যুদ্ধের জাদুঘরে রঝেভ যুদ্ধের প্যানারমা
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৫
বিজন সাহা
যুদ্ধ পরবর্তী রঝেভের কথা
ব্যক্তি মানুষের মত সমষ্টি বা দেশের জীবনেও ওঠানামা আসে, আসে চড়াই উৎরাই। যদিও জীবনের কোন ঘটনাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তবে ওই যে বলে না সব জন্তুজানোয়ারই সমান তবে কিছু কিছু জন্তুজানোয়ার বেশি রকম সমান। রঝেভের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সে সৃষ্টি করেছে দেশপ্রেমের নতুন উদাহরণ। ১৯৪১ সালের ১৯ জুলাই ভোরে জার্মান বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে রঝেভে শুরু হয় নতুন জীবন। অবরোধের জীবন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে ১৯৪১ সালের ২২ জুন। যুদ্ধের প্রথম মাসগুলোয় রঝেভ ও আশেপাশের জনপদ থেকে ১৬ হাজার মানুষ যুদ্ধে যায়। এদের কাউকে কাউকে ডাকা হয়েছিল, অনেকেই গেছিল স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তৈরি হয় মিলিশিয়া ইউনিট, তৈরি হয় ফাইটার ব্যাটালিয়ন, তৈরি হয় আত্মরক্ষা গ্রুপ। ১৯৪১ সালে গ্রীষ্ম ও শরত কালে রঝভের লোকজন দেশের প্রতিরক্ষা কাঠামো নির্মাণে নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে। হিটলারের বাহিনী কর্তৃক মস্কো দখলের অপারেশনের নাম ছিল টাইফুন। আর সেই লক্ষ্যে মস্কোর আশেপাশে বিভিন্ন শহর বন্দর দখল করতে থাকে নাজি বাহিনী। যুদ্ধের ১১৫ দিনের মাথায় রঝেভ শত্রুর দখলে চলে যায়। ১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর কয়েক শ’ বছরের রঝেভের ইতিহাসে সবচেয়ে তিমিরাচ্ছন্ন দিন বলে মনে করা হয়। এই দিন সোভিয়েত রেড আর্মি বাধ্য হয় শহর ত্যাগ করতে। শত্রুর ট্যাঙ্ক ও পদাতিক সেনা রঝেভে প্রবেশ করে
জার্মান শিল্পী ল্যাঙ্গারের আঁকা যুদ্ধকালীন রঝেভের ছবি
স্তারিৎসা থেকে আমরা যখন রঝেভ পৌঁছুই তখন দুপুর দুটো পেরিয়ে গেছে। আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি ছিল স্থানীয় যুদ্ধ মেমোরিয়ালে যেখানে জাদুঘরের পাশেই আছে বিশাল গণকবর। দুটো আলাদা সমাধিক্ষেত্রে শায়িত আছে হাজার হাজার মানুষ – একদিকে সোভিয়েত মানুষ, অন্য দিকে জার্মান সেনা। জার্মান মানে জার্মান শুধু নয়, স্পেন থেকে পোল্যান্ড, ইতালি থেকে ফিনল্যান্ড সমস্ত ইউরোপের সব জাতিই এসেছিল হিটলারের সাথে সোভিয়েতের সাথে যুদ্ধ করতে। আসলে কী নেপোলিয়নের সময়, কী হিটলারের নেতৃত্বে, কী বর্তমানে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুদ্ধে – সব সময়ই সমস্ত ইউরোপ এক হয়েছে রুশ দেশের বিরুদ্ধে। জার্মান সমাধিতে একের পর এক প্লেটে লেখা আছে নিহত সেনাদের নাম। রুশ অংশে সবার নাম পাওয়া যায়নি। এখনও বিভিন্ন সময় যুদ্ধে নিহত মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। তাই বলা যায় এটা এক চলমান প্রক্রিয়া। রুশ অংশে অবশ্য একটি চ্যাপেল আছে, আছে কারো কারো স্ট্যাচু। আমাদের ছাত্র জীবনে রঝেভ সম্পর্কে আমরা খুব একটা জানতাম না। মস্কো থেকে ২১২ কিলোমিটার ও তভের থেকে ১২৪ কিলোমিটার দূরে এই শহর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সে কারণেই এর প্রতিরক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন প্রচুর শক্তি নিয়োগ করে একই ভাবে জার্মান বাহিনীও বিশাল সেনা সমাবেশ এখানে ঘটায়। ধারণা করা হয় এখানে মৃত সোভিয়েত ও জার্মান সেনার সংখ্যা স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে নিহত সেনাদের প্রায় সমান। জানা যায় রঝেভে বিপুল শক্তি ব্যয় করায় লেনিনগ্রাদ ও স্তালিনগ্রাদে জার্মান আক্রমণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেদিক থেকে রঝেভের যুদ্ধ এই দুই শহরের শেষ বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মেমরিয়ালে গেলে নতুন করে মনে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা। পাথরে খোঁদাই করা নাম জানিয়ে