ভাঙা আয়নার মন
পর্ব ২৫
গনগনে পপি ফুলের খেত
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
আশপাশের গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুল থেকে ফাইভে এসে ভর্তি হয়েছে অনেক মেয়ে।নতুন ইস্কুলে তাই অনেক নতুন বন্ধুও হয়েছে ঝিনির। বি সেকশনের পারুল রেজিনাদের দলে ভিড়ে টিফিনে তারা গাদন খেলে নেয় এক পক্কর। বাড়ি থেকে পাকা রাস্তা ধরে ইস্কুলে যেতে লাগে তার পাঁচ মিনিট।সে অবিশ্যি হেগো পুলিনদের শিম বেগুনের খেতের ভেতর দিয়ে দৌড়ে মিনিট দেড়েকেই ইস্কুলের বারান্দায় গিয়ে ওঠে।পুলিনদের বাড়ি ভোস পাড়ায়।তা সে পাড়ার রাস্তার ধারে কবে কে নাকি ভোর ভোর বাসি রুটি আর চিনি হাতে পুলিনকে পায়খানা করতে দেখেছিল;সেই ইস্তক ছেলেপিলে তাকে হেগো পুলিন বলে ক্ষেপায়। ওই ডাক শুনতে পেলেই নেই পুলিন ক্ষেপে আগুন হয়ে হারামজাদা শোরের বাচ্চা কনেগার! মুকি তোদের দোবানি এঙদিন হেগো পোঁদ ঘসি!পুলিনের এইসব গালাগালি শুনে হাসতে হাসতে দৌড় দেয় সবাই। দৌড়তে দৌড়তে ছড়া কাটে রুটি হাতে হাগতি বসে... দুই ধারে দুই শগুন বসে ...ঢিল বা আধলা ইট উড়ে আসে পুলিনের দিক থেকে। পাল্টা ঢিল ছোড়াও চলে।
প্রত্যেক বছর ঝিনিদের বাড়ি আর বাগানের চৌহদ্দি ঘিরে বাঁশের বেড়া দেয় করিম ভাই আর তাতে চড়ে লাফালাফি খেলে বা ডিঙিয়ে প্রত্যেকবারই তা ভেঙে ফেলে ঝিনিরা।কাঠকুড়ুনিরাও প্রায়ই আলগা বাঁশের চটা টান দিয়ে ভেঙে নিয়ে যায়। উত্তর দিকের বেড়া ডিঙোলেই পুলিনদের খেত।
হেগো পুলিনদের খেতের বাকি তিন দিক ঢোল কলমি আর আটছট্টির ঝোঁপে ঘেরা। ওদের দিয়ে শর্টকাট তাকে করতেই হয়। প্রায় প্রায়ই পুলিনের বাবা নালিশ করে যায় মাকে।দেখুন দিকি বড়দিদুমনি,হেঁটি হেঁটি আলু খেতের মাঝ বরাব্বর কেরাম টাক ফেলি দিয়েছ একেবার।খেতির মাঝ দে দৌড় দে দে খুকি একলাই একখান রাস্তা তোয়ের করিছ । কাজেই হরহামেশা মা'র হাতে স্কেলপেটা তাকে হতেই হয়।
অথচ একা সে না;মনি টেনি খোকন বাচ্চুদের সাথে ওই খেতের পশ্চিম পাড়ের হেড়ো টক বনকুল, কষা দিশি পেয়ারা সের গুটি আর পানসে আটছট্টির ফল খেতে সবাই যায়। ছুটিছাটার দুপুর বা আলগা ফাঁক পেলেই ওদের খেতের কোণায় গিয়ে বুনো অতসীর বীজ ফটফট ফাটায় বা আকন্দের ফল খুঁড়ে ছোট্ট ছোট্ট চোখ আঁকা পুতুলের মতো বীজ বের করে এমনকি স্রেফ কচা গাছের আঠায় ফুঁ দিয়ে বুদবুদ ওড়ানোর জন্যও পুলিনদের খেতটাকেই টার্গেট করে ওরা।
