জ্বলদর্চি

রবিকবি ও প্রেতবাণীবহ চক্রযান/ পি.শাশ্বতী


রবিকবি ও প্রেতবাণীবহ চক্রযান 

পি.শাশ্বতী


যে বাঙালি সারা বছর সাহিত্য ভুলে থাকে, ভুলে থাকে প্রাণের কবিকে সে-ও বাংলা নতুন বছর থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত থাকে কবির শরণে। আর যাঁরা সম্বচ্ছর কবিকে রাখেন স্মরণে-মননে, তাঁরা কবির শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, মনের ও স্মৃতির অলিগলিও খুঁজে বেড়ান।

ছোট থেকেই কবির প্রবল আকর্ষণ অজানিতের প্রতি। ভগবান ও ভূত দুটোই আমাদের প্রবল ভাবে উদ্দীপিত করে। কারণ  সম্ভবত  দুটোই সাধারণভাবে পঞ্চইন্দ্রিয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারপরেও ভগবান সাধনার পথে অনেকেই চলেন, কিন্তু ভূতসাধনা? নৈব চ, নৈব চ।

আর ভূত যেহেতু কু-এর প্রতীক, তাই যথেষ্ট দুঃসাহস এবং মনের জোর চাই ভূতের মুখোমুখি হতে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত 'ভারতী' পত্রিকার আশ্বিন, ১৩০১ সংখ্যায় ভৌতিক যন্ত্রের বিজ্ঞাপন দেখে অর্ডার দিয়ে দু-এক পিস এই যন্ত্র কেনা হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে প্রেতলোকের আকর্ষণের টানেই বোধহয়। সম্ভবত এটি কিনেছিলেন হেমেন্দ্রনাথ। বিজ্ঞাপনটি ছিল এই রকম: 'নির্মাতা শরৎ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ১০৮, আপার চিৎপুর রোড, গরাণহাটা, কলিকাতা, মূল্য আড়াই টাকা, প্যাকিং ও ডাক মাশুল বারো আনা। রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রটির নাম দিয়েছিলেন  'প্রেতবাণীবহ চক্রযান'। রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই জানা যায়, কিশোর হলেও ঠাকুরবাড়ির নিয়মিত প্রেতচক্রে বসার অনুমতি তাঁর ছিল।এইভাবেই যন্ত্রের সাহায্যে প্ল্যানচেট করে কবির সঙ্গে মাইকেল মধুসূদনের প্রথম আলাপ-পরিচয়। মধুকবির প্রয়াণের সময় রবি কবির বয়স বারো বছর। তাই ধরা যায়, সেই আলাপচারিতা তাঁর কৈশোরের অভিজ্ঞতা। লিখিত প্রমাণ অনুযায়ী কবি কুড়ি-একুশ বছর বয়সেও প্ল্যানচেট করতেন। কিন্তু এসব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ অন্যতম উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু হয়।

অনেক বছর পরে,   আটষট্টি বছর বয়সে,  আবার নতুন করে   পরিণত প্রজ্ঞার আলোকে পরলোকচর্চায় কবি মনোনিবেশ করেন ৷ ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয় কবির পুরনো বন্ধু ও তাঁর বহু কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক মোহিতচন্দ্র সেনের মেয়ে উমাদেবীর সঙ্গে। সে-বছর পুজো পড়েছিল শরতের শেষে। জনশূন্য আশ্রম। রবীন্দ্রনাথ একাই ছিলেন উত্তরায়ণ ভবনে। তাঁর অতিথি হয়ে রইলেন উমা। কয়েকদিনের মধ্যেই কবি জানলেন উমা একাধারে কবি এবং ভালো প্রেতমিডিয়াম। কবি আগ্রহী হলেন উমার সাহায্যে আবার প্ল্যানচেট করে প্রেতলোকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার। কারণ উপনিষদ থেকে কবি জেনেছিলেন,  এক ধরনের অতি সংবেদনশীল মানুষ থাকেন যাঁরা মৃত আত্মাদের আকর্ষণ করতে পারেন এবং তাঁদের সঙ্গে মরজগতের একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে পারেন। প্রেততত্ত্বের ভাষায় তাঁদের বলা হয় মিডিয়াম। প্রেতচক্রের সব নিয়ম ভঙ্গ করে রবীন্দ্রনাথ উমার মুখোমুখি বসে তাঁকে প্রশ্ন করতেন। মিডিয়ামের হাতে কাগজ পেন্সিল থাকত। তিনি উত্তর লিখে দেখাতেন। সাহায্য করতেন অমিয় চক্রবর্তী ও মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। ঘরে আরও অনেকে থাকলেও প্রশ্ন শুধু কবিই করতেন। আটটা ফুলস্কেপ কাগজের মোটা খাতা ভরে গিয়েছিল ক-দিনেই। নভেম্বরে পরপর বেশ ক-দিন এবং ডিসেম্বরেও যে ক-দিন উমাদেবী শান্তিনিকেতনে ছিলেন তাঁকে কেন্দ্র করে নিয়মিত  এই প্রেতচক্র চলত। ঠিক এক বছর পর সাতাশ বছর বয়সে মাত্র ক-দিনের রোগভোগে মৃত্যু হয় উমাদেবীর। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ছিল শুধু খাতাগুলো। যা রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে।

🍂

উমার মাধ্যমে কবির ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছিল কবির সকল প্রিয় আত্মীয় ও বন্ধুবর্গ। সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, মৃণালিনী, মাধুরীলতা, শমীন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ, হিতেন্দ্রনাথ। এছাড়া সুকুমার রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, অজিত চক্রবর্তী, সন্তোষ মজুমদার, সতীশ রায়ের মতো ব্যক্তিত্বের প্রেতবাণীও ধ্বনিত হয়েছিল সেইসব প্রেচক্রে। কথিত আছে বারে বারে ডেকেও আনতে পারেননি পিতা দেবেন্দ্রনাথ, মা সারদাদেবী, বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ও মেজোমেয়ে রেণুকাকে। অনেকে নিজেদের মত জানিয়েছেন। সুকুমার রায় তাঁর পুত্রকে শান্তিনিকেতনে রাখার কথা বলেছেন। রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাল বিধবা প্রতিমা দেবীর বিবাহে মৃণালিনী দেবী পরলোক থেকে তাঁর স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। পরিচয় না দিয়েও বারবার এসেছেন কাদম্বরী দেবী। এই আত্মাদের আগমন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দিগ্ধ ছিলেন। 

কিন্তু তাঁর কাছের মানুষদের অনেকেরই এই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তার উত্তরে কবির বক্তব্য ছিল, "পৃথিবীতে কতকিছু তুমি জাননা, তা বলে সেসব নেই? কতটুকু জান? জানাটা এতটুকু। না জানাটাই অসীম। এতটুকুর ওপর নির্ভর করে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না.... যে বিষয়ে প্রমাণও করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না। সে সম্বন্ধে মন খোলা রাখাই উচিত। যে কোন একদিকে ঝুঁকে পড়াটাই গোঁড়ামি।"

হয়তো এই অনধিকার কাজে অতিরিক্ত নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন বলে অকালে চলে যেতে হল উমাকে। খ্যাতনামা বিদ্বজ্জনেদের সমালোচনা হয় না। আর অজানিতের পথে এগোতে গেলে মানবিক ক্ষয়ক্ষতি কিছু  নতুন কথাও নয়।

রবীন্দ্র গবেষক অমিতাভ চৌধুরী তাঁর লেখা 'রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা' বইটিতে প্রেতচর্চার প্রেতালাপের বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন। যা যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক।

প্রকাশিতব্য...

Post a Comment

0 Comments