ছাপা শাড়ী
সুবর্ণা নাগ
পূজা এসে গেলো, অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ। কোন্নগর স্টেশন সংলগ্ন সারি সারি গুমটি শাড়ীর দোকান গুলোতে শাড়ীর বিক্রি খুব কম। দোকানদারদের মাথায় হাত।
দুই গুমটির মালিক শ্যামল আর কার্তিক চা খেতে খেতে গল্প করছিলো।শ্যামল বলছে -" কার্তিকদা, খদ্দের ই তো নেই গো, পেটে পুরো লাথি পরে গেলো যে। পঁচিশ হাজারের মাল তুললাম, চার আনাও মাল কাটলো না। "
কার্তিকের মত - " সব অনলাইন অনলাইন নিয়ে ব্যাস্ত, বাড়ি বয়ে জামা, শাড়ী দিয়ে যাচ্ছে। লোকে আজকাল আর মেটিরিয়াল দেখে না তো।কি যে আছে কপালে! চিন্তায় রাতে ঘুমিয়ে নেই রে ভাই । " বেজার মুখে শ্যামল ও বলে উঠলো
- " আমার ও। মেয়ে, বৌ, মা এখনো কাউকে কিস্সু দিতে পারিনি পুজোতে, হাত পুরো খালি । তারপর তো.... "
বলতে বলতে শ্যামলের দোকানে দুটি মহিলা এসে হলুদ শাড়ির খোঁজ করে। চা এর ভাড় ফেলে গুমটিতে উঠে বসে শ্যামল । মহিলাদের গোটা দশেক হলুদ শাড়ী দেখালো শ্যামল। 'মনের মতো হলুদ পাচ্ছিনা ' বলে মহিলারা পিছন ফিরলেন । শ্যামল শাড়ি ভাঁজ করতে করতে বিড়বিড় করতে থাকে-
' ফালতু ঘাঁটিয়ে চলে গেলো, নেবেনা বলেই আসে। ধুর!'
আবার গুমটি থেকে নেমে কার্তিকের দোকানের সামনে গিয়ে বলে " নাক শিটকে চলে গেলো। ভাব এমন যেন কাঞ্জিবরম কিনতে এসেছিলো।ধুর, বাড়ি যাই দুপুরের ভাতটা খেয়ে আসি। খদ্দের এবেলায় আর আসার নয়, দিন টাই খারাপ, শালা।" এই বলে ঝাপ নামালো শ্যামল।
বাড়ি এসে শ্যামল দেখে পলাশ আর ওর বৌ রিয়া এসেছে।পলাশ ওর ছোট ভাই, ভালো আই টি সেক্টরে চাকরি করে, বৌও একটা মন্তেশ্বরী স্কুলের টিচার। ওদের ভালোবাসার বিয়ে, এই তিন বছর হতে চললো। বিয়ের একবছর পর কোন্নগর থেকে শশুরবাড়ি দমদমের কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে পলাশ , যাতায়াতের সুবিধার জন্য। আর এই শ্যাওলা ধরা বাড়িতে কদিন ই বা থাকতে পারতো। রিয়ার বাবার বেশ বড়ো দোকান হাতিবাগানে, প্রতিপত্তিশালী ঘরের মেয়ে কি না রিয়া। তবে পলাশ একেবারে ঝাড়া হাত পা হয়ে যায়নি, মাকে দু তিন মাসে একবার দেখতে এলে ঠিক প্রেসার, সুগারের ওষুধ কেনার টাকাটা দিয়ে যায়। শ্যামল আর শ্যামলের মা এতেই খুশি। রেগে যায় গীতা, শ্যামলের বৌ। এই অভাবের সংসারে একটু হাত খুলে দিতে কি পলাশের ? মাকেই দিক না, মাও তো একটু ফল মূল খেতে পারে, না কি? মেয়ে মিঠিটা ক্লাস ফোর-এ উঠলো, যতই প্রাইমারি