জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব ১৮/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব ১৮
                       
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 

আর একবার যদি নাও খেলায়...

স্পোর্টস এসে গেছে স্পোর্টস। মাদুর পেতে পড়তে বসতে বসতে ছোড়দা ঘোষণা দেয়।কে এসেছে?মাথায় তো গোবর ছাড়া কিস্যু নেই! আরে হাঁদারাম,স্পোর্টস মানে খেলা। স্কুলে খেলার হবে।যে জিতবে প্রাইজ পাবে প্রাইজ!তোদের প্রাইমারি সেকশানেও তো হবে। নাম দিসনি? দাঁড়া, কাল টিফিনের সময় তোদের ক্লাস টিচারের কাছে গিয়ে দিয়ে আসবখন,কিছুইতো পারিস না ,হাঁদারাম একটা। আমি খুব দৌড়োই জানিস,ঝিনি গম্ভীর মুখে বলে।আচ্ছা,দেখা যাবে,বোনের মাথায় হাল্কা চাঁটা লাগায় সে।
            স্পোর্টসের দিন দৌড়ে অবশ্য মোটেও সে পারে না,তার পাশ দিয়ে শনশন ফনফন করে সব্বাই বেরিয়ে যায়। স্কিপিংএ চারজনের পরেই সে আউট। মনোযোগ পরীক্ষাতেও সে হুশহুশ করে পাখি টাখির সঙ্গে গাছ, বাড়ি  সবই উড়িয়ে দেয়। অ্যাই ঝিনি,ঠিক করে খেলবি,এরপর টমেটো দৌড় তোদের,এটাই তোর লাস্ট চান্স,দাদামনি এসে বলে যায়,খুব তো দৌড়লি ছোড়দা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে।
       মাঠের অন্যদিকে দাদাদের খেলা। দৌড় আর লং জাম্পে জিতে গেছে ওরা হাই জাম্পেও নাম ডাকছে বলে দৌড়ে গেল ওদিকে। বুকে লাল ফিতে আঁটা ভলান্টিয়ার সব বড় দাদারা তাদের হাত পেছনে বেঁধে  লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। তাদের প্রত্যেকের পিঠে লাল আলতা দিয়ে নাম্বার সাঁটা আছে।মাইকে শের আলী স্যার নাম ধরে ধরে নাম্বার বলে দিচ্ছেন।
        বাঁশি বাজতেই তারা দৌড়ে গেল কিন্তু সুতো বাঁধা টমেটোগুলো এতই নাচানাচি করে যে হাত বাঁধা অবস্থায় ঝিনি কামড়াতেই পারছিল না।কে যেন তার আগেই পাশের টমেটোতে কামড় বসালো  জোর আর টমেটোর একখানা বীজ ছিটকে এসে ঢুকলো তার চোখে।এক চোখ বুজে মুখে টমেটো নিয়ে সে যখন চুন টানা দাগের ওধারে পৌঁছলো, বুবাই ঝুমা মাজিদারা তার আগেই পৌঁছে গেছে। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড নাম ঘোষণার সাথে সাথে ওরা লাফিয়ে উঠে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে নমস্কার জানালো, হাত নাড়ল হাসল আর মাঠের বাইরে দর্শকরা হাততালি দিল চটপট।
