পর্ব- ৩৪
স্বপন কুমার দে
আজকাল মল্লিকা আর রাতের বেলায় স্টেশন থেকে একা একা বাড়ি ফেরে না। রাত ন'টা সাড়ে ন'টা, দশটা, যাই হোক না কেন মল্লিকা স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাকে দেখতে পাবে, সে হল নিমাইকাকু। রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম প্রথম মল্লিকা ভেবেছিল, কাকু প্যাসেঞ্জার পায়নি, তাই দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু পরে পরে দেখল প্যাসেঞ্জার পেলেও তাদের নিচ্ছে না। পরিবর্তে সে মল্লিকার পিছন পিছন তার বাড়ি পর্যন্ত রিকশ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মল্লিকা বুঝতে পেরেছিল সেদিনের ঘটনার পর থেকেই কাকু তাকে আগলে আগলে রেখেছে, যাতে আর কোনো বিপদে না পড়ে। মা বাপ মরা মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসে সে। হয়তো, অন্য কোনোভাবে সাহায্য করতে পারে না কিন্তু অভিভাবকের সতর্ক দৃষ্টি মল্লিকার ওপর। মল্লিকা নিষেধ করেছে," কাকু, আমি কি একেবারেই বাচ্চা মেয়ে, যে তুমি সবদিন আমাকে আগলে আগলে রাখবে? আমি ঠিক বাড়ি পৌঁছে যেতে পারবো।"
নিমাইকাকু কিছুটা বিব্রত হয়েছে, মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে," না রে আমি তো তোর জন্য থাকিনা প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষা করি। না পেলে তোর সঙ্গে চলে আসি।"
মল্লিকা হাসতে হাসতে ধমক দিয়েছে," কাকু, মিথ্যে কথা বলো না। আমি দেখেছি, তুমি প্যাসেঞ্জারকে না করে দিয়েছো।"
ঈষৎ বিব্রত হয়েছে নিমাইকাকু," না না সে দূরে যাবে অথচ কম ভাড়া দেবে। ওইজন্য ওকে নিয়ে যাইনি।"
মল্লিকা বুঝতে পারে সবটা। বাড়ির কাছাকাছি এসে নিমাইকাকু চলে যেতে চায়। বাধা দেয় মল্লিকা," এতদূর যখন এলে, আমাদের বাড়িতে কিছু খেয়ে যাও।"
" না রে বেটি, আমি আজ আগেই খেয়ে নিয়েছি, হোটেলে। এখন আর খিদে নেই।"
" আবার মিথ্যে কথা!"
নিমাই লজ্জা পেয়ে রিকশ ঘুরিয়ে চলে যেতে চায়। আটকে দেয় মল্লিকা," শোনো কাকু, একটা কথা ছিল তোমার সঙ্গে।"
" কী বলবি বল্। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। দেরি করে দিস না।"
সাইকেলটা একপাশে ঠেসিয়ে তার কাছে যায় মল্লিকা," কাকু, আমি তো তোমার মেয়ে। তোমারও যেমন আমার ওপর দায়িত্ব আছে, আমারও তো তেমনই কর্তব্য আছে। ঠিক কিনা?"
" কী বলতে চাইছিস, বল্?"
" বলছি, আমি জানি এখনও তোমার খাওয়া হয়নি। মেয়ের চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না। আমার বাবা বেঁচে থাকলে তাকেও তো আমাকে খেতে দিতে হতো। তাহলে? চলো ভাতে ভাত রেঁধে দু'জনে খেয়ে নিই, তারপর নাহয় বাড়ি যাবে।"
আর কোনো অজুহাত টিকল না। অগত্যা নিমাইকাকুকে হার মানতে হল।
*****
মন্টিকে পড়াতে গিয়ে সেদিন সম্পূরকের বাবার সঙ্গে অনেক কথা হল। প্রথমে মন্টির পড়াশোনার গতি প্রকৃতি নিয়ে খোঁজ খবর নিলেন। এ বিষয়ে মল্লিকা খুব স্পষ্ট করে বলল," মন্টির ইমপ্রুভমেন্টের গতি প্রথমে যেরকম ছিল, সেই গতিটা এখন আগের মত নেই। কিছুটা কম কম লাগছে। অথচ এটা হওয়ার কথা নয়। এটা ক্রমশ কমতে থাকলে ভয়ের ব্যাপার। আমার মাঝে মাঝে মনেহয়, তাহলে আমিই কি ওকে বোঝাতে পারছি না? সেরকম হলে আমিই আপনাদের বলে দেবো বিকল্প কাউকে দেখতে। আর কিছুদিন দেখি।"
মল্লিকার কথায় অমরেশবাবু চিন্তিত হলেন। তিনি নিজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। তাই তিনি বুঝতে পারেন, মল্লিকার মধ্যে ফাঁকিবাজি মনোভাব নেই। যতটুকু পড়ায়, নিজেকে উজাড় করে দেয়। শুধু তাই নয়, মন্টির সঙ্গে দারুণভাবে মিশে যায় মল্লিকা। তার ভেতরের দুর্বলতাগুলো টেনে বার করার চেষ্টা করে। তবুও চিন্তিত হলেন, মল্লিকার মুখ থেকে মন্টির দুর্বলতার কথা শুনে।
