জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭০ /বিজন সাহা

রমানভ তীর থেকে বরিসোগ্লেবস্কের দৃশ্য

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭০ 

বিজন সাহা 

বরিসোগ্লেবস্ক 

তুতায়েভ শহরের ভোলগার দক্ষিণ তীরের প্রাচীন নাম বরিসোগ্লেবস্ক। বরিসোগ্লেবস্কের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় রমানভ শহরের পত্তনের আগে এবং এই নাম খুব সম্ভবত সেই সময়ের বরিস ও গ্লেব কাঠের গির্জার সাথে জড়িত। লাভরেনতিয়েভ দিনপঞ্জির সর্বশেষ নিরীক্ষায় দেখা যায় ১২৩৮ সালে মঙ্গোল বাহিনী ইয়ারোস্লাভল আক্রমণ করলে অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে বরিসোগ্লেবস্কে আশ্রয় নেয়। এই সময় উগলিচের যুবরাজ রোমান ভ্লাদিমিরোভিচ বরিসোগ্লেবস্ক আসেন ও ভোলগার অন্য তীরে দুর্গ তৈরির আদর্শ স্থান দেখে সেখানে রমানভ শহর পত্তনের সিদ্ধান্ত নেন। রমানভ শহরের প্রথম নির্মাণ কর্মীরা ছিল বরিসোগ্লেবস্কের স্থায়ী বাসিন্দা বা ইয়ারোস্লাভলের শরণার্থীরা। পঞ্চদশ শতকের রমানভের বিপরীতে বরিসোগ্লেবস্ক বড় জনপদে পরিণত হয় যেখানে মৎস্য শিকারীরা বসবাস করত। প্রথম দিকের রুশ সন্ত যুবরাজ বরিস ও গ্লেবের নামানুসারে এই জনপদের নাম রাখা হয় বরিসোগ্লেবস্ক। সপ্তদশ শতকের শুরুতে অরাজকতার সময়ে রমানভের সাথে বরিসোগ্লেবস্কও লুণ্ঠিত ও অগ্নি সংযোগে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে জীবন নিজের পথে চলতে থাকে, গড়ে উঠে নতুন জনপদ। ১৭১৯ সালে প্রথম পিওতরের সময় বরিসোগ্লেবস্ক পিতেরবুরগের ইয়ারোস্লাভ প্রভিন্সের অংশ হয়। কিন্তু ১৭২৭ সালে ইয়ারোস্লাভ প্রভিন্স মস্কোর অধীনে দেয়া হয়। ১৭৭৭ সালে সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনা এই জনপদকে বরিসোগ্লেবস্ক শহরের মর্যাদা দেন। রমানভ তীরের মত এখানেও রয়েছে একাধিক গির্জা। ১৬৫২ সালে পুরানো কাঠের বরিস ও গ্লেব গির্জার পরিবর্তে তৈরি হয় প্রথম পাথরের গির্জা। স্মলেনস্কের ঈশ্বর মাতার আইকনের নামে প্রতিষ্ঠিত এই গির্জা অবশ্য ১৬৭০ সালেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পরে। ১৬৭৮ সালে এই গির্জার ভিত্তির উপর ইয়ারোস্লাভলের কারিগররা তৈরি করে শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত ভস্ক্রেসেনস্কি গির্জা ১৬৮০ যার ভেতরের কারুকাজ করে ইয়ারোস্লাভলের শিল্পীরা। ১৬৬০ সালে মস্কোর নির্মাণ কর্মীরা কাঠের গির্জার জায়গায় পাথরের ব্লাগভেশেনস্কায়া গির্জা তৈরি করে। ২০০২ থেকে ২০১৭ সালে স্থপতি ইঝিকভের পরিকল্পনায় নির্মিত হয় ভেনিয়ামিন গির্জা।       

 বরিসোগ্লেবস্ক থেকে রমানভের দৃশ্য

রমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক শহর  

১৮২২ সালে সম্রাট প্রথম আলেক্সান্দরের নির্দেশে রমানভ ও বরিসোগ্লেবস্ক শহর দুটিকে একত্রিত করে রমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ইয়ারোস্লাভল শহরের পাশে হওয়ার কারণে উনবিংশ শতকে এই শহরের উন্নয়ন হয় প্রচণ্ড ধীর গতিতে। পাথরের বাড়িঘর তৈরির পরিমাণ কমতে থাকে। বলতে গেলে এসময় উল্লেখ করার মত কোন স্থাপনাই তৈরি হয়নি। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে শহর খ্যাতি লাভ করে। বিশেষ করে রমানভের ভেড়া বেশ সুনাম কুড়ায়। বিদেশী সূত্রে জানা যায় মাত্র সাড়ে ৬ হাজার লোকসংখ্যার এই শহরে সে সময় ১৪৪০ টি কুটির শিল্প ছিল। উনবিংশ শতকের শেষে শহরের লোকসংখ্যা ছিল ৬৫১৮, ছিল ১২৩ টি পাথরের দালান, ৭১৪ টি কাঠের ঘর। এসবই ছিল আবাসিক। অনাবাসিক ছিল ২৩ টি পাথরের দালান আর ১২৮ টি কাঠের স্থাপনা। ১১ গির্জা ও চ্যাপেল, ১৩ টি কারখানা। লোহার কাজ, পিঁয়াজ ও কপি উৎপাদনের জন্য বেশ নাম করেছিল রমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক। বিংশ শতকের শুরুতে শহরে সাড়ে ৮ হাজার লোক বাস করত।      