তাছাড়া খেজুর পাতায় যে ঘাসের সবুজ বীজ রেখে চুউউউউ করে টানলে সুড়সুড় করে পাতা বেয়ে আসে বীজটা যেন গুড়গুড়িয়ে পাতা বেয়ে পোষমানা জ্যান্ত এক শুঁয়োপোকা চলেছে সেই ঘাসগুলোও কেন কে জানে কেবল ওদের জমির ধারেই জন্মায়।
তবে ফাইভে ওঠা ইস্তক সবচেয়ে জরুরি হলো ইস্কুলে পৌঁছোনোর ওই শর্টকাট।রোজ সকালে নমো নমো নমো করে পড়া করে বাক্স গুছিয়ে টুক করে বেড়া ডিঙিয়ে খেতের মধ্যে দিয়ে আড়াআড়ি দৌড়ে ইস্কুলের বারান্দায় গিয়ে ওঠে।
দোতলা ইস্কুলঘরের একতলার ঘরগুলো তখনো প্লাস্টার হয়নি। প্রত্যেক ক্লাসরুমের বারান্দামুখো দুই দরজা।
ছুটির পর জানলা বন্ধ করে এক দরজা ভেতর থেকে খিল লাগিয়ে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে ইস্কুলের পিওন রক্ষেদা বা রাধাদি তালা ঝুলিয়ে দেয়। তাদের ক্লাসের দরজার পাশেই পলেস্তারাহীন দেওয়ালে একটা বড়সড় ইট বার করা ফুটো। বোধহয় ওখান দিয়ে পরে ওয়ারিং তার বা কিছু যাবে।গর্তটা নজরে করতে করতে ঝড়াক করে শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়।বাড়ির চোখ এড়িয়ে দৌড়ে এসে রোজ সকালে অনায়াসে সেই ফুটো দিয়ে হাত গলিয়ে দরজার খিল খুলে বইয়ের বাক্স সামনের বেঞ্চে পছন্দমতো জায়গায় রেখে বাইরে থেকে আবার একই পদ্ধতিতে সে দরজা বন্ধ করে দেয়। ফের হেগো পুলিনদের বাগান পার করে বাড়ি ফিরেই পুকুরে ঝাঁপ। এপার ওপার করে বেশ খানিক চান করে ভাত খেয়ে ঘন্টা পড়লেই একদৌড়ে সেই বেড়া ডিঙিয়ে একেবারে প্রেয়ারের লাইনে।
ভালোই চলছিল বেশ ক'দিন কিন্তু ভালো মানুষদের কপালে সুখ কি আর সহ্য হয়! প্রথমে খেয়াল করে রক্ষেদা। বন্ধ ঘরে বইয়ের বাক্স আসছে কোত্থেকে? মাকে সেই জানালো এবং বামাল সমেত রক্ষেদার হাতেই ধরা পড়ে মা'র কাছে আসামীকে হাজির হতে হলো।
ইস্কুলে মা'র গম্ভীর মুখ দেখে মনে হয় যেন আর কেউ। ভালো করে না তাকিয়েই গনগনে মুখে রায় দিয়ে দিল মা। কাজেই মানসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে কান ধরে তাকে অফিসের সামনে দাঁড়াতেই হলো ঘণ্টাখানেক। ঘাড় টনটন, হাত কনকন চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে যখন,রক্ষেদা মুচকি হেসে বলল বড়দি ক্লাসে যেতে হুকুম দিলেন।ছুটির পর বাড়িতে ফিরেও দাদাদের ফিক ফিক হাসি আর টিপ্পনিতে জীবন তার মহানিশা।
