ভোলগা তীরে স্তারিৎসা ক্রেমলিনভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৩
বিজন সাহা
স্তারিৎসা
স্তারিৎসা ভোলগার উজানে ছোট্ট এক শহর। ছবির মত দেখতে এই শহরে আমরা গেছিলাম ২০২৩ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর। এই শহরের নাম আগে শুনেছি আমার ফটোগ্রাফার বন্ধুদের কাছে। কেন যেন মনে হয়েছিল সেটা দুবনার আশেপাশে কোথাও যেখানে সাইকেল চালিয়েই যাওয়া যায়। এরপর একদিন পলিনা বলল ও স্তারিৎসা ঘুরতে গিয়েছিল। ওর কাছে খোঁজ নিয়েই জানলাম এটা তভের পেরিয়ে যেতে হয়। ফলে তখন থেকেই এক ধরণের আগ্রহ আমার মধ্যে জেগে ওঠে সেখানে যাবার। যখনই এরকম একটি এক্সারশন পেয়ে গেলাম, চললাম এই শহরের উদ্দেশ্যে। এছাড়া ভোলগা তীরের শহর সেটাও আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। এই লেখার প্রথম দিকে আমরা ভোলগার উৎসে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলাম আর সেখান থেকে আস্তাশকভ, তরঝক, নিলোভা পুস্তিন হয়ে তভের যাবার কথাও আমরা জেনেছি। ভোলগার উৎস থেকে তভের পর্যন্ত আমরা আর কোথাও ভোলগার দেখা পাইনি। আমরা এখন উজান বেঁয়ে সেই না দেখা ভোলগার খোঁজেই যাব। স্তারিৎসাকে বলা যায় শুরু থেকে ভোলগা তীরের দ্বিতীয় বড় শহর। প্রথমটির কথা আমরা বলব একটু পরে কোন এক পর্বে।
কথিত আছে নভগোরাদের রাজা মস্তিস্লাভ উদালি খালোখোলনি নদী যেখানে ভোলগায় পড়ছে সেখানে আসেন। সে সময় এই নদীই ছিল নভগোরাদ ও তভের রাজ্যের সীমান্ত। এরপর ১২৯৭ সালে তভের রাজ মিখাইল ইয়ারোস্লাভোভিচ স্তারিৎসা নদীর তীরে শহরের গোড়াপত্তন করেন। ধারণা করা হয় যে এর আগে এখানে লিউবিম নামে এক শহর ছিল যা ১২৯২ সালে তাতার মঙ্গোলদের আক্রমণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। লোক কাহিনী বলে পত্তনের সময় এখানে একজন মাত্র বৃদ্ধা বাস করতেন। লোককথা ঐতিহাসিক সত্যের বিপরীতে কিছু না বললেও লিউবিম শহরের উপস্থিতির কোন লিখিত প্রমাণ নেই। ১৩১১ সালে স্তারিৎসায় সম্ভবত তভের রাজ মিখাইল ও নভগোরাদের দাভিদের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৩১৯ সালে তভের রাজ্য মিখাইল ইয়ারোস্লাভোভিচের চার সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হলে স্তারিৎসা জুবৎস্কি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।
🍂
আরও পড়ুন 👇
১৩৬৩ থেকে ১৩৬৭ সাল পর্যন্ত তভের রাজ মিখাইল আলেক্সান্দ্রভিচ শহরটি পুনর্নির্মাণ করেন। নতুন শহর, স্তারিৎসা পারের শহর, উঁচু শহর ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এই শহর বিভিন্ন সময় পরিচিত হয়। ১৩৬৭ সালে মস্কো রাজ দ্মিত্রি দনস্কই এই শহর থেকে চার কিলোমিটার ভাটিতে যেখানে লোয়ার স্তারিৎসা ভোলগায় পড়ছে সেখানে ঘাঁটি তৈরি করেন। তিনি স্তারিৎসা দখল করলেও তা তভের রাজকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। মস্কো ও তভেরের যুদ্ধে ১৩৭৫ সালে দ্মিত্রি দনস্কই অল্প সময়ের জন্য আবারও স্তারিৎসা দখল করেন। ১৩৯১ সালে তভের রাজ মিখাইল এখানে উঁচু বাঁধ, গভীর খাদ ও চার মিটার উঁচু কাঠের দেয়াল তৈরি করে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করেন। ক্রেমলিনের ভেতর রাজকীয় ভবন, সেনানিবাস, বানিজ্য কেন্দ্র ইত্যাদি ছাড়াও তৈরি হয় শ্বেতপাথরের আরখানগেলস্কি সাবর। ১৩৯৫ সালে শহর অগ্নিকান্ডে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। ১৩৯৮ সালে নির্মিত হয় আরখানগেল মিখাইল গির্জা। ১৪০৩/১৪০৪ সালে নির্মিত