জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব-২৫/স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব-২৫


স্বপন কুমার দে

প্রথম প্রথম ওদের অনেক কিছুই অসুবিধা হচ্ছিল। নতুন পরিবেশ, নতুন লোকজন, তাদের কথাবার্তা, আচরণ-- সবকিছুই এতদিনের পরিচিতির বাইরে। এতদিন যে পরিমন্ডলের মধ্যে ছিল সেখানে অনেক পরিচিত লোকজন, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন। দিনগুলো যে কীভাবে পেরিয়ে যেত, বুঝতেই পারত না। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাজারও ব্যস্ততা, ছোটাছুটির শেষ নেই। বড় বৌমা সকাল সংসারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। মেয়েকে ঘুম থেকে তোলা, তাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করা, টিফিন করা, স্কুলে পাঠানো, কাজের মেয়েদের দিয়ে বিভিন্ন রকমের কাজের ফরমাশ করা, রান্নার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্বশুর শাশুড়িও সকাল সকাল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। সামান্য মর্নিং ওয়াক সেরে নিতেন দু'জনে। টিফিন খেয়ে শাশুড়ি বৌমার কাজে সাহায্য করতেন। ছেলেরা খেতে বসলে তদারক করতেন। আর বৃদ্ধ অমরেশ বাগানের পরিচর্যায় থাকতেন। তাকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব মণিদীপার নিজস্ব।

এখানে অফুরন্ত অবসর। নিজেদের রান্না করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। তারপর শুয়ে বসে, টিভি দেখে সময় কাটে না। ছেলে পৌনে দশটায় অফিস বেরিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা ছ'টা বেজে যায়। সময় কাটতে চায় না। কাজের মেয়ে বিকেলে আসে। বাসন মাজা হয়ে গেলে বলে," মাসিমা, চা করুন, খাবো। আপনি চা-টা যা বানান না, এক্কেবারে অমৃত। যে আপনার হাতের চা একবার খাবে, সে আর ছাড়তে চাইবে না।"
" ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি বোসো, আমি চা করছি।" মণিদীপা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজের মেয়েটি খুব ভালো। এখানেরই একজন জোগাড় করে দিয়েছে। মণিদীপা সকালে তাকে চা-টিফিন খাওয়ান, আবার বিকেলে একসঙ্গে গল্প করতে করতে চা খান।এখানের কতকিছু বিষয় তিনি ওর কাছ থেকে জানতে পারেন। সে সময় মেয়েটিরও কোনো তাড়া থাকে না।
" সরলা, সামনেটায় দুটো চেয়ার নিয়ে এসো তো, দু'জনে বসবো।"
" হ্যাঁ মাসিমা, আনছি।"

কোয়ার্টারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে বিকেল বেলায় খেলাধূলা করে, বড়রা বসে বসে গল্প গুজব করে। এক একটি জটলা এক একটি সাংবাদিক বৈঠকের মত। পরনিন্দা, পরচর্চা ছাড়িয়ে কখনও কখনও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়েও আলোচনা হয়। এরা মাঝে মাঝে মাসিমার খোঁজ নিয়ে যায়। মাসিমার পরিবারে কে কে আছে তাও এতদিনে জেনে গেছে।

নিজেদের কোয়ার্টারের সামনে দুটো চেয়ার নিয়ে ওরা বসল। দুজনের হাতে চায়ের কাপ, বিস্কুট। বাড়ির কাজের লোকের সাথে এতটা মাখামাখি পাশাপাশি লোকজন পছন্দ করে না। তাদের চোখে,' এইসব আদিখ্যেতা বেশিদিন থাকবে না' গোছের কথা মণিদীপার কানেও পৌঁছায়। মণিদীপা আমল দেন না। দুজনের মধ্যে কথা শুরু হয়।

সরলা আসে শহরের এক বস্তি এলাকা থেকে। দিনে দু'বেলা, সকাল বিকাল। সরলার বর রান্নার গ্যাসের ডেলিভারি ম্যান, সপ্তাহে একদিন ছুটি পায়। ছেলের এখনো বিয়ের বয়স হয়নি, সে রং মিস্ত্রির কাজ করে। সরলার বাপের বাড়ি গ্রামে, গ্রামের নাম বাবলাডিহি। চারদিকে শুধু বাবলা গাছ। পাথরের মত শক্ত মাটি, উঁচু নিচু। বর্ষায় ভালো বৃষ্টি হয় না। প্রায় সারাবছর খরা। চাষ বাস ভালো হয় না। তেমনই গরিব, গ্রামের মানুষগুলো, দু'বেলা পেটভরে খেতে পায় না। পানীয় জলের বড় অভাব। অনেক গভীর কুঁয়োগুলোও গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যায়। তখন দূরের শুকিয়ে যাওয়া নদীর বালি খুঁড়ে কোনোরকমে একটু খাবার জল জোগাড় করতে হয়। এইসব কথা বলতে বলতে সরলার চোখে জল এসে যায়। মণিদীপা মন দিয়ে শোনেন। কখনও কখনও সরলা জানতে চায় মাসিমার বাড়ির লোকেদের কথা। শুনতে শুনতেই সে সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েছে। মেসোমশাই, বড় বৌদি, মন্টি সোনা, সব যেন তার কতদিনের চেনা। এইভাবে গল্প করতে করতে কখন যে সময় পেরিয়ে যায় বুঝতে পারে না। সম্পূরক অফিস থেকে ফিরলে আড্ডা ভেঙে যায়। মা ছেলের সঙ্গে ভেতরে যান।

