জ্বলদর্চি

কার্তিকী ষষ্ঠী বা ছট পুজো /পি.শাশ্বতী

কার্তিকী ষষ্ঠী বা ছট পুজো

পি.শাশ্বতী

ভারত উৎসব প্রধান দেশ। প্রায় সব উৎসবই ধর্ম কেন্দ্রিক। সেই আবহমান কাল থেকে চলে আসছে নানা পুজো, উৎসব, পার্বণ। আর প্রধান নদীর গতিপথে উপনদীর মত এসে মিশেছে আরও অনেক পুজো, দেব-দেবী। বিবর্তিতও হয়েছে পুজাচার, নিয়ম রীতির, মাতৃকা ও দেব মূর্তি গুলি।  
উত্তর ভারত, বিহার,ঝাড়খণ্ড ও নেপালে ছট পুজো যদিও জনপ্রিয়তার শীর্ষে তবুও কলকাতা শহরের বহু অবাঙালি সম্প্রদায় এই পুজো নিষ্ঠা সহকারে পালন করেন।
ছট পুজো আসলে সূর্য এবং তাঁর স্ত্রীদের উপাসনা। 
ছট শব্দটা 'প্রাকৃত' যা এসেছে সংস্কৃতের ষষ্ঠ শব্দ থেকে | দীপাবলীর ঠিক ৬ দিনপরে কার্তিক মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে পুজো করা হয় সূর্যদেবকে । তাই এর নাম ছট পুজো । বিশ্বাস করা হয়‚ বৈদিক যুগের আগে থেকেই ছট পুজো বা সূর্য উপাসনার চল ছিল।
পুরাণ ও মহাকাব্যে তখনকার ভারতকে অঙ্গ,বঙ্গ,কলিঙ্গ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিহার,ঝাড়খণ্ড,উত্তরপ্রদেশের একটি বড় অংশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা  নিয়ে ছিল অঙ্গদেশ। 
অস্ত্রশিক্ষার শেষে কৌরব ও পাণ্ডবদের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের সময় সুতপুত্র কর্ণ উপস্থিত হন অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। রাজপুত্র ছাড়া কেউ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেনা। তাই অপমানিত কর্ণকে হস্তিনাপুর রাজবংশের অধীন অঙ্গদেশের রাজা ঘোষণা করলেন দুর্যোধন। কারণ কর্ণের মত শ্রেষ্ঠ তেজী ধনুর্ধর ও যুদ্ধ পারদর্শী বীর স্বপক্ষে থাকলে যে কোন যুদ্ধে অবলীলায় জয়লাভ হবে বলে মনে করতেন দুর্যোধন। কানীন পুত্র কর্ণকে চিনতে পারলেও সেদিনও তাকে পুত্র বলে স্বীকার করেননি কুন্তী। গোপন রেখেছেন তাঁর প্রথম সন্তান কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত।

🍂

কর্ণের পরিচয় ছিল সারথি অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধার সন্তান হিসেবে। নিজেকে সূর্যদেবের পুত্র রূপে না জানলেও কর্ণ কিন্তু প্রথম থেকেই সূর্যের উপাসক ছিলেন। প্রচলিত আছে, অঙ্গদেশের রাজা হওয়ার পরে সেই অঞ্চলে ধুমধাম করে সূর্যদেবের পুজো ও উৎসবের প্রচলন করেন কর্ণ এবং সেই উৎসবই কয়েক হাজার বছর পেরিয়ে আজও রয়েছে ছটপুজো হিসেবে। মহাভারতের গল্প অনুযায়ী কর্ণের শরীরে সব সময় থাকত একটি কবচ ও কুণ্ডল যা ছিল সূর্যদেবের আশীর্বাদ। ওই কবচ-কুণ্ডল থাকার জন্যেই তাঁকে বধ করা ছিল অসম্ভব।দুজনেই আপন কক্ষজাত। যুদ্ধে একজনের মৃত্যু নিশ্চিত। তাই অর্জুন ও কর্ণকে পরস্পর বিরোধী পক্ষে না রেখে ধর্মের পথ, সত্যের পথ পাণ্ডব পক্ষে যোগদানে আমন্ত্রণ জানান কুন্তী,কৃষ্ণের পরামর্শে।কৃতজ্ঞ থাকায় কর্ণ অধর্ম,অসত্যের পক্ষ দুর্যোধন কে ত্যাগ করতে পারেননি। কৃষ্ণের পরামর্শ অনুযায়ী  কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে কুন্তী নিজের পরিচয় দিয়ে সেই কবচ-কুণ্ডল চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর আরেক সন্তান, সমাজ স্বীকৃত, অর্জুনকে বাঁচানোর জন্য । ধর্মপ্রাণ ও দাতা বলে পরিচিত কর্ণ সেই অনুরোধ ফেরাতে পারেননি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু রাজা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তাই হয়তো তাঁর মৃত্যুর পরেও অঙ্গদেশের মানুষ ভক্তিভরে সূর্যষষ্ঠী ও ছটপুজো পালন করে এসেছেন এবং এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে এই উৎসবের মাহাত্ম্য।