             এর তার  ফাঁক গলে সে বেরিয়ে আসে ভিড় থেকে। একা একা মস্ত মাঠের এক্কেবারে শেষে  হলুদ ফুলে ভরা এক বাবলা গাছের তলায় এসে দাঁড়ায়। ভেতরে কী যে হচ্ছে  বুঝতে পারছে না, সে আবার কি কিছু হারিয়ে ফেলল নাকি?দাদারা পেরেছে, সে কিছু পারেনি, না পারলে সে ঝিনি কি করে হবে? তাদের বাবা যদি বাড়ি ফিরে দাদাদের প্রাইজ দেখে জিজ্ঞেস করে ঝিনি কী পেল দেখি, তখন সে করবে কী?দাদারা যে বলে সে মন্টু বিড়িদের মেয়ে,সত্যি কি সে  কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে নাকি? তাই সে কিচ্ছু পারে না? বাবলা গাছের আড়ালে এসে ফুঁপিয়ে ওঠে ঝিনি।খেলনা ভাঙা,মার বকুনি বা স্কেলপেটা, দাদাদের যম খ্যাপানো বা চড়চাপড় নয়,নগেন স্যারের থাপ্পড়েও নয় হলুদ ফুলের আবছা অন্ধকারে দাদারা যখন তাকে খুঁজে পেল,এসবের বাইরে হেরে যাওয়ার প্রথম দুঃখেই সে লুকিয়ে কাঁদছিল।
      ইয়ার্কি পেইছিস? তখন থেকে গরু খোঁজা খুঁজছি সবাই আর ঘাপটি মেরে দিব্যি এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে!প্রাইজ দেওয়া হচ্ছে তো তোদের প্রাইমারি সেকশনে। তোকে আসিফ স্যারও খুঁজছে।  আসিফ স্যার আমায় কেন খুঁজবে?একটু পরেই প্রাইজের জন্য তোর  নাম ডাকবে যে। আমি তো খেলায় পারিইনি। আরে টু থেকে থ্রি তে উঠলি যে সেকেন্ড হয়ে বোকারাম। প্রথম তিনজনকে বই প্রাইজ দেওয়া হয়। সত্যি? না তো কি?আমি আর মিতু খেলার প্রাইজের সাথে  প্রতিবার বই পাই দেখিসনি। গতবার যে আমি রবিনহুড পেলাম আর তুই সেটায় পেন দিয়ে তোর নাম লিখলি বলে মা'র কাছে কানমলা খেলি মনে নেই? তুইও তো মারলি সেদিনকে; আবার মা'র কাছে বলেও দিলি? রোজ রোজ তোরা নালিশ করিস বালিশ পাস! ঠোঁট ওল্টায় সে।হেসে উঠে দাদামণি বলে আচ্ছা আজ বাড়ি গিয়ে ও বইটা তোকে দিয়েই দেব। সত্যি দানি? খুশিতে দাদামণির কাঁধ ধরে ঝুলে পড়ে সে।
        এখন দৌড়ো।নাম ডাকা হয়ে গেলে মুশকিল। বিশাল মাঠের অন্য প্রান্তে প্যান্ডেলের দিকে দৌড় লাগায় সে দাদাদের সাথে।
        কাঁচের টেবিল ল্যাম্প, রুপোলি হাঁস,ফুলদানি আর বই পেল দাদারা, ছোড়দা আবার টফিভর্তি চ্যাপ্টা একটা কৌটোও পেয়েছে।ঝিনি বনফুলের 'রাজা ' বলে একটা বই পেয়েই খুশিতে ডগোমগো হয়ে বলল দানি ভাগ্যিস ফার্স্ট হইনি। ফার্স্ট হয়ে সমীর পেয়েছে টুনটুনির বই। কিন্তু ও বই তো আমার আছে।আর এই রাজা বইটার মলাটাটা দ্যাখ, কী সুন্দর গোলাপি ওড়না পরে পরী উড়ছে আর ঝর্ণার ধারে রাজা বসে দাড়ি কামাচ্ছে আর চমৎকার গন্ধ বইটাতে শুঁকে দ্যাখ।
        আরে গাধা ফার্স্ট হওয়া মানে সব চাইতে ভালো যে রে! কিন্তু যে বই আছে সে বই আবার নিয়ে কী করব? অসম্ভব! ছোড়দা বলল,বোঝায় কার সাধ্যি,মন্টু বিড়ির মাথায় গোবরগুলো সবই যে ঘুঁটে হয়ে গেছে!অনেক প্রাইজ আর স্যারদের ভালো ভালো কথায় অরুর মনমেজাজ খুবই ভালো। তবু বোনের বোকামোতে অরুও হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে।
