এক মুঠো রোদ
পর্ব- ৩৮
স্বপন কুমার দে
সিকিম ট্যুর বেশ এনজয় করল সবাই। বাড়ির সব মেম্বারই গিয়েছিল। মল্লিকা ম্যাডামকেও যেতে বলা হয়েছিল, কিন্তু বিশেষ কাজ (?) থাকার জন্য মল্লিকার যাওয়া হয়নি। মন্টির পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যেই সবাই বেরিয়ে গিয়েছিল গিরিরাজ হিমালয়ের কোলে অবস্থিত সুন্দর শহর গ্যাংটকে। সেখান থেকে উত্তর এবং পূর্ব সিকিম ঘুরে দার্জিলিং টাচ্ করে বাড়ি ফিরতে বারো দিন লেগে গেল। সবার খুব ভালো লাগল, বিশেষত মন্টির আরও বেশি। পৃথিবীর এতটা উঁচুতে সে কখনও ওঠেনি এত উঁচু উঁচু পাহাড় যে বারে বারেই চোখ কপালে উঠছিল। কোনো কোনোটা আবার সাদা বরফে ঢাকা। মনেহয় কে যেন রূপোলি চাদর বিছিয়ে ঢেকে রেখেছে। গাড়ি থেমেছে মন্টির কৌতূহলের তাড়নায়। পাহাড়ের গায়ে বরফের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছবি তুলেছে। এত আনন্দ সে মুখে প্রকাশ করতে পারছে না, তাই সর্বাঙ্গ দিয়ে উপভোগ করতে চায়। কোথাও দেখছে দিনে দুপুরে পথে ঘাটে মেঘেদের আনাগোনা, গায়ে গা লাগিয়ে চলে যায়, কখনও বা হুড়মুড়িয়ে খোলা জানলা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। এখানে মেঘেরাও যেন পাশের বাড়ির প্রতিবেশী, যখন তখন বন্ধুত্ব করতে চলে আসে। মন্টি ভাবে কত কিছু আছে এই পৃথিবীতে।আমরা কতটুকুই বা জানি?এখানে না এলে এত কিছু বুঝতেও পারত না। ম্যাডামের কথা মনে পড়ল তার। ম্যাডামই প্রথম তার মনে অজানাকে জানবার জ্ঞানতৃষা জাগিয়েছেন। চলতে চলতে দেখা মেলে পাহাড়ি ঝর্ণার। শুধু দাঁড়িয়ে দেখতে হয় তার সৌন্দর্য। কী সুন্দর এই পার্বত্য ভূমি। মন্টির মন খারাপ হয় ম্যাডামের জন্য। কেন যে ম্যাডাম আসতে পারলেন না? খুব অভিমান হয়। এরপর আর দেখা হলেও কথা বলবে না ম্যাডামের সঙ্গে।
দার্জিলিঙে এসে পাহাড়ের গায়ে সবুজ সমুদ্র দেখেছে। চোখ জুড়িয়ে গেছে চায়ের বাগান দেখে। চা বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে। চা শ্রমিকদের পোশাক পরে ছবি তুলেছে। আরও কত কী! এসবের মাঝে ম্যাডাম থাকলে কত ভালো হত! আনন্দের মাঝেও মনখারাপ হয়।

মল্লিকার মনে হল, অনেকদিন মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়নি সিকিম থেকে ফিরুক, তারপর একদিন মন্টির বাড়িতে গিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে আসবে। পরীক্ষার জন্য এতদিন অনেক চাপে ছিল। এবার আর পড়ার কথা না বলে শুধু বেড়ানোর গল্প করবে। ও যে নিজেই নিজেকে শুধরে নিতে পেরেছে তারজন্য সত্যিই ওকে বাহবা দিতে হয়, নইলে এই বয়সে অনেক মেয়েই তো নিজেকে সংযত করতে পারে না কিন্তু মন্টি পেরেছে। মল্লিকা যাবে। মল্লিকারও সাধ রয়েছে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখার। সেটা যখন আপাতত হচ্ছে না তখন না হয় অন্যের চোখেই দেখা যাক।
বেড়িয়ে আসার পর যে কাজটি প্রথম করতে হবে বলে সুদেষ্ণার মনে হল, তা হল মন্টির টিউশন ঠিক করা। পরীক্ষার আগেই অবশ্য সায়েন্স সাবজেক্টগুলোর টিউটর ঠিক হয়ে গেছে। অংকের জন্য দুটো টিউশন। মল্লিকা ম্যাডাম আছেন, তার সঙ্গে আরও একজন 'নামডাকওয়ালা' টিচারকে দেওয়া হয়েছে। এতে অবশ্য মল্লিকার মতামত নেওয়া হয়নি, কারণ তাদের মেয়ের ভালোর জন্য তারা ইচ্ছামত টিউশন দিতে পারে, বদলাতে পারে। এরজন্য অন্য কারও মতামতের দরকার নেই।
মন্টি বাড়ি ফেরার পর মল্লিকাই মন্টিকে ফোন করেছিল। কেমন বেড়ানো হল, কী কী দেখল, এইসব নিয়ে যখন দুজনের মধ্যে কথা বার্তা চলছিল, তখন কে বলবে একজন শিক্ষিকা আর একজন ছাত্রী। মনে হল দুই বন্ধু যেন একাত্মভাবে কথা বলছে। দুজনের কথার মাঝেই ঢুকল মন্টির মা সুদেষ্ণা। ফোনটা মন্টির কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে মল্লিকার সঙ্গে কথা শুরু হল," হ্যালো ম্যাডাম, ভালো আছেন?"