হয় সেন্ট নিকোলাই গির্জা। ১৪৩৫ সালে লিথুনিয়ার যুদ্ধে স্তারিৎসার রাজা ইয়ারোস্লাভ আলেক্সান্দ্রভিচ স্তারিৎস্কি নিহত হন। ১৪৪৯ সালে একদিকে তভের রাজ বরিস অন্যদিকে পোল্যান্ড ও লিথুনিয়া রাজ কাজিমিরের মধ্যে এখানে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়াও ১৪৮৩ ও ১৪৯৮ সালে এখানেই তভের ও পোল্যান্ড রাজের মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেদিক থেকে স্তারিৎসা সে সময় গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল বলেই ধারণা করা যায়। ১৪৮৫ সালে স্তারিৎসা মস্কো রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৫৪৬ সালে ইভান দ্য টেরিবল দীর্ঘ সাত বছর এই এলাকা থেকে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ফলে সেই সময় স্তারিৎসায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। ১৫৫৮-১৫৬১ সালে নির্মিত হয় বরিস ও গ্লেব সাবর যা রুশ স্থাপত্যের অলঙ্কার হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ১৫৮১ সালে লিভোন যুদ্ধের সময় ইভান দ্য টেরিবলের আমন্ত্রনে ভ্যাটিকানের পোপ অষ্টম গ্রিগরির দূত আন্তনিও পাসেভিল স্তারিৎসা আসেন। সে সময় এখানে তিন লক্ষ রুশ সেনা সমাবেশ করা হয়। ১৬০২ সালে ডিউক হ্যান্স শেজুইগ গলশটিনস্কি স্তারিৎসা ভ্রমণ করেন। তাঁর ভাষ্য মতে স্তারিৎসা একের ভেতরে চারটি শহর – যেন বিশাল এক দুর্গ। তবে ১৬০৯ সালে লঝে দ্মিত্রির আক্রমণের সময় শহর আবারও পুড়িয়ে দেয়া হয় ও স্তলবভ চুক্তির মাধ্যমে স্তারিৎসা আবার মস্কোর কাছে ফিরে আসে। ১৭৩৫ সালে লিথুনিয়া, স্মলেনস্ক, বেলি, আস্তাশকভ ইত্যাদি শহর থেকে এখানে বনিকেরা আসতে শুরু করে। অষ্টদশ শতকের শুরুতে রুশ সাম্রাজ্যকে আটটি প্রদেশে ভাগ করা হয়। ১৭০৮ সালে স্তারিৎসা স্মলেনস্কের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৭১৯ সালে পিতেরবুরগ প্রদেশের তভের কাউন্টির অংশ হয় সে আর ১৭২৭ সালে তাকে নভগোরাদ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৭৬৭ সালে সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনা স্তারিৎসা ভ্রমণ করেন। ১৭৭৬ সাল থেকে এই শহর তভের প্রদেশের অংশ হয়। ১৮২৪ সালে সম্রাট প্রথম আলেক্সাদর এখানে নিশি যাপন করেন। শুধু জার আর সম্রাট নয়, মহান রুশ কবি আলেক্সান্দর পুশকিনও ১৮২৯ সালে স্তারিৎসা আসেন। অষ্টদশ ও উনবিংশ শতকে স্তারিৎসা সাঙ্কত পিতেরবুরগের পথে ছিল গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। এর আশেপাশে স্তারিৎস্কি শ্বেতপাথর নামে এক ধরণের মাটি উত্তোলন করা হত। ১৮৯৭ সালে এখানে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার লোক বসবাস করত। এখানে ১০ টি গির্জা, ২১ টি কারখানা ও ১২৪ টি বানিজ্য কেন্দ্র কাজ করত। ১৯১৭ সালে ১৩ ডিসেম্বর এখানে সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালের ১২ অক্টোবর স্তারিৎসা জার্মানদের দখলে চলে যায়, তবে ১৯৪২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি রেড আর্মি এই শহর মুক্ত করে। ১৯৬৩ সালে এখানে ভোলগার উপর তৈরি হয় স্তারিৎস্কি সেতু। স্তারিৎসার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে সভ্যাতো উসপেনস্কি মনাস্তির (দ্বাদশ শতক), যেখানে রয়েছে ঈশ্বর মাতা উস্পেনিয়ার সাবর (১৫৩০), ত্রইৎস্কি সাবর (১৮১৯), ভভেদেনস্কায়া গির্জা (১৫৭০), ইয়োয়ান বগোস্লাভ গির্জা (১৫৯৪), পারাস্কেভি পিয়াতনিৎসি সাবর (১৭৫০), বরিসোগ্লেব গির্জা (১৮০৮-১৮২০), প্রফেট ইলিয়ার গির্জা (১৮০৭), নিকোলস্কায়া গির্জা (১৮০৭), ভস্ক্রেসেনস্কায়া গির্জা, স্পাসস্কায়া গির্জা, ভজনেসেনস্কায়া গির্জা। আছে একাধিক চ্যাপেল। আছে বিখ্যাত সব সওদাগরদের বাড়ি। বর্তমানে স্তারিৎসা উজান ভোলগার পুশকিন স্থানগুলোর একটি, মানে যেসব জায়গা পুশকিন ভ্রমণ করেছিলেন তার একটি। বর্তমানে এখানে বিভিন্ন সিনেমার শ্যুটিং করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে স্তারিৎসা ক্রেমলিন দেখতে মস্কো ক্রেমলিনের মতই। একই রকম এদের দেওয়াল ও টাওয়ার। ইভান দ্য টেরিবলের শাসনামলে সেখানে শক্তিশালী কামান স্থাপন করা হয়। ক্রেমলিনে ঢোকার জন্য ছিল ভূগর্ভস্থ গুপ্ত পথ যা ১৯১৪ সালে খননকার্যের সময় আবিষ্কৃত হয়।
পারাস্কেভি পিয়াতনিৎসি সাবর, বরিসোগ্লেব গির্জা, আলেক্সান্দর নেভস্কি চ্যাপেলআমাদের ভ্রমণের প্রথম পর্যায়ে ছিল স্তারিৎসা ক্রেমলিন। যতদূর বুঝলাম সাম্প্রতিক কালে মেরামত করা হয়েছে। সামনের রাস্তার কাজ এখনও চলছে। ভোলগা তীরে ক্রেমলিন দেখতে সত্যিই অপূর্ব। ভেতরে সেমিটারি, ভজনেসেনস্কি গির্জা ও চ্যাপেল। আছে ক্যাফে। এখানকার মনাস্তিরগুলোয় যে পিঠা বা পাই পাওয়া যায় তা খুবই সুস্বাদু। তাই এসব জায়গায় গেলে বেশি করে কিনি। নদীর ঠিক ওপাড়ে রয়েছে পারাস্কেভি পিয়াতনিৎসি সাবর, বরিসোগ্লেব গির্জা, আছে আলেক্সান্দর নেভস্কি চ্যাপেল। স্তারিৎসা ব্রিজের উপর দাঁড়ালে সুন্দর প্যানোরামা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আমরা ব্রীজ পেরিয়ে আসি অন্য তীরে। পারাস্কেভি পিয়াতনিৎসি সাবর, বরিসোগ্লেব গির্জা, আছে আলেক্সান্দর নেভস্কি চ্যাপেল এ সবই দেখি বাইরে থেকে। অনেকটা পরিত্যাক্ত। তবে শুনলাম ধীরে ধীরে সবই মেরামত করা হবে। কিছু কিছু কাজকর্ম শুরু হয়েছি ইতিমধ্যেই। নদীর এই তীর অনেক উঁচু। আমাদের দেশে নদীগুলোর দুই তীরই একই সমতলে অবস্থিত। তবে ভোলগায় প্রায় সব জায়গায়ই দুই তীরের মধ্যে উচ্চতার তারতম্য চোখে পড়ার মত। এখান থেকে বহুদুর পর্যন্ত এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া ভোলগাকে দেখা যায়। এখানে সে এক তন্বী তরুণীর মত, বড়জোর মিটার পঞ্চাশেক তার প্রস্থ। আমি খুবই আশাবাদী একদিন স্তারিৎসার সবগুলো গির্জা তাদের পুরানো রূপ ফিরে পারে। সেখানে ঈশ্বর আছেন কি নেই সেটা নিয়ে আমার একেবারেই মাথা ব্যথা নেই। তবে এসব স্থাপনার ভেতরে যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে সেটা অতুলনীয়। যদি এই শহরকেও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় তাহলে মানুষের আগ্রহ বাড়বে এসব জায়গা ভ্রমণের। ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর পর রুশদের মধ্যে নিজের দেশ আবিষ্কারের আগ্রহ বাড়ছে। এটাই সুযোগ নিজের দেশটা গুছিয়ে নেবার।
ভোলগার দুই তীরের গির্জাগুলো দেখে লেনিন সরণী ধরে আমরা গেলাম একটি ক্যাফেতে। সেখানেই আমাদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা। বাড়িঘর যেকোনো মফঃস্বল শহরের মত। কাঠের বাড়িও অনেক। রাশিয়ায় সুজদালের মত অনেক পুরানো শহরের ঘরবাড়ি নির্মাণের ব্যাপারে অনেক বাধানিষেধ আছে – বিশেষ করে এদের উচ্চতার ব্যাপারে। দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা রওনা হলাম রঝেভের পথে। ভোলগা তীরের এই শহর নিয়ে আমাদের গল্প আগামী পর্বে।
ভিডিওতে স্তারিৎসা
https://youtu.be/KAthqz15KAg?feature=shared
ছবিতে স্তারিৎসা
http://bijansaha.ru/album.php?tag=275
0 Comments