           আর দাদাদের মুখে ঝিনির কথা শুনে চোখ গোল করে গালে হাত দিয়ে মা বসল তাকে মন দিয়ে ফার্স্ট হওয়ার উপকারিতা বোঝাতে।  কিন্তু নতুন উত্তেজনায় ঝিনির কানে সে সব ভালো ঢুকলোই না কেননা হেম এসে গেছে ছোট দুই ভাইবোন মহুল আর সানাকে নিয়ে। গোল মতো বছর দেড়েকের সানাটা তো এক্কেবারে  পুতুল। মহুলটাও খুব ন্যাওটা তার।
      সবসময়ই পেছন পেছন ঘোরে তবে দাদারা এতো পাজি প্রায়দিন তাকে ক্ষেপিয়ে তুলে মজা দ্যাখে। কিরে মহুল কেমন ছেলে তুই ঝিনির সঙ্গেই পারিস না বলামাত্র কোনো কথা নেই মহুল এসে ধাঁই ধপাধপ চড়াও হবে ঝিনির ওপর। আবার একটু পরেই এই দিদি তোর লেগেছে দেখি কোথায় লেগেছে বলে ব্যথা জায়গায় আঙুলে করে থুতু লাগাতে আসে। মহুলের সেসব সেবা শুশ্রষা এড়াতেও তখন দৌড় দিতে হয় ঝিনিকে। 
         বারান্দা থেকে কখানিকটা হেঁটে এসে ঝিনিদের বাড়ির গেট খুললেই পাকা রাস্তা।বাস লরি ভ্যান সব যায় হরদম।ভরদুপুরে গেট খুলে রাস্তার মাঝখানে দু হাত ছড়িয়ে একদিন দাঁড়িয়ে পড়েছিল ভাই। মিলিটারি গাড়ি থামিয়ে নেমে আসেন অফিসার। ফুটফুটে মহুলকে কোলে নিয়ে মাথার টুপিটা পরিয়ে দেন।ততক্ষণে হইহই করে সবাই বেরিয়ে এসেছে। এলোমেলো শাড়িতে খালিপায়ে দৌড়েছে হেমও। টুপি মাথায় মহুল অফিসারের কোলে চড়ে ফিক ফিক হাসছে, আর আমাদের সঙ্গে যাবে শুনেই ঘটঘট করে মাথা নেড়ে বলছে যাব,বন্দুক দাও। সবাই তো অবাক।
       মা সেবার যথারীতি শীত গ্রীষ্ম না মেনে ঝিনিকে ন্যাড়া করে দিয়েছে।আর দাদারাও রোববারের দুপুরে কম্ম না পেয়ে হ্যাঁরে মহুল তুই না বীর!মিলিটারিদের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়িস তবে ঝিনি তোকে হারায় কি করে ছ্যা!ছ্যা!শীতের  দুপুরে দাদাদের কথায় তেতে উঠে মহুল পেতলের খুন্তিখানা রান্নাঘর থেকে বাগিয়ে এনে পেছন থেকে ঝিনির মাথায় বসিয়ে দিল। 
         ঝিনি পুতুল খেলছিল।ন্যাড়া মাথায় পেছন থেকে অতর্কিত হানায় চেঁচিয়ে উঠে মাথা চেপে ধরল। মেজে মেজে পাতলা আর ধারালো হয়ে গেছে সে খুন্তি আর বছর তিনের হলেও গাট্টাগোট্টা মহুলের গায়ে জোরও কিছু কম ছিল না।ওরে মারে,মাইরে ফ্যাললো ছেমড়িডারে রুবিদির চিৎকারে ছুটে এলো সবাই।গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে মাথা কেটে।
        গাঁদা ফুলের পাতা থেঁতো করে লাগালো রুবিদি।মা তুলোয় ডেটল নিয়ে চেপে ধরলো। নিজের কৃতকর্মে যারপরনাই অনুতাপে শনমলম মলম বলে মহুল দৌড়ে এক ঘটি জল নিয়ে এসে দাঁড়াতেই পাছো!বান্দর ছ্যমরা !রুবিদি ধমক দিল মহুলকে আর হেম চড় বসিয়ে দিল গালে। ওকে মারিস না ভাই, বাপি এসে দাঁড়িয়েছে এবার।ঝিনিকে কোলে নিয়ে ভ্যানে চড়ে শংকর ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে গেল বাপি। সেলাই লাগবে না।ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।আর টিটেনাস ইনজেকশন। দুদিন পর ব্যান্ডেজ খুলে এই মলমটা লাগাবেন।