স্কুলে পড়ুক, খাতা কলমেরও তো খরচা আছে। গীতা গজগজ করতে থাকে। যাই হোক, শ্যামল ঘরে ঢুকলে রিয়া পায়ে হাত দিয়েই প্রণাম করে ভাসুরকে। শ্যামল দৌড়ে মিষ্টি আনতে ছোটে। পলাশ বাধা দিয়ে বলে ' দাদা, যাস না,কিচ্ছু খাবার সময় নেই।" রিয়াকে দেখিয়ে বলে "ওদের বাড়িতে আজ লাঞ্চ করবো, তারপর ওর মাসির বাড়ি যাবো, সেই গোলপার্কে । আজ সানডেতেই সব দেওয়া থোওয়া গুলো সেরে নেবো । আর সময় পাবো না যে ।"
রিয়া গীতার দিকে তাকিয়ে বলে "দিদি, পুজোতে থাকবো না গো। কুলু, মানালি যাচ্ছি, তাই এবার দশমীতেও আসতে পারবো না। লক্ষী পূজার আগের দিন ফিরবো । এবার পুজো দিচ্ছ তো? আসবো তাহলে।"
গীতা মুচকি হেসে বলে " তোমার দাদা যেমন তেমন করে হোক মা লক্ষীর পুজো টুকুনি দেবেই , ব্রাহ্মণের ঘর, মা লক্ষীর পুজোতো দিতেই হবে। এস,পারলে।"
রিয়া খানিক ইতস্তত পরিস্থিতিতে পরে। হেসে একটু সামলে নিয়ে বলে "দিদি, তুমি বলছিলে শরবত করবে। চিনি দিও না আমাদের দুজনকে , হা। আমি সুগারফ্রি এনেছি।" গীতা 'আচ্ছা ' বলে উঠে যায়।
মিঠি, কাকার কোলে বসে ড্রয়িংখাতাটা দেখাতে থাকে। মিঠি ভীষণ খুশি, এই বছরের পুজোতে আজ ওর প্রথম জামা হলো।
চিত্র- শুভম দাস
রিয়া, মা আর গীতাকে ওদের শাড়ি বের করে দেখায়। গীতার তাঁতের শাড়িটা বেশ সুন্দর কিন্তু মা এর তসর রঙের নীল পাড় শাড়ীটা যেন চোখ টানছে। মা কে হাতে দিয়ে, রিয়া প্রণাম করে বলে, ' মা এটা পরে অঞ্জলি দিও কিন্তু '। মা শাড়ী টা হাতে নিয়ে পলাশের উদ্দেশ্যে বলে " পলু, এতো দামী শাড়ী কিনিস কেন? কই আর যাই? তার চেয়ে তোর দাদাকে... " হঠাৎ শ্যামল মা কে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে " দাও দাও দেখি তোমার শাড়ী টা! দারুন কোয়ালিটি। " রিয়া শ্যামলের হাতে একটা পাঞ্জাবি দেয়। শ্যামল মুখ ছোট করে বলে " দাদাটা খালি হাত পেতে নিতেই শিখেছে বল? দিতে পারলাম কই তোদের কিছু। " শ্যামলের চোখের কোনে জল চিকচিক করে ওঠে।
অন্যমনস্ক পলাশ উঠে দাঁড়িয়ে পরে, বলে "আজ তবে রওনা দেবো রে, বেড়াতে যাবার আগে একবার আসতে চেষ্টা করবো।"মা কে প্রণাম করে পলাশ যাবার উদ্যোগ করলে, শ্যামল একটু বসতে বলে।
ভেতরের ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে মাসের খরচা থেকে পাঁচশোটা টাকা নিয়ে এসে, গীতাকে আড়ালে ডাকে। গীতাকে বলে "যাও, রিয়াকে দাও, না হলে খারাপ দেখায়।"গীতা চোখ বড়ো বড়ো করে কিছু বলতে গেলে শ্যামল মুখ চেপে ধরে ওর, বলে "যা বলছি, করো।"