অপরপ্রান্ত থেকে," হ্যাঁ, ভালো আছি। আপনারা সব ঠিকঠাক তো?" হেসে প্রত্যালাপ জমাল মল্লিকা।
এ প্রান্ত কিছুটা সিরিয়াস," হ্যাঁ, বলছি শুনুন, আগামী সপ্তাহ থেকে আপনি পড়াতে শুরু করে দিন। অবশ্য, ম্যাথের জন্য আমরা আর একজন টিচার ঠিক করেছি। আপনি যেমন পড়াচ্ছেন পড়ান, তার সাথে উনিও পড়াবেন। শুনেছি উনি খুবই এফিসিয়েন্ট।"মল্লিকা চুপ করে রইল। এইসব প্রান্ত থেকে সুদেষ্ণা কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করল। পরে মল্লিকাই বলল,
" ঠিক আছে, আপনাকে পরে বলছি।"
" ঠিক আছে, রাখছি তাহলে।" ফোনটা কেটে দিল।
মল্লিকা বুঝল, তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই, এখন গুরুত্বও কমে গেছে। ওরা মল্লিকার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগল। যে মন্টিকে সে তিল তিল করে গড়ে তুলল, যাকে শুধুমাত্র একজন ছাত্রীর নজরে না দেখে অত্যন্ত আপনজনের মত স্নেহে, শাসনে, কর্তব্যে মন্টির সেরাটা বার করবার চেষ্টা করেছে, তার বাড়ির লোকেরাই আস্থা হারিয়ে ফেলল। এখন, এই অবস্থায় , অনধিকার অভিভাবকত্ব পালনের জন্য সে লজ্জিত হল। তার মনে হল, আর নয়। যেখানে আত্মমর্যাদা লঙ্ঘিত হয় সেখানে থাকা উচিত নয়। জীবনে অর্থোপার্জনটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, তার সাথে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানটাও জরুরি।
সুদেষ্ণা ভাবল, সে যা করেছে মেয়ের মঙ্গলের জন্যই করেছে। মেয়েটা দিনে দিনে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। তাছাড়াও, মল্লিকা ম্যাডামের প্রতি মন্টির ভালোবাসা যেন অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছিল। তার ভয় হচ্ছিল, এইভাবে বাড়তে বাড়তে হয়তো একদিন মায়ের প্রতি ভালোবাসা কমে যেতে পারে। আবার অন্য দিকে শ্বশুর এবং স্বামী যেভাবে মল্লিকার গুণগান করে, সেখানে হয়তো বাড়ির বউ হিসেবে তার গুরুত্ব কমে যাবে। বাইরের একজন মহিলা তার অধিকৃত আসন কেড়ে নেবে? এই অধিকার হারানোর ভয় তাকে ভেতরে বাইরে ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছিল, তাই সে আজ মল্লিকার আসল জায়গাটা চিনিয়ে দিতে পেরেছে বলে মনে কিছুটা স্বস্তি পেল।
স্বামী-শ্বশুর সুদেষ্ণার এই সিদ্ধান্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সুদেষ্ণা এ বিষয়ে অনড়। সে স্পষ্ট শুনিয়ে দিয়েছিল, তাহলে মন্টির পড়াশোনার ব্যাপারে সে আর কোনও কিছু দেখবে না। যারা ভালো চায়, তারাই যেন বাকি সব করে। বাকিরা চুপ হয়ে গেছল, কারণ, আর যাই হোক না কেন, গৃহশান্তিটা অত্যন্ত জরুরি।
পরদিন মল্লিকার ফোন সুদেষ্ণাকে," বৌদি, বলছিলাম, এবার আর হচ্ছে না গো। আপনারা ঠিকই করেছেন অল্টারনেটিভ আর একজন টিচারকে ডিপ্লয় করে। আমার পড়ার চাপ খুব বেড়ে গেছে। থিসিস জমা দেওয়ার জন্য একস্ট্রা টাইম স্পেন্ড করতে হচ্ছে। তাছাড়া, এবার কলেজ সার্ভিসের জন্য তৈরি হতে হবে। আমি টিউশন অনেক কমিয়ে দিয়েছি। কাজেই আপনারা আমাকে মাফ করবেন।"