        সন্ধেবেলা ছাদে বসে চাঁদের আলোয় গল্প করছে সবাই। চা আর মুড়ি মাখা খাচ্ছে। ঝিনি আর মহুল চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি খেললো এক পক্কড়। হাতের ওপর হাত দিয়ে বলতে হয়
     চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি/পাতে পড়ল ফুলবড়ি/ফুলবড়িটা গলে গেল/সবাই মিলে এক পা তোলো
আর এক পায় কে কতক্ষন দাঁড়াতে পারে। যার পা পড়ে যাবে সে হেরো।
         অরু মিতু শোনো, তোমরা তো বড় দাদা। বড়দের  দায়িত্ব হলো ছোট ভাইবোনদের দেখেশুনে রাখার। তোমরা বোনের সঙ্গে মজা করো ঠিক আছে কিন্তু অকারণে মহুলকে ক্ষেপিয়ে তোলো কেন?এর কোনো কারণ থাকলে বলো। মহুল তো কিছুই বোঝে না।ঝিনির আজ বড় কোনো বিপদ হতে পারত। আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি তোমাদের এই আচরণে।দাদারা কথা বলছিল না। তাদের বাবা কখনো ধমকায় না, মায়ের মতো বকুনি কানমলা বা চড় চাপড় দেয় না।শুধু কেন করেছো তার কারণ বলতে বলে। 
         সানাকে নিয়ে হেম যা যা করে ঝিনি ও তার পুতুলের সঙ্গে তাইই করার চেষ্টা করে। পুতুলের নাম মল্লিকা। আমেরিকা থেকে কাকু সেবার জামা কাপড়, রঙিন উলের লম্বা মোজা, কাকিমার তৈরি কেকের সঙ্গে এই টুকটুকে পুতুল এনে দিয়েছিল শুয়ে দিলে যে চোখ বন্ধ করে আবার দাঁড় করালেই  পাপড়ি দেওয়া চোখের পাতা খুলে নীল চোখে তাকায়। আগে ঝিনি এমন পুতুল দেখেনি।তার জামা প্যান্ট,জুতো সব আছে। লম্বা দুই বিনুনি খুলে চুল আঁচড়ে আবার বেঁধে দেয় সে। ছোট দুটো ফ্রক বানিয়ে দিয়েছে মা মল্লিকার।
      শীতকালে  হাতপায়ে মাখার জন্য কাচের শিশিতে দুধের মতো শাদা তুহিনা বা বসন্ত মালতী  কিনে আনে মা। হেমের মতো করে পুতুলের মুখে ঝিনি বসন্ত মালতীর বোতলখানা ঠুসে ধরে তারপর  ঘুম পাড়িয়ে গায়ে বড়মাসির বোনা কাঁথা ঢেকে চট করে তার রঙিন ছোট্ট ছাতাটা মেলে ঢেকে দেয়। মশারি টাঙিয়ে দিল আর কি।  তবু মল্লিকার চাইতে সানাকে কোলে নিতে পারলে  বেশি খুশি লাগে। মল্লিকা তো  বাড়ছেই না আর সানা কেমন বড় হচ্ছে একটু একটু করে। আধো আধো কথা শোনার জন্য বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে যায়।
      সানা একেবারে ছোট্ট ছিল যখন হাত পা ধুয়ে কাচা জামা পরে ঠায় বসে থাকত ঝিনি, বোনের দিকে তাকিয়ে।ফেলে দেব না মোটেও। সাবধানে নেব।দে না একটু কোলে, ও হেম।