দেয় সেনাদের বহুজাতিক ইতিহাস – এখানে লেখা আছে একদা পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ জুড়ে বিস্তৃত এই দেশে বসবাসকারী শত শত জাতির মানুষের কথা। শহর থেকে দূরে বার্চ, পাইনের বনে চিরশায়িত এই মানুষগুলোর অনেকেই একদিন কতই না অশান্তি নিয়ে এসেছিল জীবনে! সমাধিতে ঢোকার আগে আমরা গেলাম এখানকার জাদুঘরে । এই জাদুঘরটি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দল কর্তৃক বিভিন্ন রণাঙ্গন খুঁড়ে পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে তৈরি। আবার কেউ কেউ যুদ্ধে নিহত নিজেদের আত্নীয়স্বজনের ছবি বা অন্য কিছু নিজেরাই দান করেছে। যিনি আমাদের এসব বর্ণনা করছিলেন তিনি নিজের এরকম একটি দলের সদস্য।
রজেভের যোদ্ধারা
সেখান থেকে আমরা রওনা হলাম শহরের দিকে। কেন্দ্রীয় পার্কের সামনে বাস থেকে নেমে চললাম পায়ে হেঁটে। নদীর ওপারে রয়েছে যুদ্ধের জাদুঘর। এখানে কোন এক্সারশনে যাওয়া মানেই কোন না কোন জাদুঘর ভ্রমণ। সেখানে আগে থেকেই সময় ঠিক করা থাকে, তাই সমস্ত কাজকর্ম ওই সময়কে ঘিরেই হয়। এখানেও রয়েছে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন নিদর্শন। তবে মূল আকর্ষণ যুদ্ধের প্যানারমা। যারা মস্কোর নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বারাদিনো যুদ্ধের প্যানারমা দেখেছেন তারা সহজেই অনুমান করতে পারবেন। গল্পের সাথে সাথে ধীরে ধীরে আলো জ্বালানো হয়। জীবন্ত হয়ে ওঠে যুদ্ধের চিত্র। সেখানে আছে ছবি, আছে ভাস্কর্য, আছে যুদ্ধের মাঠে পাওয়া কামান – অপূর্ব সে কাজ। পাশের হলে সেই সময়ের বিভিন্ন ডকুমেন্ট। কারো লেখা চিঠি, ডাইরি। আছে জার্মান পদাতিক ডিভিশনের স্যাপার ব্যাটালিয়নের সৈনিক, শিল্পী ল্যাঙ্গারের জলরঙে আঁকা কিছু ছবি। সেই সময়ের রঝেভ, ভীত সন্ত্রস্ত এক বালক, একজন জার্মান সেনা - এসব ছবিগুলো অতি যত্নে প্রদর্শন করা হচ্ছে। একদিকে যুদ্ধ অন্য দিকে ছবি আঁকা। পৃথিবী সত্যই বিস্ময়কর, বিস্ময়কর মানুষ। অবাক হবার কি আছে? যুদ্ধে ধ্বংস আর সৃষ্টি পাশাপাশি হাতে হাত রেখে হাঁটে। আমি যখনই এদেশের কোন জাদুঘরে যাই অবাক হয়ে দেখি কত যত্নে ইতিহাস সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে। এটা ঠিক বিপ্লবের পরে বা ১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বেশ কিছু স্ট্যাচু ভাঙা হয়েছিল, কিন্তু সরকার সেগুলো সংগ্রহ করে রেখেছিল। মানুষের মত দেশও জীবন্ত। মানুষ যেমন খারাপ সময়টা ডিলিট করতে পারে না দেশও পারে না। ভালোমন্দের পরম্পরায়ই জীবন। আমরা প্রায়ই তা ভুলে যাই। তাই অনায়াসে নিজেদের ইতিহাস মুছে ফেলতে চাই। মনে করি কোন একটি বিশেষ দিন, কোন একজন বিশেষ মানুষের কথা পঞ্জিকা বা বই থেকে তুলে দিলেই তিনি মানুষের মন থেকে উধাও হয়ে যাবেন। মিউজিয়ামের বাইরেই কয়েকটি সমরাস্ত্র – সবই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। বাচ্চারা খেলছে, লোকজন ছবি তুলছে এর ব্যাকগ্রাউন্ডে। এবার আমাদের নদীর অন্য পারে যাবার পালা। এখন আর আগের মত ফিওদরভস্কি ও দ্মিত্রভস্কি পারের শত্রুতা নেই। ওখানে শহরের কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ। পিতৃভূমির যুদ্ধের বীরদের উদ্দেশ্যে অনির্বাণ শিখা জ্বলছে। আছে কেন্দ্রীয় স্ট্যাচু যার একদিকে যুদ্ধরত সেনা অন্য দিকে শান্তির সময়ের পারিবারিক চিত্র। আসলে যুদ্ধ ও শান্তি সব সময়ই পাশাপাশি চলে হাতে হাত রেখে। ওখান থেকে দেখা যাবে নদীর অপর তীরে এক গির্জা। অবশ্য আরও কয়েকটি গির্জা আমাদের চোখে পড়েছে যদিও কোনটাতেই যাওয়া হয়নি। ভোলগা একে বেঁকে চলে গেছে ভাঁটির দিকে – সমুদ্রের দিকে। বেশ কিছু সময় এই মেমোরিয়ালে কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম সোভিয়েত সেনার প্রতি উৎসর্গীকৃত স্মৃতি স্তম্ভের দিকে। সে গল্প পরের পর্বে।
ভিডিওতে রঝেভ
https://youtu.be/5_N1qTR5Y8A?feature=shared
ছবিতে রঝেভ
0 Comments