খুব সিরিয়াসলি মল্লিকাকে বললেন," বিকল্প খোঁজার কথা ছাড়ো। তুমি এক কাজ করো, 'ট্রাই এন্ড এরর মেথড' প্রয়োগ করো। নিজে কিছু করে দিও না। তারপর লক্ষ্য করো, ও ঠিক করছে বা করতে চাইছে কিনা। ভুল করলে কী ধরনের ভুল করছে বিশ্লেষণ করো অবশ্য এ ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। তুমি অংক দিয়ে যাবে, আমি ওর কাছে বসে থাকবো আর লক্ষ্য করবো ওর মনসংযোগ।"
🍂
আরও পড়ুন 👇
মল্লিকা এবার কথা বলে," আমি ওই মেথডেই ওকে শেখাই। আগে সব ঠিকঠাকই ছিল, ইদানীং সমস্যাটা হচ্ছে। আমার মনেহয়, ওর সমস্যাটা ইন্টেলিজেন্সিতে নয়, সমস্যাটা কনসেন্ট্রেশনে। অংক করতে করতে মাঝেমাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অবশ্য এগুলো বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা। এ সব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাই, আমি মনেকরি, বৌদি যদি একটু চেষ্টা করেন...।"মন্টির মা বলে," আমার মনেহয়, ঠাম্মা আর কাকুর একটা জোরালো প্রভাব ওর মধ্যে আছে। ওরা না থাকার জন্য হয়তো ওর মনখারাপ।"
" হতে পারে, তবে কিছুদিন আগেও ওর এই সমস্যা ছিল না। তখনও কিন্তু ওর ঠাম্মা, কাকু বাইরেই থাকতেন। আপনি আর একটু ভালো করে খোঁজ নিন।"
মল্লিকার কথাগুলো ভালো লাগল না সুদেষ্ণার। মল্লিকা চলে যাওয়ার পর শ্বশুরকে বলল," বাবা, আমার মনে হয় অন্য টিউটর দেখাই ভালো।"
অমরেশবাবু ঠিক তখনই কিছু বললেন না। তাঁকে খুব চিন্তিত লাগল।
সুদেষ্ণা ভাবল, মেয়েকে খেতে দিতে হবে। শুধু শুধু এতক্ষণ বাইরের লোকের লেকচার শুনতে হল। " পারবি না ছেড়ে দে, তা নয়, আরও কিছুদিন দেখি। পয়সার লোভও ছাড়তে পারবি না, তা তোর এত কথা কিসের? আবার কী সব বলছে! মনে হয় দিই ঠাস ঠাস দুটো গালে। নিজে যেমন, অন্যকেও তেমনই ভাবছে।" মনে মনে গজ্ গজ্ করতে করতে খেতে ডাকতে নিজের শোবার ঘরে ঢুকল। ঢুকে কিছুটা অবাক হল। ঘরের আলো নেভানো।
" মন্টি, অ্যাই মন্টি, খেতে চল্।" বলতে বলতেই ঘরের আলো জ্বালাল। বিছানায় এক পাশ ফিরে শুয়ে আছে মন্টি।
" আয়, খেয়ে নিবি আয়।" বলেই পাশ ফিরিয়ে দিয়ে চমকে উঠল। মেয়ে কাঁদছে, চোখ দুটো লাল।
" কী রে কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন? নিশ্চয়ই ম্যাডাম কিছু আজেবাজে বলেছে। আজ ওর একদিন কী আমার একদিন।" বলেই ফোনটা নিয়ে মল্লিকাকে ফোন করতে যায়। মন্টি বাধা দেয়," মা, ম্যাম আমাকে কিছু বলেননি। আমি তোমাদের কথা শুনেছি। ম্যামের কথাই ঠিক। এতদিন আমি তোমাদের বলতে পারিনি, তোমরা আমাকে খারাপ ভাববে বলে। কিছুদিন হল একটি ছেলে আমাকে বিরক্ত করছে। নানাভাবে সে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমি না চাইলেও সে আমার পিছু ছাড়ছে না। প্রথম প্রথম গ্রাহ্য না করলেও পরে পরে আমিও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ি। আমি পড়ায় মন বসাতে পারছি না। সব সাবজেক্টেই পিছিয়ে পড়ছি। কখনও কখনও আমারও ওকে ভালো লাগে। কিন্তু বিশ্বাস করো মা, আমি পড়াশোনার ক্ষতি করতে চাই না। আমাকে বাঁচাও। আমি আর পারছি না।"
সুদেষ্ণা আগেই মেয়ের পাশে বসে পড়ছিল। রাগে, উত্তেজনায় গলার স্বর ভারী হয়ে এল," ছেলেটা কে?"
" আমার বান্ধবী তন্বীর দাদা।"
তন্বীর ফোন নাম্বার দে। আমি এখনই কথা বলবো।"
" না বৌমা, এখন নয়। আগে দালু আসুক। চিন্তা ভাবনা করো কীভাবে এগোবে।" সুদেষ্ণার গলার আওয়াজ শুনে বৃদ্ধ অমরেশবাবু কখন চলে এসেছেন, ওরা টের পায়নি।
" কিন্তু বাবা, আমার মেয়ের কী হবে?" সুদেষ্ণা কাঁদতে থাকে। বৃদ্ধ সান্ত্বনা দিয়ে বলেন," তোমার মেয়ের কিছু খারাপ হবে না বৌমা। আমি যখন আছি চিন্তা করো না। কাল মল্লিকাকে একবার ডেকে পাঠাও।"
0 Comments