🍂

তুতায়েভ শহর 

১৯১৮ সালের ০৭ নভেম্বর অক্টোবর বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক বিশেষ সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে আলোচনার প্রধান বিষয় হয় শহরের নাম পরিবর্তন। লুনাচারস্কির নামানুসারে লুনাচারস্ক, লেনিনের নামানুসারে লেনিনস্ক, স্তেপান রাজিনের নামানুসারে রাজিন, প্যারি কমিউন ও দাস বিদ্রোহী স্পারটাকাসের নামানুসারে কম্যুনার-স্পারতাক, বিপ্লবী ভলদারস্কির নামানুসারে ভলদারস্ক, রেড আর্মির সৈনিক তুতায়েভের নামানুসারে তুতায়েভস্ক  নাম প্রস্তাব করা হয়। শেষ পর্যন্ত নাম রাখা হয় তুতায়েভস্ক-লুনাচারস্ক এবং ১৯১৮ সালের ০৯ নভেম্বর সেটা অফিসিয়াল রূপ পায়। তবে সেই বছরের ০৯ ডিসেম্বর স্থানীয় কমিটির সভায় শহরের নাম পরিবর্তন করে তুতায়েভ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এভাবেই শ্বেত বাহিনীর হাতে নিহত রেড আর্মির সদস্য তুতায়েভের স্মৃতিকে সংরক্ষিত করা হয়। ১৯৪১ সালে এই শহরের নাম বদলিয়ে প্রখ্যাত রসায়নবিদ দ্মিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভের নামানুসারে মেন্দেলিয়েভ রাখার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে পিতৃভূমির যুদ্ধ শুরু হলে সেটা আর কার্যকরী হয়নি। যুদ্ধের পরে এখানে তন্তু, সেলাই ও ফার্নিচার শিল্প প্রসারিত হতে থাকে। এছাড়া ১৯৭০ এর দশকে ইয়ারোস্লাভল প্রদেশের সবচেয়ে বড় তুতায়েভ মোটর শিল্প কারখানা এখানে তৈরি হয়।     


পুরানো নাম ফিরিয়ে দেবার প্রচেষ্টা 

পেরেস্ত্রোইকার শুরুতে শহরকে পুরানো নাম ফিরিয়ে দেবার একাধিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়, কিন্তু দুই দুই বার গণভোটে জনগণ এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে। যারা নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ভোট দেয় তাদের বিশ্বাস এর মধ্য দিয়ে প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে চায় আর ভোটের মধ্যে দিয়ে শহরবাসীর মধ্যে বৈরী মনোভাব সৃষ্টি করতে চায়। তাছাড়া রমানভ-বরিসোগ্লেবস্কে যারা বসবাস করত তাদের কেউই এখন জীবিত নেই আর বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুতায়েভ রেড আর্মির সৈনিকের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় না, এই নাম তাদের নিজদের স্মৃতির সাথে জড়িত – যে শহরে তারা জন্ম নিয়েছে ও বেড়ে উঠেছে। তবে যারা নাম পরিবর্তনের পক্ষে তারা মনে করে এর ফলে শহরের ইমেজ বদলাবে। রমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক নাম পর্যটকদের বেশি করে আকর্ষণ করবে। ফলে গণ রায় উপেক্ষা করে ২০১৫ সালের ২৭ মে শহর কাউন্সিলে তুতায়েভের নাম বদলিয়ে রমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক রাখার প্রস্তাব আনা হয়। ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ইয়ারোস্লাভলের প্রাদেশিক কাউন্সিল বা দুমা এই প্রস্তাবের সমর্থন করে রাশিয়ার পার্লামেন্টে গস দুমায় সেটা পাঠায়। ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর গস দুমা শহরের ঐতিহাসিক নাম ফিরিয়ে দেবার পক্ষে মত দেয়, কিন্তু সেই বছরই ইয়ারোস্লাভলের অস্থায়ী গভর্নর জনগণের মতামত ছাড়া নাম পরিবর্তন করা হবে না বলে গণ ভোটের আয়োজন করার আশ্বাস দেন। কিন্তু দেখা গেল নাম পরিবর্তনের প্রশ্ন আঞ্চলিক দুমার এখতিয়ারে নেই, এটা হবে কেন্দ্রীয় গস দুমার মাধ্যমে। একেই হয়তো বলে চোরের এক কোপ আইনের দশ কোপ। 