এই পুজোর সূত্রপাত নিয়ে আরও দু’তিনটি লোকগাথা প্রচলিত আছে। যেমন অনেকে বলেন, রাম-সীতা ১৪ বছর বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যায় ফেরার পরে এই পুজো করেছিলেন। আবার আর একটি গল্প রয়েছে রাজা প্রিয়ব্রতকে নিয়ে। অনেক যজ্ঞ করার পরে তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃতপুত্র প্রসব করেন রানি। শোকে-দুঃখে রাজা আত্মহত্যা করতে গেলে, তাঁর সামনে এসে দাঁড়ান দেবী ষষ্ঠী এবং তিনি বলেন যদি কেউ শুদ্ধচিত্তে তাঁর পুজো করে তবে তার সন্তানলাভ হবে। রাজা প্রিয়ব্রত সেই আদেশ পালন করেন এবং তাঁর সন্তান হয়। তার পর থেকেই ঘরে ঘরে ছটপুজোর প্রচলন হয়। কিন্তু সেই পুজো শুধু ‘বিহারী’ সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, বিহার-বংশোদ্ভুত ছাড়া দেশের কোণায় কোণায় থাকা অন্যান্য ধার্মিক হিন্দুরা, যাঁরা প্রতিদিন নদীতে স্নান করে সূর্যপ্রণাম করে দিন শুরু করেন, তাঁরাও কিন্তু এই পুজো করেন না। বরং ভারতের বহু অঞ্চলে মাঘ মাসে সূর্যদেবের উদ্দেশে রথ-সপ্তমী পালিত হয়। অর্থাৎ মহাভারত ও কর্ণের কাহিনীই এক্ষেত্রে কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।  

পৌরাণিক কাহিনিতে আবার আরও আছে — বর্ষার আগমন ঘটেছে। কিন্তু বৃষ্টি তেমন হয়নি। চাষিদের মাথায় হাত। মাঠের ফসল মাঠেই মারা যাচ্ছে। মা অন্নপূর্ণার অস্তিত্ব সংকটে। সকল দেবতা মা অন্নপূর্ণার এহেন দুর্দশায় ব্যথিত। ঘরে ঘরে অন্নাভাবে হাহাকার ওঠে। সূর্যের তাপ হ্রাস করে বাঁচার জন্য মা অন্নপূর্ণা সূর্যদেবের ধ্যান করতে শুরু করেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়। সূর্যের প্রখর ছটায় মা অন্নপূর্ণা দিন দিন শ্রীভ্রষ্টা হয়ে ক্ষীয়মান হতে থাকেন। দেবলোকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেবতারা সম্মিলিতভাবে সূর্যদেবের কাছে গেলে তিনি মা অন্নপূর্ণার এই দশার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। এবং বলেন, মা অন্নপূর্ণা যেন গঙ্গাদেবীর আশ্রয় নেন। সূর্যদেব আরও বলেন, অস্তগমনকালে  কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে এবং সপ্তমীর উদয়কালে মা অন্নপূর্ণা গঙ্গাদেবীর আশ্রয়ে থেকে উদীয়মান ছটা বা রশ্মিকে দেখে আমার স্তব বা ১২টি নাম উচ্চারণ করলে আমার স্মরণকারী উদ্ধার পাবে।এরপর  সমস্ত পৃথিবী অন্নে পূর্ণ হতে থাকল। মা অন্নপূর্ণা আবার তাঁর শ্রী ফিরে পান। তাই ছট্‌ পূজা বা ব্রত একাধারে সূর্যদেব, মা অন্নপূর্ণা ও গঙ্গাদেবীর পূজা। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলা যায়, গঙ্গার জলে সেচ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে অনাবৃষ্টিতেও খেত-খামার অন্নে পূর্ণ হয় এবং স্বাভাবিকভাবে মনুষ্যসমাজে খাওয়া-পরার অভাব থাকে না। এই ব্রত পালনে সূর্যদেবের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আমাদের জীবনে যেমন বিঘ্ননাশক, দুঃখনাশক, তেমনি সুখদায়ক ও অর্থ-বৈভবদায়ক।
সেই পৌরাণিক কাল থেকে
মহাভারতে পঞ্চ পাণ্ডব এবং দ্রৌপদী পালন করেছিলেন এই উৎসব। রামায়ণেও আছে রাম সীতার ছট পুজোর কথা। অর্ঘ্য অর্পণ করে কৃতজ্ঞতা জানানো হয় সূর্যদেব এবং তাঁর দুই স্ত্রী ঊষা আর প্রত্যুষাকে। দীপাবলি বা দিওয়ালির চারদিন পর শুরু হয় মূল ছট পুজোর প্রাক পার্বণ। যাঁরা ব্রত রাখেন তাঁরা এদিন নদীতে অবগাহন(মূলত ভারতের গঙ্গা এবং নেপালের কোশী)করেন। তারপর শুদ্ধ ঘিয়ে রান্না করেন খিচুড়ি আর কুমড়ো , সেটাই এদিনের খাবার।