অবিশ্যি সব কি আর খারাপ হয় জীবনে? তার দিন দুই পরেই জষ্টি মাসের ন'তারিখে মা বললো বসিরহাট যাবি? সেও লাফিয়ে উঠল।
গরমের দিন বলে প্রতি জন্মদিনেই মা পাতলা সুতির ফুলছাপ ছিট কাপড় কিনে নিজেই গলায় হাতে কুঁচি দেওয়া ফ্রক বানিয়ে দেয়। সেদিনকার জন্মদিনে সেই জামা পরিয়ে মা'র সাথে চলল পুরোনো বাজারের আলোছায়া স্টুডিওতে।ছবি তোলার আগে চুল আঁচড়ে পাউডার মাখিয়ে দিল মা।
নিজেও একটু সেজে সিঁড়ির সিনের সামনে আমার হাত ধরে দাঁড়ালো আর ডান হাতটা রাখলো সিঁড়ির ছবির রেলিঙে। ক্যামেরাকাকুই অবশ্য ছবি তোলার আগে সেভাবে বলে দিয়েছিল মাকে।ব্যস ছবিতে মা আর সে নেমে আসছিল সিঁড়ি ধরে।
ছবি তুলে মার মেজাজ বেশ ভালোই ছিল শাদা পুঁতি বসানো একটা হেয়ার ব্যান্ড কিনে দিল দোকানি হেঁকে বলছিল নিয়ে যান এক্কেবারে নতুন স্টাইল এই সরি ম্যাডাম হেয়ার ব্যান্ড।নাম শুনে মা হেসে ফেলল বটে কিন্তু জন্মদিনটার সবকিছুই চমৎকার লাগছিল তার। মা জিজ্ঞেস করল আর কিছু নেবে? ভয়ে ভয়ে সে বলল গল্পের বই।
স্কুল লাইব্রেরি বলে এক দোকান যেখানে পড়ার বইপত্র খেলার সরঞ্জামের সাথে কিছু গল্পের বইও পাওয়া যায় সেখান থেকেই মা তাকে ঠাকুমার গল্প কিনে দিল। সে বইয়ে ভালো কাঠুরিয়া,বড় রাম-ছোট রামের গল্প, ক্ষীরের নদীর গল্প অনেকটা রুশ গল্প দুধের নদী সুজির পাড়ের মত তবে গল্পের শেষে ক্ষীরের সে নদীতে পদ্ম ফুলও ফুটেছিল আবার লক্ষী ঠাকরুন সে পদ্মে চড়ে ফিকফিক হাসছিলেনও।
পরণকথার আলোভর্তি সেই বই কোন মাঠের শেষে জন্তি গাছের ছায়ায় মিশে আছে কে জানে যার অজস্র গল্পের ঝুরিতে হীরেমন তোতা রুপোর ডালে বসে সোনার পাতা দুলিয়ে মানিকের ফল ঠোঁটে করে ঘুমিয়ে পড়েছে কতবার।
ঝিনিইই ওঠ ওঠ উঠলি? মা'র ডাকে ঘুম ঠেলে উঠতেই হবে।ক্যায়সে এ ভলাই রে কানাই... তখন ভোরবেলা রোজ পানিয়া ভরত মেরে গাগরি গিরাই আর ভৈরবীর ছুট বন্দিশে বেজে ওঠে ক্লাস সেভেনের হারমোনিয়াম।সবাই বলে ছোড়দার গলা খুব ভালো।মনের আনন্দে ছোড়দা রেওয়াজেও বসে নিয়মিত।ঘুম ভেঙে রোজ এই গলা সাধা ঝিনির অবিশ্যি ভাল্লাগে না কিন্তু মা ছাড়লে তো। তবে গান দিদিমণির সঙ্গেই সে প্রথম গেল বসিরহাট টাউন হলে রোববারের এক জলসায়।
চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত আর ধীরেন বসুর নজরুলগীতি শুনে ফেরার রাস্তায় বেগুনী ফুলে ভরা মাইল মাইল জাফরান খেতের মত গানের উজ্জ্বল সেই ঘোর তো আর কাটে না।