সুদেষ্ণা গলায় অতিরিক্ত জোর দিয়ে কৃত্রিম অভিমানের সুরে বলে, " ওমা, সে কী! মন্টির তো আপনাকে ছাড়া চলেই না। না বললে চলবে না।"
মল্লিকা কোনও রকম আড়ষ্টতা ছেড়ে সোজা ভাষায় জবাব দেয়," না বৌদি। আমি ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি। আর মন্টি খুব ভালো মেয়ে। ওর জন্য সবসময়ই আমার ভালোবাসা থাকবে। এখন তাহলে রাখি?" বলে উত্তরের প্রতীক্ষা করল না।
খবরটা মন্টির বাড়ির সকলে জানল। অমরেশবাবু আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মণিদীপা চুপ করে থাকলেন, উদ্দালক বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেও শেষমেষ গৃহশান্তির জন্য চুপ করে গেল। মন্টি বুঝল, তার পড়াশোনার ব্যাপারে তার মায়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। প্রকাশ্যে কান্নাকাটিতে তার বাধা নেই তবুও কেন জানিনা চোখে জল পড়লেও নিজের কাঠিন্যে সে জল শুকিয়ে গেল।
সম্পূরকও শুনল কথাটা । বৌদিকে বোঝাতে চেয়েছিল কিন্তু বাবার নিশ্চুপ চাহনি আর মায়ের উদ্বেগভরা মুখের দিকে চেয়ে সে ক্ষান্ত হল।
কিছুদিন পরে যখন মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল, সেদিন নিজের মার্কশীটটার দিকে চেয়ে মন্টির চোখ দুটো জলে ভরে গেল। মার্কশীটে জ্বল জ্বল করছে, ম্যাথেমেটিকস্ একশোর মধ্যে একশো !
পর্ব- ৩৮
স্বপন কুমার দে
সিকিম ট্যুর বেশ এনজয় করল সবাই। বাড়ির সব মেম্বারই গিয়েছিল। মল্লিকা ম্যাডামকেও যেতে বলা হয়েছিল, কিন্তু বিশেষ কাজ (?) থাকার জন্য মল্লিকার যাওয়া হয়নি। মন্টির পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যেই সবাই বেরিয়ে গিয়েছিল গিরিরাজ হিমালয়ের কোলে অবস্থিত সুন্দর শহর গ্যাংটকে। সেখান থেকে উত্তর এবং পূর্ব সিকিম ঘুরে দার্জিলিং টাচ্ করে বাড়ি ফিরতে বারো দিন লেগে গেল। সবার খুব ভালো লাগল, বিশেষত মন্টির আরও বেশি। পৃথিবীর এতটা উঁচুতে সে কখনও ওঠেনি এত উঁচু উঁচু পাহাড় যে বারে বারেই চোখ কপালে উঠছিল। কোনো কোনোটা আবার সাদা বরফে ঢাকা। মনেহয় কে যেন রূপোলি চাদর বিছিয়ে ঢেকে রেখেছে। গাড়ি থেমেছে মন্টির কৌতূহলের তাড়নায়। পাহাড়ের গায়ে বরফের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছবি তুলেছে। এত আনন্দ সে মুখে প্রকাশ করতে পারছে না, তাই সর্বাঙ্গ দিয়ে উপভোগ করতে চায়। কোথাও দেখছে দিনে দুপুরে পথে ঘাটে মেঘেদের আনাগোনা, গায়ে গা লাগিয়ে চলে যায়, কখনও বা হুড়মুড়িয়ে খোলা জানলা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। এখানে মেঘেরাও যেন পাশের বাড়ির প্রতিবেশী, যখন তখন বন্ধুত্ব করতে চলে আসে। মন্টি ভাবে কত কিছু আছে এই পৃথিবীতে।আমরা কতটুকুই বা জানি?এখানে না এলে এত কিছু বুঝতেও পারত না। ম্যাডামের কথা মনে পড়ল তার। ম্যাডামই প্রথম তার মনে অজানাকে জানবার জ্ঞানতৃষা জাগিয়েছেন। চলতে চলতে দেখা মেলে পাহাড়ি ঝর্ণার। শুধু দাঁড়িয়ে দেখতে হয় তার সৌন্দর্য। কী সুন্দর এই পার্বত্য ভূমি। মন্টির মন খারাপ হয় ম্যাডামের জন্য। কেন যে ম্যাডাম আসতে পারলেন না? খুব অভিমান হয়। এরপর আর দেখা হলেও কথা বলবে না ম্যাডামের সঙ্গে।