এর পরের দিন খেতে হয় ক্ষীর আর চাপাটি। 

সারাদিন উপবাসের পরে রাতে খেতে হয় সেটি ।
এ বার শুরু দীর্ঘ উপবাস। তৃতীয় দিন অর্থাৎ দীপাবলীর পর থেকে ষষ্ঠ দিন হল উৎসবের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। ছট ব্রতীরা উপবাসে থেকে নদীতে দাঁড়িয়ে সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে ফল এবং অন্যান্য অর্ঘ্য উৎসর্গ করেন। প্রণাম করা হয়  অস্তগামী আর উদীয়মান সূর্য ও তাঁর স্ত্রী ঊষা আর প্রত্যুষাকে। চতুর্থ দিন একইভাবে অর্ঘ্য উৎসর্গ করার পরেই ব্রতীরা ভঙ্গ করেন উপবাস। 

ভক্তদের বিশ্বাস‚ ছটপুজোয় সব মনোকামনা পূর্ণ করেন সূর্যদেব। সংসারের মঙ্গলকামনায় গৃহিণীরাই এই পুজো করে থাকেন। কলা-সহ বিভিন্ন ফল‚ ঠেকুয়া‚ ক্ষীর আর মিষ্টি হল পুজোর প্রসাদ।

 ১) ছট পুজার প্রথম দিন----

এই পুজার প্রথম দিনটি 'নহে-খায়' নামে পরিচিত। এই দিনে যারা ছট পুজার ব্রত রাখতে চান তারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে ভগবান সূর্যের পুজা করে তারপরই খাবার খান।

 ২) ছট পুজার দ্বিতীয় দিন-------

পুজার দ্বিতীয় দিনটি 'খরনা' নামে পরিচিত। এই দিনে, ভক্তরা সারা দিন উপবাস করে এবং সন্ধ্যায়, গুড় এবং রুটি দিয়ে চালের ক্ষীর তৈরি করে দেবতাদের নিবেদন করে। যারা ছট ব্রত পালন করবেন তারা ছট পূজা খর্নার প্রসাদ খাবেন এবং পরবর্তী দুই দিন উপবাস রাখবেন।

৩) ছট পুজার ৩য় দিন-----

ছট পুজার তৃতীয় দিনটি 'সন্ধ্যা অর্ঘ্য' নামে পরিচিত। এই দিনে, ভক্তরা নদী, পুকুর এবং অন্যান্য জলাশয় জড়ো করে সন্ধ্যা অর্ঘ্য - সন্ধ্যার নৈবেদ্য - ভগবান সূর্য এবং তাঁর স্ত্রী ঊষাকে। 

৪) ছট পুজার চতুর্থ দিন---

ছট পুজার চতুর্থ দিন 'ঊষা অর্ঘ্য' দিন নামে পরিচিত। এই দিনে, ভক্তরা আশেপাশের নদী, পুকুর এবং অন্যান্য জলাশয়গুলিতে ঊষা অর্ঘ্য - প্রভাত নৈবেদ্য - ভগবান সূর্য এবং তাঁর স্ত্রী ঊষাকে দিতে যান। ঊষা অর্ঘ্যে ছট পুজার উৎসব শেষ হয়। যারা ছট পুজার উপবাস রাখেন তারা ছট পুজার প্রসাদ খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন।
সব পুজা উৎসবই সংসারের মঙ্গল কামনায় ও শ্রীবৃদ্ধির জন্যই করা হয়ে থাকে।

Post a Comment

0 Comments