তার চেয়েও আশ্চর্য হলো শুভ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক শিল্পীর সরোদ বাজানো।
🍂
যেন অজস্র কাঁচের চুড়ির রিনঠিন আর জলতরঙ্গ নকশার রুপোফুল ফুট ছিল চারধারে তার।
পুরোনো বাজারে আশ্চর্য সব দোকানও আছে।মাঝে সাঝে মা'র মেজাজ ভালো থাকলে ছটা বা আটটা কাচের চুড়ি কিনে দেয় চুড়ির দোকান থেকে। বারবার হাত ঘুরিয়ে দেখে রামধনু লেগে আছে তাদের গায়ে।মণি টেনি বাচ্চু বেবি কেউ তারা ভাঙা চুড়ি ফেলে না। একটা থলিতে ভাঙা চুড়ি রাখে তারা। চক দিয়ে চৌকোনা এক ঘর কেটে উপুড় করে সব চুড়ি ফেলে অন্য টুকরো না ছুঁয়ে একটা করে টুকরো দাগের বাইরে আনলে পয়েন্ট।টাচ করলেই আউট।
আর হলো ভাঙা চুড়ির ক্যালাইডোস্কোপ।
রঙচঙে দেদার নকশায় জড়িয়ে যায় চোখ। নিঝুম দুপুরে ভাঙা চুড়ির আশ্চর্য খেলায় তারা গেঁথে তোলে রঙিন কাচের দেওয়াল রিনরিন শব্দে যা ভেঙে পড়বেই অসম্ভব সুর বরাবর।
একবার মাত্র একবারই মার কাছে বায়না করে ঝিনি সুর্মা কিনলো ওই চুড়ির দোকান থেকেই আর বুড়ো চাচা তার সবুজ ছিটের সালোয়ার আর ওড়নায় ঝিমঝিম এক আতর ছিটিয়ে দিলো।
গান দিদিমণির সাথে জলসায় গিয়ে সে দেখল সরোদের সুর ওইরকম কারুকাজ করা আর আতরের ঝিমঝিম নেশার মতো।
পরবছর গানের পরীক্ষা দিয়ে দিদিমণির সঙ্গেই ওই টাউন হলে সে শুনলো রজত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে ... " আমাকে কঠিন বাহু দিয়ে বাঁধো তুমি/গলুক বুকের অশ্রু জমাট শিলা/দাও তুমি ভালবাসাকে জন্মভূমি/ঘৃণার ধনুকে আমি টেনে বাঁধি ছিলা"!
এ কেমন সব কথা? যা ভেতরে কোথাও বাজতে থাকে বাজতেই থাকে যেন কথার উত্তাপ থেকে তুলে নিয়েছে সে এক টুকরো শিখা যা আসলে নীল।
আর তারপরই শুরু হলো গণসঙ্গীত।
কী উদ্দীপ্ত ভঙ্গিতে তারা গাইছিল ..নাম তার ছিল জন হেনরি..।মেরি ম্যাকদেলিনের ছোট্ট মেয়ের জন্য বুক মুচড়ে উঠলো তার অথচ কান্নার চেয়েও বড় কিছু যেন কেলাস সেভেনের ঝিনির বুকে বিঁধিয়ে গেল। শীতের কালে তাদের বাবা যে মরশুমি ফুলের খেত করে। পপি, গাঁদা,জিনিয়া সব ঝলমলে মাথা তোলে দেদার। সেই পপি ফুলের গনগনে আগুনের মত সে গান। মোটা দাড়ার তুলি থুপে থুপে গাইয়েরা শব্দের ফুলকি আঁকছিল এমন, ঝিনির অচেনা কোন দিগন্তে যেন জন্মের শোধ সে রঙের ছোপ লেগে গেল।
0 Comments