পর্ব- ৩৫
স্বপন কুমার দে
সকালে পর পর দুটো টিউশন সেরে মল্লিকা মন্টিদের বাড়ি পৌঁছল। তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশটা ছুঁই ছুঁই। বাড়িতে ঢুকে সাইকেলটা একপাশে রেখে সোজা মন্টির ঘরে ঢুকে গেল মল্লিকা। অন্যদিনের মত মন্টির সেই হাসি খুশি ভাবটা নেই। মুখভার করে একদিকে বসে আছে। কোলের উপর একটা বই, মুখটা নীচের দিকে। ম্যাডামকে একবার দেখেই আবার মুখটা নামিয়ে নিল। পড়ছে, না, ভাবছে, কিছু বুঝতে পারা যাচ্ছে না। অনেকটাই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে।
একটুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মল্লিকা। কী বলবে, ভেবে পেল না। পাশের চেয়ারটায় আস্তে আস্তে বসে পড়ল। একবার মন্টির দিকে চাইল, আবার টেবিলে রাখা বইগুলোকে দেখতে লাগল। হাতের সামনে ইতিহাস বইটা নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকল। একটা জায়গায় থমকে গেল। ' ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ' শীর্ষক অধ্যায়ে দেখতে পেল কয়েকজন বিখ্যাত মহীয়সীর নাম। ভাবতে লাগল মল্লিকা। কী বলে শুরু করবেন?
সুবিধা হয়ে গেল। হঠাৎ মন্টিই মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল," কোন্ চ্যাপ্টারটা পড়াবেন ম্যাডাম?"
ইতিহাসের খোলা বইটা টেবিলের উপর রেখে শান্ত স্বরে ম্যাডাম উত্তর দিলেন," মন্টি, আজ তো তোমাকে পড়াতে আসিনি। তোমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। ইতিহাস পড়তে ভালো লাগে তোমার?"
কোনও উত্তর নেই।
" মন্টি, আমি একটা কথা জানতে চেয়েছি।"
খুব আস্তে করে একটা আওয়াজ শোনা গেল। মন্টি কী বলল, বোঝা গেল না। মল্লিকা অনুমানে বুঝল, মন্টি 'হ্যাঁ' বলেছে। একটা রাতের মধ্যে একজনের এতটা পরিবর্তন হতে পারে ? কে জানে, হয়তো বাড়িতে খুব অশান্তি হয়েছে, হয়তো ওর বাবা-মা প্রচণ্ড বকাবকি করেছে। ফলে সেও একেবারে ডিপ্রেসড্। কিন্তু মল্লিকার এখন কাজটাই বা কী?আজ যখন সে আসে, তখন বাড়ির বড়োরা কেউ ছিল না। মন্টির মা হয়তো তখন বাথরুমে, তাই তাকে দেখতে পায়নি। সেইজন্য সোজা মন্টির ঘরেই ঢুকে গেছে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
ইতিহাসের প্রসঙ্গ ছেড়ে মল্লিকা মন্টিকে বলে," তোমার স্নান হয়ে গেছে? খুব ঠাণ্ডা মাথায় অঙ্ক করতে হয়, মাথা গরম থাকলে চলে না। ঠিক আছে, কাল যে অঙ্কগুলো দিয়ে গেছি, সেগুলো হয়ে থাকলে দেখাও, না হলে এখানে করো।"মন্টির দিক থেকে কোনও উত্তর নেই। দুটো হাত গালে চেপে মাথা নীচু করে আছে। ম্যাডাম চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে,' মন্টি' বলে গাল থেকে হাত দুটো ছাড়াতেই মন্টি ডুকরে কেঁদে উঠল।
" কী হয়েছে? বলো আমাকে। আমি তোমার টিচার না? দুঃখ কষ্টের কথা পেরেন্টসকে আর টিচারকে সবসময় বলতে হয়। তাদের থেকে লুকোতে নেই। বলো কেন কাঁদছো? কী এমন হয়েছে?"
