জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৯ / সালেহা খাতুন

আমি ও মেয়ে

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৯ / সালেহা খাতুন 

যত কোয়ালিফিকেশনই থাকুক না কেন আদতে একজন সাধারণ মানুষ আমি। মানবিক গুণ না থাকলে কোনো কোয়ালিফিকেশনেরই তেমন মূল্য নেই জানি। সুখ দুঃখ সমানভাবে সব মানুষকেই অতিক্রম করে যেতে হয়।

সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে হাসপাতালে যে দিনরাত্রিগুলি কাটিয়েছিলাম, সেসময় অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলাম। ১৪০৯ এর তিরিশে বৈশাখ বিকালে প্রিয়জনেরা আমাকে ভর্তি করে চলে গেলেন। মেটারনিটি ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় জেনারেল ওয়ার্ডে রাতটা কাটাতে হয়। সকাল নটায় ওটিতে নেওয়া হবে। উত্তেজনায় ঘুম না হওযারই কথা। নাইনটি পার্সেন্ট বার্ন হয়ে যাওয়া এক গৃহবধূ ভর্তি হলো রাতে। তার শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের নিদর্শন আর যন্ত্রণার আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস মথিত হয়ে গেল। সে দৃশ্য যাতে আমার চোখে না পড়ে তাই পাশ ফিরিয়ে দিলেন নার্স। পাশ ফিরে, পাশ কাটিয়ে কত দিন আর চলা যায়!

বিয়ের পাঁচ বছর পর পরিকল্পিত মাতৃত্ব। সাধারণত মেয়েরা আজন্ম মা হওয়ার ইচ্ছেটাকে মনের মধ্যে লালন করে। কিন্তু আমাকে কঠিন সংযমে বেঁধে দিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। যে যতই অনুপ্রাণিত করুন তিনি বলেছিলেন, “সন্তানকে যথাযথভাবে লালন পালন করার মত সামর্থ্য এখনও আমাদের হয় নি। আমার নড়বড়ে চাকরি। তুমি ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠিত হলে তবেই ভাবা যাবে”। প্রকৃতির বিরুদ্ধতা করলে অসুস্থতা অবশ্যম্ভাবী। অসুস্থ হতাম, আর জুটমিলের কোয়ার্টার এরিয়ার মধ্যেই একজন ডাক্তার থাকতেন, যিনি রাতবিরেতে চিকিৎসা করতেন। শ্যামনগর, ফুলেশ্বর সর্বত্রই এই ব্যবস্থা ছিল। ইরেগুলার ব্লিডিংয়ের ধাত ছিল আমার। ছমাস টানা পিরিয়ড হলো আবার ছমাস বন্ধ থাকলো। প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের অধ্যাপক প্রজ্ঞাদির স্বামী দেব দ্বৈপায়নবাবু তখন এস এস কে এম হাসপাতালের সার্জেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট। তাঁর সুপারিশে হাসপাতালের গাইনোকলজি বিভাগে দেখানোর সুযোগ হলো। ডাক্তাররাও বলতেন একটা ইস্যু নিয়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হবে। 
🍂
এতোদিনে সে সুযোগ এলো। আমাকে সুসজ্জিত করে ওটিতে নেওয়া হলো। প্রিয়জনদের থমথমে মুখ। চলে গেলাম ভেতরে। শুধু মা আর সালাউদ্দিনকে ওটির সামনে পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আমি কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। ওঁরা বাধা দিলেন। পুরো শরীর গোল করে মুড়ে দিয়ে পিঠের নীচের দিকে একটা যন্ত্রণাদায়ক ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো। তারপর আরো নানান কর্মকাণ্ড। আমার সঙ্গে গল্প করতে করতেই ডাক্তাররা সব কাজ করলেন। 

চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডাক্তার অভিজিৎ সরকার নবজাতকের দেখভাল শুরু করলেন। আমাকে বলা হলো, “সালেহা, আপনার ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ে হয়েছে”। বললাম দেখতে চাই। হাতের তালুর উপর বসিয়ে আমার মুখের সামনে ওকে আনা হলো। সেই রূপ লেগে আছে চোখে। অনেকক্ষণ অবজারভেশনে রাখার পর আমাকে বেডে দেওয়া হলো। কড়াকড়ি খুব। সবাইকে একসঙ্গে আসতে দেওয়া হলো না। একে একে আত্মীয় পরিজনরা এলেন। অদ্ভুত ব্যাপার সেই যন্ত্রণাময় সময়ে আমি শুধু সালাউদ্দিনকেই কাছে চাইছিলাম। কানোরিয়া থেকে পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছিলেন তিনি। আমার ছাত্ররা যখন বাবা হয় তখন ওদের অনেককে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, এ সময় স্ত্রীদের সঙ্গে থেকো, পাশে থেকো। শুধুমাত্র বই থেকেই নয় ,জীবন থেকেও কতকিছু শেখা যায়,শেখানো যায়।

মেটারনিটি ওয়ার্ডে জায়গা হতে আমাকে সেখানে পরের দিন ট্রান্সফার করা হলো। মেট্রন আমার সঙ্গেই কথা বলে চেঞ্জ করেছিলেন। কেবিনে একা একা থাকতে পারবো না তাই অনেকের সঙ্গেই থাকলাম। বাড়ির লোকজন বিকালে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় আমাকে দেখতে না পেয়ে মুষড়ে পড়েন। তার ওপর নীচে দেখে এসেছেন আমাদের এলাকার এক বিখ্যাত ডাক্তার বিভূতি ঘোষের অন্তিম যাত্রার দৃশ্য। যে ডাক্তারের কাছে ছোটোবেলায় বড়োদের সঙ্গে কত কতবার গেছি। শেষ দিন তিনি নিঃশ্বাস নেন ঐ হাসপাতালেই। ডাক্তারদের ভগবান বলে জানি। অথচ ভগবানও নিজেকে বাঁচাতে পারেন না। আশ্চর্য এ পৃথিবী।

নার্স ও অ্যাটেনডেন্টদের মধ্যে একদিন ভীষণ চাঞ্চল্য দেখলাম। খেয়ালি দস্তিদার পেশেন্ট রূপে ওখানে ভর্তি হয়েছেন সেদিন। অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ও এসেছেন। সে গল্প করছেন সবাই। সেলিব্রেটিদের কত বিড়ম্বনা! না আমার দেখার ইচ্ছা হয় নি। এখনও কোনো সেলিব্রেটিকে খুব কাছে পেলেও উত্তেজিত হই না। তবে তাঁদের কাজকে সম্মান করি।

আর একটি কিশোরী বধূ দামাল এক শিশুকে নিয়ে ভর্তি ছিল একই ওয়ার্ডে। কী যে প্যাথেটিক ঘটনা। আজও কেঁপে কেঁপে উঠি। সদ্য হামাগুড়ি দিতে শেখা ছেলেটি বাড়িতে কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয় এমন এক চলন্ত মেশিনের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয় সবার অজান্তে। কনুইয়ের কাছ থেকে বাচ্চাটির একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। বাড়ির লোকেরা কাটা হাতের টুকরোটি পলিথিনে ভরে শিশু সহ চলে আসেন হাসপাতালে। অপারেশান করে জুড়ে দেওয়া হলো হাতটি। হাতের আঙুলে রক্ত চলাচলও শুরু হয়েছিল। 
দু-একদিন পরে আবার একটি দীর্ঘ সময়ের অপারেশন জরুরী। কিন্তু শিশুটি সে অপারেশনের ধকল নিতে পারবে কিনা,সে বিষয়ে আলোচনা চললো। শেষ পর্যন্ত একটি বিকেলে ছেলেটিকে ওটিতে নিয়ে নেওয়া হলো। আর মুক্ত মা আমাদের বেডের পাশে পাশে ঘুরে সবার শিশুকে দেখতে লাগলো। আমরা আশ্চর্য হয়েছিলাম ঐ কমবয়সী মায়ের সহ্যশক্তি দেখে। শিশুটিকে নড়ানো যেত না। তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে প্রায় উপুড় হয়ে শিশুটিকে স্তন্য পান করাতো। মেয়েটি জানতো এবার তার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে। তাই ওটিতে নেওয়া হলেও তেমন দুঃশ্চিন্তা তার ছিল না। অপারেশন সাকসেশফুল হলো। কিন্তু হার্টফেল করে অপারেশান টেবিলেই মারা গেল শিশুটি। সে রাতে হাসপাতালে এমন কোনো ব্যক্তি ছিলেন না যাঁর চোখ দিয়ে জল পড়েনি। 