বরিসোগ্লেবস্কে আমাদের ঘোরাফেরা মুলত ভস্ক্রেসেনস্কায়া গির্জার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটা শুধু এই অঞ্চল নয়, রমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক শহরের প্রধান গির্জা, অন্তত এখনও পর্যন্ত। আমরা যখন রমানভ ঘুরে এখানে এসে পৌঁছুই বিকেল হয়ে গেছে। শহরের এই এলাকা মনে হয় অনেক বেশি বড় ও শিল্পোন্নত। বাইরে থেকে দেখে সেটাই মনে হল। রমানভ এলাকার বাড়িঘর মূলত কাঠের তৈরি। সোভিয়েত আমলের টিপিক্যাল স্থাপনা ওখানে বলতে গেলে চোখে পড়েনি। সেদিক থেকে বরিসোগ্লেবস্ক এলাকায় অনেক সোভিয়েত স্থাপনার দেখা মিলল। বড় রাস্তা, বাস সার্ভিস এসব এই অঞ্চলেই দেখলাম। অর্থাৎ আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য এখানে অনেক বেশি প্রকট। এসব পেরিয়ে আমরা গেলাম ভস্ক্রেসেনস্কি গির্জায়। এসময় গির্জায় প্রার্থনা চলছিল। আমাদের অনেকেই অতে যোগ দিল। আমিও ঢুকলাম ক্যামেরা নিয়ে। অনেক ছবি তুললাম, কিন্তু যে ঈশ্বরের জন্য এই বিশাল মন্দির তারই দেখা পেলাম না। অন্তত ক্যামেরায় তাঁকে ধরতে পারলাম না। এই গির্জার চারিদিকে ইটের দেয়াল। যাতে ঈশ্বর পালিয়ে না যায় সে জন্য মনে হয়। ভেতরেই আলাদা চ্যাপেল। আছে বেশ সুন্দর ফুলের বাগান। রঙ বেরঙের গোলাপ ফুটে আছে। মনে পড়ল  বড় মামার কথা। ছোটবেলায় ইন্ডিয়া বেড়াতে গেলে মামার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম। মামা এগ্রিকালচার অফিসার। নিজের বাড়িতে বিশাল বাগান। কোথাও গেলে বিভিন্ন ফুলের চারা ও বীজ সংগ্রহ করতেন। আমিও এটা ওটা চুরি করতে তাঁকে সাহায্য করতাম। মামা এখন নব্বই পেরিয়ে শত বর্ষের দিকে এগিয়ে চলছেন। বাগান শুনেছি অযত্নে পড়ে আছে সাপ, ব্যাঙ, বানর এসবের খেলাঘর হয়ে।  

ভস্ক্রেসেনস্কায়া গির্জা

ভস্ক্রেসেনস্কায়া গির্জায় রয়েছে স্মলেনস্ক ঈশ্বর মাতা আইকন, উত্তর দিক পিওতর ও পাভেলের নামে উৎসর্গকৃত, আর দক্ষিণ দিক বরিস ও গ্লেবের উদ্দেশ্যে। রুশ গির্জাগুলোর ভেতরটা অনেকটা মিউজিয়ামের মত, বাইবেলের বিভিন্ন প্লট আঁকা। অনেক উঁচুতে জানালা। রঙ বেরঙের কাঁচের ভেতর দিয়ে আলো এসে পড়ে নীচে। ফলে ছবি তোলার এক আদর্শ আলো ওখানে পাওয়া যায়। ওখান থেকে বেরিয়ে দেখি সূর্য অস্ত যায় যায়। দৌড়ে চলে গেলাম ভোলগা তীরে। ইতিমধ্যে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। আমার জন্যই অপেক্ষা। আমাদের গাইড তাই চললেন আমার সাথে যাতে আমি খুব দেরি না করি। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে সূর্যাস্ত আর পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ভস্ক্রেসেনস্কায়া গির্জার ছবি তুলে বাসে এসে বসলাম। সেদিনের ভ্রমণ খুব ভালো লাগলেও একটি বিষয়ে অতৃপ্তি রয়ে গেছে। সেদিন যাওয়ার পথে ট্রেন লাইনের সিগন্যালে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। হঠাৎ দেখি কয়লার ইঞ্জিনের একটি ট্রেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এই দৃশ্য দেখে এতটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছিলাম যে ক্যামেরা বের করে অথবা নিদেন পক্ষে স্মার্টফোনে এর ছবি নিতেও ভুলে গেছি। পরে শুনেছি ইয়ারোস্লাভল থেকে রীবিনস্ক পর্যন্ত এই বিশেষ ট্রেন এখনও চলে। হয়তো কোন একদিন ঐ ট্রেনে চড়ে ইয়ারোস্লাভল থেকে রীবিনস্ক যাওয়ার সৌভাগ্য হবে। রীবিনস্ক আমরা যাব, তবে দুবনা থেকে। পরের পর্বে।    

তুতায়েভের ভিডিও 

https://youtu.be/oRLhfEiTlRU 

ছবিতে তুতায়েভ 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=274


Post a Comment

0 Comments