গীতা, রিয়ার হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলে "গরীব দাদাটার এই টুকুই সামর্থ, কিছু কিনে নিও বোন।" রিয়া বলে " এসবের কি দরকার ছিলো।" শ্যামলের মা রিয়াকে বলে " নাও বৌমা , ভাসুরের মান রাখো।বড়ো দাদা কি না, মনে মনে কষ্ট পায়, ব্যবসা পত্তর ভালো যাচ্ছে না বাবুটার ।"
শ্যামল দরজার কোনে দাঁড়িয়ে ভিজে আসা চোখের পাতা মুছে নেয়। পলাশ খানিক বিরক্ত মতো হয়েই শরবতটা তাড়াতাড়ি শেষ করে, গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়, পিছন পিছন নামে রিয়াও। জানলা দিয়ে শ্যামলের মা দেখে মলিনতাময় বাড়িটা ছেড়ে পলাশ সস্ত্রীক চলেছে আড়ম্বরময় শহুরে পথের দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন মনে মনে বলে
শ্যামলটাও পড়াশোনায় ভালো ছিলো, পেটের দায়ে মরা বাপের দোকানে গিয়ে বসলো, না হলে বাবুটাও আজ হয়তো....., দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে "সবার মঙ্গল করো মা।"
দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন, ঢাকের বাদ্য বাজছে সকাল থেকে। আজ বিকেলের ট্রেনে পলাশ যাবে কুলু মানালি। না, আর দেখা করতে এলো না ও। মা আজকাল আর কিছুই প্রত্যাশা করে না যেন। বলেও না বেশী কিছু। গীতা সারাটা দিন গাধার খাটনি খেটে মরে, একটা ঠিকে ঝি ছিলো তাও ছাড়িয়ে দিয়েছে গীতা। বলে ' ও কটা বাসনের জন্য, চারশো টাকা দিতে হবে না, আমি ই পারবো।' মা বোঝে আসলে অভাব, অভাব অমন লক্ষী প্রতিমার মতো গীতাকেও আজ পাকানো দড়ির মতো নীরস, খিটখিটে করে তুলেছে। কি করবে মেয়েটা? সংসারে আসা ইস্টক দাবিহীন পরিশ্রমই করে চলেছে। মাঝেমধ্যে শাশুড়ি বৌমার ঝামেলাও লাগে ঠিকই, আবার সন্ধ্যে হলেই গীতা চিরুনি তেল নিয়ে শাশুড়ির কাছেই আসে বেনুনি করতে। অভাবের সংসারে কেমন সব বেঁধে বেঁধে আছে যেন গীতার আঁচলে।
ষষ্ঠীর রাতে শ্যামল বিষন্ন মুখে বাড়ি আসে- মা, বৌ এর শাড়ী আর মিঠির জন্য জামা নিয়ে। সবটাই বড়ো সস্তার। মাকে ঘিয়ে রঙের আর গীতাকে মেরুন রঙের ছাপা শাড়ী এনে দিয়েছে শ্যামল, আর মিঠিকে দিয়েছে সুতির জামা । কোনোটাই পুজোর পড়ার মতো ঝলমলে নয়। মাকে শাড়ীটা হাতে ধরিয়ে যেন লজ্জায় শ্যামল নিজের ঘরে চলে যায়। অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে, মা কে মনে মনে বলে "ক্ষমা করো মা, আমি তোমার অপদার্থ ছেলে, একটা ভালো শাড়ীও দিতে পারিনা"।
