবড়ে গেলে চলবে না। যত কষ্টই হোক, মাকে সারিয়ে তুলতেই হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল হেনরি।
পাহাড়টার কাছে পৌঁছল যখন, এক বিপদ। রাস্তা এসে শেষ হয়েছে যেখানে, সামনে একটা খাদ। উঁকি দিয়ে দেখল, এতই গভীর যে তল নাই বলে মনে হয়। এদিকে এতটাই চওড়া যে লাফ দিয়ে পার হওয়াও যাবে না কোন মতেই।
কোথাও তো শেষ থাকবে খাদটার—এই ভেবে খাদের কিনার ধরে হাঁটতে শুরু করল ছেলেটা। তখন আর এক হয়রানি। হাঁটছে তো হাঁটছেই। পথের যেন শেষ নাই। এক সময় খেয়াল করল, যেখান থেকে শুরু করেছিল, সেখানেই ফিরে এসেছে এখন।
তার মানে দাঁড়াল, পুরো পাহাড়টাকে ঘিরে রেখেছে এই খাদটা। মহা সমস্যা হোল। কী করা যায় এখন?
চোখে জল এসে গেল হেনরির। কী করে পার হওয়া যাবে এই গভীর খাদ! একটা পাথর দেখে বসে পড়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, যদি কোন উপায় খুঁজে পাওয়া যায়।
কথায় বলে, বিপদ কখনও একা আসে না। আসে যখন, দল বেঁধে আসে। এখনও তাই হোল। হঠাৎ পিছনে একটা গম্ভীর গর্জন শোনা গেল। চমকে গিয়ে পিছন ফিরতেই, ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল তার।
বড়জোর হাত দশেক দূরত্ব। একটা নেকড়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ দুটো জ্বলছে আগুনের ভাটার মতো।
নেকড়ে গর্জন করে উঠল—আমার রাজ্য এটা। কেন ঢুকেছ এখানে? কী খুঁজছো তুমি?
হেনরি বলল--মাফ করো আমাকে। ঘরে আমার মা মরতে বসেছে। একটা লতা আছে এই পাহাড়ের মাথায়। সেটা খুঁজতে এসেছি আমি। এখন তুমি যদি এই খাদটা পার হতে সাহায্য করো, কথা দিচ্ছি, সারা জীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব। তুমি যা হুকুম করবে, মাথা পেতে পালন করে যাব।
মায়ের অসুখ শুনে, নেকড়ের গলা নরম। সে জবাব দিল—ঠিক আছে। এই জঙ্গল থেকে আমার জন্য যথেষ্ট পশু আর পাখি শিকার করে আনতে হবে তোমাকে। কাটাকুটি করে আগুনে ভাপিয়ে দিতে হবে। যদি পারো, তাহলে এই মহান পাহাড়ের নামে শপথ করে বলছি, আমি সব সাহায্য করব তোমাকে। পিছন ফিরে দ্যাখো, কাজের জন্য দরকার মতো জিনিষপত্র সব সাজানো আছে।
--কাজ হয়ে গেলে, ডাক দিও। আমি এসে যাবো। বলে নেকড়ে চলে গেল।
মনে বেশ বল এলো হেনরির। সত্যিই সব জিনিষ সাজানো ছিল একটা গাছের তলায়। একটা ধনুক আর তীর তুলে নিয়ে শিকারে বেরুল সে। বনমোরগ, তিতির, স্টারলিং – কত রকমের পাখি, ছোট রো হরিণ, এল্পাইন ছাগল, কত কিছু পশুপাখি এই বনে। কিন্তু তীর ছুঁড়লেও, একটাও শিকার করা যাচ্ছে না। কারণটা মাথায় ঢুকছে না তার।
অবাক ব্যাপার। তিন তিনটে দিন কেটে গেল বনে ঘুরে ঘুরে। একটা শিকারও জোটেনি তার ভাগ্যে। অসহায় হয়ে যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছে, একটা কাক চোখে পড়ল।
হেনরির মনে পড়ে গেল, বাড়ি থেকে আসবার সময়, পথে একটা অসুস্থ কাকের সেবা করে প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
কাক বলল—আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে বঁচিয়েছিলে তুমি। আমি কথা দিয়েছিলাম, একদিন আবার দেখা করব তোমার সাথে। আজ কথা রাখতে এসেছি।