সদ্য মা হওয়া অনেকের সঙ্গে আলাপ হলো। বহুদিন তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ছিল। তারপর আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে গেল সে সব যোগাযোগ। সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে এলাম। একই নিয়ম মেনে আমার দাদু যেমন আমার কানে আজানের ধ্বনি দিয়েছিলেন, আমার বাবাও তাঁর নাতনির কানে আজানের ধ্বনি দিলেন। বাবা নিজের হাতে কাঁথাও বানালেন আদরের নাতনির জন্য। বোনকে তাঁর শাশুড়িমা একমাসের জন্য মা বাবার কাছে পাঠালেন দিদির দেখভাল করার জন্য। পরিবারের এই যে যত্ন ভুলি কী করে? মাঝে মাঝে পরিবারের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ বিপ্লব ঘোষণা করি। আর নিজের বালখিল্যতায় নিজেকে শাসন করি। একটি নবজাতক ও সদ্য মায়ের প্রয়োজনীয় সব জিনিস সংগ্রহ করে আনলো ওবাই। দিনগুলো মোটামুটি আনন্দেই কাটছিল। 
কথোপকথন

কিন্তু চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। বাচ্চার মাত্র দেড়মাস বয়স। বাড়িতে ল্যাণ্ডফোনে মেজোমাসির মেয়ে পম্পি ফোন করে জানালো, “দুলাভাইয়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। দুলাভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে”। ফোনটা আমিই ধরেছিলাম। হতভম্ব হয়ে গেলাম। কানোরিয়ায় শিফট চেঞ্জ হওয়ার সময় একটি তাঁত চলছিল না। এক শ্রমিকের করা রিপোর্ট অনুযায়ী মেশিনটি চেক করার জন্য সালাউদ্দিন ম্যাগাজিনে হাত দেওয়া মাত্র চারশো চল্লিশ ভোল্টে চলা যন্ত্রটি ওঁকে সম্পূর্ণ টেনে নেয়। শরীরের সমস্ত ফ্লুইড টেনে নেয়। হাড়চামড়া হয়ে যায় শরীর। এত বড়ো ইলেকট্রিক শক। কোনো নার্সিংহোম ভর্তি নিল না। উলুবেড়িয়া হাসপাতালে ভর্তি করলো লোকজন। মেজোমেসো ছিলেন, তাই সব ব্যবস্থা করে আমাদের খবর দেন।

আমি শ্বশুরবাড়িতে ফোন করলাম। অদ্ভুত, তাঁরা বললেন আমাদের কি যেতেই হবে। আমার এতো বড়ো বিপদেও তাঁদের পাশে পেলাম না। ভাই, ছোটোকাকা আমার কাজিনরা সবাই দেখভাল করতে লাগলো হাসপাতালে। সিজারের পর তখনও একদিনও বাইরে বেরোই নি আমি। পরিচর্যার মধ্যেই আছি। মন চাইলেও এতটুকু শিশুকে রেখে যেতে পারছি না হাসপাতালে। খবর পাচ্ছি সারা গায়ে র‌্যাশ বেরিয়ে গেছে। হাড়ের সঙ্গে চামড়া প্রায় এঁটে গেছে। মাংস পেশী কিছুই নেই। একদিন কষ্ট করে রেললাইন ধরে হেঁটেই চলে গেলাম হাসপাতালে। ওভারব্রিজের অতো সিঁড়ি ভাঙা তখন সম্ভব ছিল না। ক্যামেরায় মেয়ের ছবি তুলে নিয়ে গেলাম। মেয়ের ছবি দেখে প্রায় অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেলেন তিনি। পনেরো দিনেরও বেশি সময় ওঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়।

(ক্রমশ )

Post a Comment

0 Comments