🍂
সেদিন অষ্টমী, পাড়ার প্যান্ডেলে চারজনেই যাবে অঞ্জলি দিতে। স্নান করে সকাল থেকেই মিঠি বাড়ি মাথায় করেছে। পাড়ার প্যান্ডেলে ভোগ খাবে আজ সব্বাই তাই গীতারও আজ রান্নাঘর থেকে ছুটি। গীতা মিঠিকে বলে ' যা, ঠাম্মিকে নিয়ে মণ্ডপে যা, আমি বাড়ির পূজা সেরে যাবো, তোর বাবাও হিসেবটা সেরে বেরোবে।'
মিঠি দৌড়ে হাজির ঠাম্মির ঘরে, ' দেরি করো না, শুরু হয়ে গেলো তো অঞ্জলি। চলো চলো।' বাবার দেওয়া জামাটা পরে মিঠি রেডি। ঠিক করেছে, কাকুর দেওয়া স্কার্ট টপ টা রাতে পরে বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দেবে।
শ্যামল মায়ের ঘরে ঢুকে দেখে, খাটের ওপর ভাইয়ের দেওয়া শাড়ীটা রাখা। শাড়ীটাতে হাত বুলিয়ে কি যেন একটা ভাবে, মনে পরে এই শাড়ীটা পরে মা'র তো অঞ্জলি দেওয়ার কথা।তারপর নিজেদের ঘরে এসে পুজোর বিক্রির হিসেবটা একটু মিলিয়ে নিতে বসে। গীতার সাথে আজ একসাথেই মণ্ডপে যাবে ও।
মিঠি একদৌড়ে ঘরে ঢুকে বলে " মা আসছি, বাবা আসছি, তোমরাও তাড়াতাড়ি চলে এস কিন্তু।' গীতা ঠাকুর ঘর থেকে উত্তর দেয় ' সাবধানে যাবি মিঠি, ঠাম্মিকে ধরে ধরে নিয়ে যাস'।
মা ও সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে "এগারোটা অব্দি তিথি আছে, বেশী দেরি করিস না বাবু। বৌমাকে নিয়ে আয়।"
শ্যামল উত্তর দেয় ঘর থেকেই - "আচ্ছা, আসছি"। খানিক পরেই ঠিক মতো গাড়ি ঘোড়া ডিঙিয়ে ওরা যেতে পারছে কি না দেখার জন্য শ্যামল জানলায় দাঁড়ায়, অবাক হয়ে দেখে, মা ওরই দেওয়া ছাপা শাড়ী পরে অঞ্জলি দিতে যাচ্ছে। শ্যামলের ঠোঁটে যেন তৃপ্তির হাসি লেগে যায়, মনের মাঝে অব্যাক্ত আনন্দ আবার কষ্ট ও খেলা করতে থাকে। দৌড়ে যায় পূজার ঘরে, গীতাকে জিজ্ঞেস করে " কি গো, মা ভাই এর দেওয়া অমন সুন্দর শাড়ীটা পড়লো না, ছাপা শাড়ীটা পরে গেলো?"
গীতা হেসে বলে, " আমিও একই প্রশ্ন করতে মা বললো', বাবু যে শাড়ীই দিক, ওতে ঐ দোকানের গন্ধ থাকে, ওদের বাবার গন্ধ থাকে, যতদিন দুগ্গা মায়ের মুখ দেখবো, অষ্টমীতে ঐ শাড়ীই পড়বো। বলে কি না, তুই পর পলুর দেওয়া শাড়ী টা, তাই বের করে দিয়েছিলো। আমিও বলেছি, মিঠির বাবা বেনারসি দিক বা ছাপা শাড়ী, ঐটাই পড়বো।"
শ্যামল ঘরে এসে মা দুর্গার উদ্দেশ্যে বলে "মা গো, তোমায় কি দেখতে যাবো? সারাবছর সাদা ছাপা শাড়ী পরে তুমি আমায় আগলে রেখেছো।
আমার মাকে যেন আরও একশোটা অষ্টমীতে ছাপা শাড়ী পরাতে পারি।"
0 Comments