হেনরি তো মহা খুশি। হলই বা ছোট্ট একটা পাখি। তবুও একজন সাথী তো জুটল। কাক বলল— খুব সাবধান এখানে। তুমি যদি উপযুক্ত পরিমাণ শিকার করে উঠতে না পারো, তুমিই নেকড়েটার শিকার হয়ে যাবে।
হেনরি বলল—ঠিক বলেছ। আমার এখন সেই অবস্থা। তিন দিন চেষ্টা করেও হাত আমার শূণ্য।
--দুশ্চিন্তা কোর না। আমি তোমার শিকার করে দিচ্ছি। তুমি সাথে থাকো। তোমার কাজ হোল সব কুড়িয়ে তুলে, রান্না করে ফেলা। বলেই ডানা মেলে, গাছগুলোর মাথার উপরে উঠে গেল কাক। একজোড়া সূচালো ঠোঁট আর চার জোড়া ধারালো নখ আছে কাকের। তাই দিয়ে শিকার করছে আর নীচে ফেলছে।
টানা তিন দিন ধরে চলল তার শিকার। কত পাখি আর কাঠবিড়ালি, বানর, গেছো ইঁদুর ইত্যাদি যে মারা পড়ল তার ইয়ত্বা নাই। সব শিকারের পালক আর চামড়া ছাড়িয়ে যত্ন করে রান্না সেরে ফেলল হেনরি।
কাক বলল—শোন, হেনরি। আরও একটা বাধা আছে তোমার সামনে। তবে সেসময় আমি তোমার সাথে থাকতে পারব না। তবে, চিন্তা কোর না। একদল পরীর সাথে দেখা হবে তোমার। তারাই সাহায্য করবে তোমাকে। বলেই কাক চলে গেল।
হেনরি হাঁক দিল—খাবার তৈরি। চলে এসো।
নেকড়ে এসে গেলে, হেনরি বলল—তোমার এই বনে যা পাওয়া যায়, তার থেকে বেছে বেছে শিকার হয়েছে। এবার খেতে বসতে পারো।
খাবারের স্তুপ দেখে নেকড়ে তো মহা খুশি। এটা ওটা তুলে চিবিয়ে, চেখে পরীক্ষা করে নিল। চোখে মুখে বেশ আনন্দের ছাপ। ঠোঁট চাটা শেষ করে নেকড়ে বলল—তোমার কাজে আমি খুশি। বিনা পুরষ্কারে নেকড়ে রাজার কাজ করে দিয়েছ—এ কথা বলবার সুযোগ দেব না তোমাকে। তোমার শ্রমের মূল্য দেব আমি।
বলে, বন থেকে একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে আনল নেকড়ে। সেটা হেনরির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল—এটা রাখো। পাহাড় থেকে লতা জোগাড় করে, যেখানে যেতে চাইবে, এটাতে চড়ে বসো। এটাই তোমার ঘোড়ার কাজ করবে।
অদরকারি একটা জিনিষ ভেবে, ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছিল হেনরি। কিন্তু মনের অসন্তুষ্ট ভাবটা নেকড়েকে দেখাতে চাইল না। হাসি মুখে লাঠিটা নিয়ে নেকড়েকে ধন্যবাদ জানাল। নেকড়ে বলল—এবার আমার শেষ কাজ। পিঠে চড়ে বসো আমার। ওপারে পৌঁছে দিচ্ছি তোমাকে। পিঠে চড়ে বসতেই, প্রচণ্ড এক লাফ নেকড়ের। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে হেনরি। চোখ খুলবার আগেই, খাদ পার হয়ে ওপারে নেমেছে নেকড়ে।
নেকড়ের পিঠ থেকে নেমে, হেনরি ধন্যবাদ জানাল নেকড়েকে। আবার এক লাফ। চোখের সামনে যেন একটা বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। নেকড়ে মুছে গেল চোখের সামনে থেকে।
খুঁজে খুঁজে লতা জোগাড় করেছিল হেনরি। তারপর? তার পর সেই অদরকারি ভাবা লাঠিখানায় চড়ে বসতেই, অবাক কাণ্ড!
খাদ তো পার হোলই। মাটিতেও নামতে হয়নি হেনরিকে। বনের ওপর দিয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে, একেবারে নিজের কুঁড়েঘরের উঠোনে এসে হাজির হয়ে গেল।
তারপর? কোবরেজ মশাই এসে ঔষধ বানিয়ে মাকে সারিয়ে তুলল। মায়ে-পোয়ে সুখে দিন কাটতে লাগল দুজনের।
প্রকাশিতব্য...
0 Comments