ছেলের মানসিক অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারেন মা। প্রত্যেক মানুষের মানসিক গঠন আলাদা আলাদা। একজনের সঙ্গে আর একজনকে সম্পূর্ণ মিলিয়ে দেওয়া যায় না।প্রত্যেকের চিন্তা ভাবনা আলাদা আবার একই ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন ভিন্ন। যেকোনো মানুষের অন্তর্লোক যিনি সবচাইতে ভালো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন তিনি হলেন মা। প্রথম শিশু অবস্থায় তার প্রতিটি ভঙ্গি মায়ের চেনা, তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদাগুলোও বদলে যায়। আচরণের মধ্যেও তফাৎ চোখে পড়ে।

দেখতে দেখতে তিন মাস পেরিয়ে গেল, এই নতুন জায়গায় নতুনভাবে মানিয়ে নিতে সম্পূরকেরও প্রথম দিকে অসুবিধা হচ্ছিল। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে এই জল, হাওয়া, পরিবেশ বিশেষত মানুষগুলোর সঙ্গে মিশে যেতে লাগল। বড় ভালো লাগে এখানকার সহজ সরল মানুষগুলোকে। শুনতে চায় তাদের অভাব, অভিযোগ, ভালোমন্দ সবকিছু। প্রথম প্রথম ভাষাগত কিছু কিছু অসুবিধা হচ্ছিল কিন্তু এখন আর সেটা নেই। তাদের কথা বলার ধরণ, আঞ্চলিকতা, অজ্ঞাত শব্দের প্রয়োগ কিছুটা খটোমটো লাগলেও তার মধ্যেও এক ধরণের যাদু আছে। সবচেয়ে ভালো লাগে এদের অন্তরঙ্গতা। কখনও কখনও দেশি মুরগির ডিম এনে দেয় সম্পূরককে। সম্পূরক টাকা দিতে গেলে নিতে চায়না, সম্পূরক জোর করে দেয়। একইভাবে শীতকালে খেজুর রস, খেজুর গুড় সম্পূরকের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। অথচ এই মানুষগুলোই কত গরিব! অপুষ্টিতে ভোগা রোগা শরীরে পাঁজরের হাড়গুলো বাইরে থেকে গোনা যায়। ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়তে পড়তে স্কুল ছুট হয়ে যায়। সে দুয়েকবার গ্রামে গিয়ে দেখে এসেছে ফুটিফাটা পাথুরে মাঠ পড়ে আছে। গ্রাম ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে দূরে ছোট ছোট পাহাড়, গাছপালা, ঝর্ণা আর গ্রামে গ্রামে অর্ধাহারী, অনাহারী লোকেদের ভিড়। সৌন্দর্য এবং দারিদ্র্যের এমন সহাবস্থান তাকে অবাক করে।
🍂
এই তিন মাসে সম্পূরকের মন থেকে রূপসার স্মৃতিগুলো একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে আসে। সে বুঝতে পারছে জীবনটা এক কেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়, কাউকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করা উচিত নয়, পরনির্ভরশীলতা একেবারেই নয়। রূপসা, তার জীবনে হঠাৎ পাওয়া একটা দমকা হাওয়া ছাড়া কিছুই নয়। জীবনে এরকম আরও অনেকজনের সাথে পরিচয় হবে, আবার বিচ্ছেদও হবে কিন্তু তার জন্য জীবন থেমে থাকবে না।

এখানের মানুষগুলোর ভালো করার জন্য সে অনেক কিছুই করতে চায়, ভাবে, কিন্তু নিশানা খুঁজে পায় না। অফিস থেকে ফিরে মায়ের সঙ্গে গল্প করে। বলে এখানকার মানুষদের কথা। মাও কত আন্তরিকভাবে তাদের কথা শোনেন।

মা এতদিনে বুঝে গেছেন সম্পূরকের মন থেকে রূপসার স্মৃতি মুছে গেছে। এবার তাঁকে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করল। ক'দিন ধরেই শুনছেন, স্বামীর শরীরটা ভালো নেই, তাই তাঁর কাছে থাকতে খুব ইচ্ছা করছিল। ছেলেও বুঝল, বাবার জন্য মায়ের মন ভালো নেই। তাই একদিন মাকে নিয়ে বাড়ি চলল। তারপর থেকে প্রায় প্রতি শনিবার সম্পূরক বাড়ি আসে আবার সোমবার সকালে কর্মস্থলে ফিরে যায়।

 

Post a Comment

0 Comments