         আর এখন তো কোলে চড়ে দুলে দুলে সে ছড়া বলে খোকা যথন তাদলো/বুকে থেল বিধলো/খোকা যথন হাথলো/লথথো মানিক থসলো...তার দুধে দাঁতের হাসিতে সত্যিই লক্ষ মানিক ঝরে পড়ে।লুকোচুরি খেলা শিখে টলমল পায়ে দরজার ওপাশে গিয়ে বলে তুকিইই দাপ্পা।
🍂
         মহুলও খেলার সঙ্গী হয়ে গেছে কবেই।তারা এখন জাহাজে করে পাড়ি দেয় সমুদ্রে মানে দাদাদের বাইনোকুলার গলায় ঝুলিয়ে ওয়াটার বটলে জল আর বাবার পুরনো সাইড ব্যাগে বিস্কিট  আম কলা এসব খাবার ভরে হিম সাগর বা ল্যাংড়া আম গাছে চড়ে  নতুন দ্বীপ আবিষ্কার চললো। সে সমুদ্রে অবিকল গল্পের বইয়ের মতো ঝড় উঠত।দিক হারিয়ে চলতে চলতে পরদিন ভোরে তারা অবশ্যই দেখতে পেত নতুন কোনও দ্বীপ সেখানে জাহাজ নোঙর করে পাখি শিকার করে আনত তারা।মিছিমিছি আগুনে সেই মৃত পাখি ওরফে শুকনো কলার পাতা ঝলসানো হতো
      খাবার শেষ,জল ফুরিয়েছে এমন সময় দূরের কোনো গাছ দেখিয়ে ওই যে অন্য জাহাজ চলেছে,বাঁচাও বাঁচাও বলে মহুল জামা খুলে ওড়াতে শুরু করে। বাইনোকুলার চোখে চেঁচায় দেখেছে! দেখেছে! ক্যাপ্টেন ঘুরিয়ে দিয়েছে জাহাজের মুখ!এইসব বলে টলে আবার ল্যাংড়া গাছে খানিক চড়ে বাকি আম কলা শেষ করে নেমে আসে তারা সফল অভিযানের শেষে।
       ছোটমাসিও ঝুম আর টুকুন কে নিয়ে ছুটিতে এলে দাদারা দুটো খুঁটি পুঁতে মা'র পুরনো শাড়ি দিয়ে তাঁবু বানিয়ে ফেলে ঝটপট। তাঁবু নয় আসলে তা দুর্গ। অচিরেই শুরু হয় দুর্গ দখলের যুদ্ধ। সরু পাটকাঠির ফ্রেমে সার সার মোটা পাটকাঠির সত্যি কামান বসানো।
      ভাইবোন তারা দু'দলে ভাগ হয়ে লড়ছে।কখনো পিছু হটছে কখনো বুকে হেঁটে পাটকাঠির বন্দুক চালাচ্ছে গুড়ুম।দুম দাম কামান চলছে মুখে। কেউ  যুদ্ধবন্দী হলে তাকে উদ্ধার করতে বাকিরা লড়ছে। চল চল চল আমাদের দুর্গে চল বলে সাঁই সাঁই অদৃশ্য তরোয়াল চলছে আর সবাই গড়িয়ে পড়ছে ঘাস মাটিতে। সন্ধের গোড়ায় মা বা হেম লাঠি হাতে এসে দাঁড়াতেই সেনাপতিসমেত কাদামাটিমাখা সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ।
       সেসব ছেঁড়া ঘুড়ি,টুটাফাটা বল,তার খুলে আসা ব্যাডমিন্টন রাকেট ধবধবে শাটল ককের সাথে উড়তে উড়তে বলে হাত পা ভাঙা পুতুল সে হারালো কোথায়?চাইনিজ চেকার্সের বোর্ড ব্যাগাডুলির লোহার বল গুনতে গুনতে এগিয়ে আসে।কাঠের রাজাকে কিস্তি বলে মিটমিট করে হেসে অরু ফের আড়াই চাল দিয়ে বসে ঘোড়ার। ইল্লি! এক্ষুণি সরা নাইলে নৌকো দিয়ে এই তোর রাজার মুণ্ডু ঘ্যাচাং বলে ওঠে মিতু। জানলার রড ধরে ঝুলতে ঝুলতে ওদের খেলা দেখে ঝিনি আর বকবক করে;হাতি যায় কোণাকুণি, নৌকো যায় সোজা কিন্তু বোড়ে যদি সোজাও যায় কোণাকুণিও যায় তা'লে তো বোড়ের শক্তি সব 'চে বেশী!