দার্জিলিঙে এসে পাহাড়ের গায়ে সবুজ সমুদ্র দেখেছে। চোখ জুড়িয়ে গেছে চায়ের বাগান দেখে। চা বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে। চা শ্রমিকদের পোশাক পরে ছবি তুলেছে। আরও কত কী! এসবের মাঝে ম্যাডাম থাকলে কত ভালো হত! আনন্দের মাঝেও মনখারাপ হয়।
🍂
বেড়িয়ে আসার পর যে কাজটি প্রথম করতে হবে বলে সুদেষ্ণার মনে হল, তা হল মন্টির টিউশন ঠিক করা। পরীক্ষার আগেই অবশ্য সায়েন্স সাবজেক্টগুলোর টিউটর ঠিক হয়ে গেছে। অংকের জন্য দুটো টিউশন। মল্লিকা ম্যাডাম আছেন, তার সঙ্গে আরও একজন 'নামডাকওয়ালা' টিচারকে দেওয়া হয়েছে। এতে অবশ্য মল্লিকার মতামত নেওয়া হয়নি, কারণ তাদের মেয়ের ভালোর জন্য তারা ইচ্ছামত টিউশন দিতে পারে, বদলাতে পারে। এরজন্য অন্য কারও মতামতের দরকার নেই।
মন্টি বাড়ি ফেরার পর মল্লিকাই মন্টিকে ফোন করেছিল। কেমন বেড়ানো হল, কী কী দেখল, এইসব নিয়ে যখন দুজনের মধ্যে কথা বার্তা চলছিল, তখন কে বলবে একজন শিক্ষিকা আর একজন ছাত্রী। মনে হল দুই বন্ধু যেন একাত্মভাবে কথা বলছে। দুজনের কথার মাঝেই ঢুকল মন্টির মা সুদেষ্ণা। ফোনটা মন্টির কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে মল্লিকার সঙ্গে কথা শুরু হল," হ্যালো ম্যাডাম, ভালো আছেন?"
অপরপ্রান্ত থেকে," হ্যাঁ, ভালো আছি। আপনারা সব ঠিকঠাক তো?" হেসে প্রত্যালাপ জমাল মল্লিকা।
এ প্রান্ত কিছুটা সিরিয়াস," হ্যাঁ, বলছি শুনুন, আগামী সপ্তাহ থেকে আপনি পড়াতে শুরু করে দিন। অবশ্য, ম্যাথের জন্য আমরা আর একজন টিচার ঠিক করেছি। আপনি যেমন পড়াচ্ছেন পড়ান, তার সাথে উনিও পড়াবেন। শুনেছি উনি খুবই এফিসিয়েন্ট।"মল্লিকা চুপ করে রইল। এইসব প্রান্ত থেকে সুদেষ্ণা কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করল। পরে মল্লিকাই বলল,
" ঠিক আছে, আপনাকে পরে বলছি।"
" ঠিক আছে, রাখছি তাহলে।" ফোনটা কেটে দিল।
মল্লিকা বুঝল, তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই, এখন গুরুত্বও কমে গেছে। ওরা মল্লিকার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগল। যে মন্টিকে সে তিল তিল করে গড়ে তুলল, যাকে শুধুমাত্র একজন ছাত্রীর নজরে না দেখে অত্যন্ত আপনজনের মত স্নেহে, শাসনে, কর্তব্যে মন্টির সেরাটা বার করবার চেষ্টা করেছে, তার বাড়ির লোকেরাই আস্থা হারিয়ে ফেলল। এখন, এই অবস্থায় , অনধিকার অভিভাবকত্ব পালনের জন্য সে লজ্জিত হল। তার মনে হল, আর নয়। যেখানে আত্মমর্যাদা লঙ্ঘিত হয় সেখানে থাকা উচিত নয়। জীবনে অর্থোপার্জনটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, তার সাথে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানটাও জরুরি।