" আমি ভুল করেছি ম্যাম, আমি অন্যায় করেছি। আমি আর এরকম করবো না।"
" ধূর্ বোকা মেয়ে! তারজন্য এত কান্না! ভুল তো মানুষই করে। ভুল না করলে কোনটা ঠিক, তুমি বুঝবে কী করে? এই যখন তুমি আমার সামনে অঙ্ক করতে করতে ভুল করো, তখন আমি দেখেও কিছু বলিনা, কারণ তুমি নিজে ভুলটা আবিষ্কার করতে না পারলে, ঠিকটা অনুসন্ধান করতে পারবে না। জীবনে এরকম অজস্র ভুল তুমি করবে, আবার ভুল থেকেই ঠিক করার পথটাও তোমাকে খুঁজে পেতে হবে।"
মল্লিকার আসার খবর পেয়ে স্নান সেরে তাড়াতাড়ি মেয়ের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল সুদেষ্ণা। একটু দূরেই ছিলেন অমরেশবাবু। ইঙ্গিতে বৌমাকে ওদের ঘরে ঢুকতে নিষেধ করলেন। বৌমা কাছে যেতেই বললেন," এখন ওঘরে যাবে না। মন্টির আসল চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে।"
মুখটা নীচু করেই মন্টি তার ম্যাডামের কথা শুনছিল। ম্যাডাম বলে চলেছেন," এই যে তুমি আমাকে দেখছ, আমি তোমাকে এত কথা বলছি, কী করে বলছি বলো তো? আমিও তোমার মত ভুল করেছি। কিন্তু, যে মুহূর্তে জেনেছি, সেটা ভুল তখনই সেখান থেকে সরে এসেছি। এই যে তুমি তোমার ভুলটা বুঝতে পেরেছো এবং দেরি না করে আমাদের বলে দিয়েছো এজন্য তোমাকেই ধন্যবাদ দেওয়া যায়। আমরা সময় পেয়েছি তোমাকে সংশোধনের।"
মন্টি মন্ত্রমুগ্ধের মত ম্যাডামের কথাগুলো শুনছিল। মুখে কিছু না বলুক, ম্যাডামের কথায় তার মনের হীনমন্যতা ভাবটা ধীরে ধীরে দূর হচ্ছিল। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিল।
মল্লিকা বলল," তবে, এই ভুল আর করো না মন্টি।একই ভুল বার বার করলে তা ক্ষমার অযোগ্য। তুমি ক্লাস টেন-এ উঠেছো, সামনেই তোমার মাধ্যমিক পরীক্ষা। সেশনের প্রথম দিন থেকেই তোমার পাখির চোখ থাকবে মাধ্যমিক পরীক্ষায়। এছাড়া অন্য কোনো চিন্তা এখন আর মাথায় যেন না আসে।"
" ওই ছেলেটা যদি আমাকে না ছাড়ে?"
" তারজন্য আমরা আছি। এরপর তুমি ঐ ছেলের সাথে কোনও সম্পর্ক রাখবে না, কথা বলবে না। যা বলার বড়রা বলবে। কী, বুঝতে পেরেছো?"
" আচ্ছা, তাই হবে ম্যাম।"
" কথা দিচ্ছো তো?"
" হ্যাঁ ম্যাম।" মন্টি আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল।
" সকালে কখন খেয়েছো? মুখটা শুকিয়ে গেছে। বৌদি..." বলেই দরজার দিকে চেয়ে হাঁক পাড়ল মল্লিকা। সুদেষ্ণা ঘরে ঢুকতেই মল্লিকা বলল," বৌদি, মন্টির সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। খুউব লক্ষ্মী মেয়ে! আমার সব কথা শুনেছে। এখন ওর খিদে পেয়েছে। ওকে খেতে দিন। এদিকে আমি জেঠুর সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। আপনার সঙ্গেও কথা বলবো। আপনি মন্টিকে খেতে দিয়ে আসুন। আমাকে একটু পরেই বাড়ি ফিরতে হবে।"
" ওমা! তা কী করে হয়? আমি আপনার জন্য রান্না করলাম।" সুদেষ্ণা অস্থির হল।
অমরেশবাবুও বৌমাকে সাপোর্ট করেন," হ্যাঁ মল্লিকা, তুমি আজ আমাদের এখানে খেয়ে যাবে। আমিই বৌমাকে বলেছিলাম। দুপুরবেলা কারো বাড়ি থেকে খেয়ে না গেলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।"
" না জেঠু, আমি মানে ..." মল্লিকা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।"
" ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার এক্সকিউজ পরে শুনবো, এখন নয়।"
মল্লিকা হার মানল।
দুপুরের দু' আড়াই ঘন্টার আলোচনায় যেটা সিদ্ধান্ত হল, "মন্টিকে বকাঝকা, মারধর করা চলবে না। এই মুহূর্তে ওর মধ্যে অন্যায়বোধ, অনিশ্চয়তার আতঙ্ক যে ডিপ্রেসন্ তৈরি করেছে তা থেকে ওকে বার করে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ভালো ব্যবহার, ভালো সম্পর্ক দিয়ে ওর কনফিডেন্স এনলার্জ করতে হবে। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে এবং খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে ওর ওপর, যেটা ও বুঝতে না পারে। এই ভূমিকাটা একমাত্র মা-ই নিতে পারে। মায়ের কোনও বিকল্প হয়না। স্নেহ, ভালোবাসার সাথে সাথে শাসনের দায়িত্বটাও তাকেই নিতে হয়। মন্টির বয়সী ছেলেমেয়েদের ইমোশন্ বেশি। ঝোঁকের বশে বা আবেগের তাড়নায় ওরা ভুল পথে পা বাড়াতে পারে। আমাদের সেই ভুল সংশোধন করা দরকার। কাজেই, দেখতে হবে, একই ভুল বার বার যাতে না করে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এখন বেশ কিছুদিন মন্টিকে একা ছাড়া চলবে না। স্কুল বা টিউশন যেখানেই যাক না কেন, সঙ্গে বাড়ির একজনকে থাকতে হবে। মন্টি কাদের সঙ্গে মিশছে, তারা কেমন প্রকৃতির, সব খবর রাখতে হবে। আর রইল সেই ছেলেটি। মন্টি বলেছিল, সে যদি না ছাড়ে? খুব স্পর্শকাতর বিষয়। এ ব্যাপারে দাদা বৌদি কথা বলুক ছেলটির বাবা মার সঙ্গে। ভালোভাবে মিটে গেলে ভালো, না হলে অন্য রাস্তাও আছে। ওর বাবা মাও নিশ্চয়ই চাইবে না ছেলেটির ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাক।"
বৃদ্ধ অমরেশবাবু এতক্ষণ বাধ্য ছাত্রের মত সব শুনছিলেন। ওদের কথা প্রায় শেষ হয়ে গেলে," আচ্ছা মল্লিকা, তুমি যে এত কথা বললে, শিখলে কোথায়? আজ তুমি এ বাড়িতে আসার পর থেকে আমি শুধু তোমাকে লক্ষ্য করে গেছি। মন্টির সঙ্গে তোমার কথাবার্তা দরজার আড়াল থেকে শুনেছি। আমি অবাক হয়ে গেছি। তোমার মধ্যে বেস্ট টিচারের সব গুণ আমি দেখতে পাচ্ছি,যিনি শুধুমাত্র পুঁথিলব্ধ জ্ঞান বিতরণ করেননি, স্টুডেন্টকে বুঝতে ও মাপতে জানেন এবং প্রয়োজন মত চিকিৎসা করতে পারেন। সমাজের সবচেয়ে বড় চিকিৎসক হলেন শিক্ষক সমাজ। তুমি হলে সেই শিক্ষক সমাজের একজন যথার্থ প্রতিনিধি। আমাদের মন্টির অনেক ভাগ্য যে তোমাকে পেয়েছে।" অমরেশবাবুর কথার মধ্যে যথেষ্ট জোর ছিল। যে কথাগুলো তিনি এতক্ষণ বলছিলেন, সে কোনটিই মনরাখা কথা নয়। তিনি যা বিশ্বাস করেন, ঠিক সেটাই বলেছেন। কিন্তু মল্লিকার মনের মধ্যে অস্বস্তি ক্রমশ বাড়ছিল। বিশেষত সুদেষ্ণার চোখে চোখ পড়তেই সে আর স্থির থাকতে পারল না। আপত্তি করল," জেঠু, আপনি এভাবে বলবেন না। আপনার মত শিক্ষকের নখের যুগ্যিও নই আমি। আমি কেবল আপনাদের মত টিচারদের অনুসরণ করতে পারি। তবুও আমাকে যদি ভালো লেগে থাকে সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।" বলেই অমরেশবাবুকে প্রণাম করে বসল মল্লিকা।
অমরেশবাবু প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন," দীর্ঘজীবী হও মা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও।"
0 Comments