   বই থেকে মুখ তুলে বাবা বলে অবশ্যই!সব দেশে সবখানে সাধারণ মানুষের শক্তি সব'চে বেশী, তারা খাবার বানায়, জামাকাপড় বানায়, ঘরবাড়ি, রাস্তা ঘাট বানায়; সবকিছু শুধু তারাই পারে কিন্তু তারা নিজেদের শক্তির কথা জানে না এই যা।
       দাবার ছক পেরিয়ে সে সব শাদা কালো রাজারা তাদের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছে ঘাস জমিতে আবার।শব্দ উঠছে ঘোড়ার খুরের। অর্জুন আর জিয়ল গাছের জঙ্গলে যাবে বলে কাঠের ঘোড়া ফের লাফিয়ে উঠলো।
   দ্যাখো দ্যাখো মেলায় কেনা সেই চাকা লাগানো মাটির নৌকো ভেসে আসছে জল থেকে।হেমন্তের তিথিতে মাটির পিদিম জ্বেলে কলার খোলে টগর আর নয়নতারা ফুল সাজিয়ে তারা পুকুরঘাটে ভাসাচ্ছে আকাশ প্রদীপ। কার পিদিম জ্বলে কার নাও ভাসে, কার পিদিম নেভে,কার নাও ঠেকে...?    
       আর মেঘ উঠে পুকুরে শাদা বাতাসার ফোট দিচ্ছে বিষ্টির জল। জলের তলায় ডুব দিয়ে শোনো ঝামুর ঝুমুর গামুর গুমুর।কচুর ঝোঁপে ব্যাঙেরা কথা কইছে দল বেঁধে। অত চেঁচিয়ে ওরা বলছেটা কী? 
         আ লো ছেমড়ি, এইডাও জানিস না?তয় শোন,এক বেঙি  কয় এক ব্যাঙারে;ও ব্যাঙা তর বইলা বিয়া?কে কয়?কে কয়?ব্যাঙা যেই বেঙিরে জিগায়, অমনিই দ্যাশের যেহানে যত ব্যাঙাবেঙি রইছে হগগলে ফাল দিয়া চিচকার দিয়া কইতে থাহে এ কয়! ও কয়! এ কয়!ও কয়!কান পাইতা এইবার হুইন্যা দ্যাখ। সত্যিই পুকুর পাড়ে বেঙাবেঙিরা যে যেখানে ছিল বড়মাসির কথামত  সুর ধরে আর দাদাদের সাথে খোলামকুচি দিয়ে জলে ব্যাঙ থুত্থুরি প্রাকটিস দেয় ঝিনি।
     পাখার ডাঁটি পিঠে পড়বে জেনেও হাওয়া উঠলেই লাফিয়ে পেয়ারা গাছের ডালে চড়ে বসে। ঝড়ের ডালে দোল খেতেই তো মজা নাইলে  অত জোরে কে দোলাবে ডালপালা হে?
     ওই দ্যাখো উঠোন ছাপানো ঝড়বিষ্টির জলছবি পেরিয়ে কচি নারকেল পাতার রোদ এল আবার।
         আকাশের তলায় শরত মেঘের ফাঁকে চিকন সে রোদ্দুরে পাওয়া বিকেলবেলায় ঝিনি দেখে মহুল, সানা,ঝুম আর টুকুন দাঁড়িয়ে আছে মণি টেনি বাচ্চু খোকনদের সাথে খেলারা যদি আর একবার তাদের সঙ্গে নেয় ...

Post a Comment

0 Comments