সুদেষ্ণা ভাবল, সে যা করেছে মেয়ের মঙ্গলের জন্যই করেছে। মেয়েটা দিনে দিনে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। তাছাড়াও, মল্লিকা ম্যাডামের প্রতি মন্টির ভালোবাসা যেন অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছিল। তার ভয় হচ্ছিল, এইভাবে বাড়তে বাড়তে হয়তো একদিন মায়ের প্রতি ভালোবাসা কমে যেতে পারে। আবার অন্য দিকে শ্বশুর এবং স্বামী যেভাবে মল্লিকার গুণগান করে, সেখানে হয়তো বাড়ির বউ হিসেবে তার গুরুত্ব কমে যাবে। বাইরের একজন মহিলা তার অধিকৃত আসন কেড়ে নেবে? এই অধিকার হারানোর ভয় তাকে ভেতরে বাইরে ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছিল, তাই সে আজ মল্লিকার আসল জায়গাটা চিনিয়ে দিতে পেরেছে বলে মনে কিছুটা স্বস্তি পেল।
স্বামী-শ্বশুর সুদেষ্ণার এই সিদ্ধান্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সুদেষ্ণা এ বিষয়ে অনড়। সে স্পষ্ট শুনিয়ে দিয়েছিল, তাহলে মন্টির পড়াশোনার ব্যাপারে সে আর কোনও কিছু দেখবে না। যারা ভালো চায়, তারাই যেন বাকি সব করে। বাকিরা চুপ হয়ে গেছল, কারণ, আর যাই হোক না কেন, গৃহশান্তিটা অত্যন্ত জরুরি।
পরদিন মল্লিকার ফোন সুদেষ্ণাকে," বৌদি, বলছিলাম, এবার আর হচ্ছে না গো। আপনারা ঠিকই করেছেন অল্টারনেটিভ আর একজন টিচারকে ডিপ্লয় করে। আমার পড়ার চাপ খুব বেড়ে গেছে। থিসিস জমা দেওয়ার জন্য একস্ট্রা টাইম স্পেন্ড করতে হচ্ছে। তাছাড়া, এবার কলেজ সার্ভিসের জন্য তৈরি হতে হবে। আমি টিউশন অনেক কমিয়ে দিয়েছি। কাজেই আপনারা আমাকে মাফ করবেন।"
সুদেষ্ণা গলায় অতিরিক্ত জোর দিয়ে কৃত্রিম অভিমানের সুরে বলে, " ওমা, সে কী! মন্টির তো আপনাকে ছাড়া চলেই না। না বললে চলবে না।"
মল্লিকা কোনও রকম আড়ষ্টতা ছেড়ে সোজা ভাষায় জবাব দেয়," না বৌদি। আমি ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি। আর মন্টি খুব ভালো মেয়ে। ওর জন্য সবসময়ই আমার ভালোবাসা থাকবে। এখন তাহলে রাখি?" বলে উত্তরের প্রতীক্ষা করল না।
খবরটা মন্টির বাড়ির সকলে জানল। অমরেশবাবু আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মণিদীপা চুপ করে থাকলেন, উদ্দালক বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেও শেষমেষ গৃহশান্তির জন্য চুপ করে গেল। মন্টি বুঝল, তার পড়াশোনার ব্যাপারে তার মায়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। প্রকাশ্যে কান্নাকাটিতে তার বাধা নেই তবুও কেন জানিনা চোখে জল পড়লেও নিজের কাঠিন্যে সে জল শুকিয়ে গেল।
সম্পূরকও শুনল কথাটা । বৌদিকে বোঝাতে চেয়েছিল কিন্তু বাবার নিশ্চুপ চাহনি আর মায়ের উদ্বেগভরা মুখের দিকে চেয়ে সে ক্ষান্ত হল।
কিছুদিন পরে যখন মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল, সেদিন নিজের মার্কশীটটার দিকে চেয়ে মন্টির চোখ দুটো জলে ভরে গেল। মার্কশীটে জ্বল জ্বল করছে, ম্যাথেমেটিকস্ একশোর মধ্যে একশো !
0 Comments