কমলিকা ভট্টাচার্য
বহুদিন ধরে নিজের ফাঁকা ফ্ল্যাটে একলা থাকেন অরুণেশবাবু। অবসর জীবনের অলস সময় যেন ক্রমাগত তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলছে। স্ত্রী চলে গেছেন বহু আগে, সন্তান বিদেশে। এই শহরের একপ্রান্তে, তার একমাত্র সঙ্গী বলতে ঘরের চার দেয়াল, একটা পুরনো ঘড়ি, আর টেবিলের ওপর রাখা একটা মোবাইল ফোন।
আজ সকাল থেকে ফ্ল্যাটটা যেন আরও বেশি ফাঁকা লাগছে। ঘরের কোণায় যে দুটো টিকটিকি বাসা বেঁধে ছিল, তারাও আজ নেই। হয়তো পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে, সেখানেই গিয়ে আড়ি পাতছে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। জানলা-দরজা এঁটে রাখায় মশারাও আজ আর বিরক্ত করছে না। কিন্তু বারান্দায় দাঁড়ানোর সাহসও হয় না তার। হেমন্তের হাওয়া এখন তাকে আরও কাবু করে ফেলবে। হাড়গুলো যে আজকাল বড় ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে। একটু ঠান্ডা লাগলেই গলা, বুক—সব যেন একসঙ্গে হরতাল ডাকে।
বই পড়া একসময় তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল। এখন বইয়ের পাতায় চোখ রাখলে মাথা ভার হয়ে আসে, আর কিছুক্ষণ পরেই চোখ জল নিয়ে নালিশ জানায়। টিভি খুলে খবর দেখতে ইচ্ছে করে না। একইসঙ্গে বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন আর বিরূপ সংবাদ। ঘরে নিঃসঙ্গতার সঙ্গী শুধু দেয়ালঘড়ির টিকটিক আওয়াজ, লিফটের শব্দ, আর পাশের বাড়ির কলিংবেলের টুংটাং।
অরুণেশবাবু ফোনের দিকে তাকান। ফোনটাও যেন আজকাল চুপচাপ। অনেকদিন হলো কেউ ফোন করেনি। তিনি নিজেও খুব একটা কাউকে করেন না। কার সঙ্গে কথা বলবেন? ফোনে কথা বলার মতো মানুষ কই? কিন্তু হঠাৎই একটা মুখ ভেসে ওঠে তার মনে—তৃষা।
তৃষা পাশের বাড়ির মেয়েটি। সদ্য চাকরি পেয়েছে। একা থাকে। কিছুদিন হলো, তার সঙ্গে এক আধবার কথোপকথন হয়েছে। সাদামাটা আলাপ—“আপনার শরীর কেমন?” কিংবা “আজ মেঘলা দিন, ছাতা নিয়ে বেরিয়েছেন তো?” অরুণেশবাবু ভাবেন, তাকে একটা মেসেজ পাঠাবেন? দুটো সাদামাটা কথা—“কেমন আছো?”
ভাবতে ভাবতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন চেয়ারে। সকালে সূর্যের আলো পর্দা ফাঁক করে পায়ে এসে পড়ে। ঘুম ভাঙতেই দেখেন ফোনটা মাটিতে পড়ে আছে। তুলে দেখেন, তৃষার মেসেজ—“রাতে ঘুম হয়েছে?”
অরুণেশবাবুর মনে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। বারান্দায় এসে দাঁড়ান। সকালের সূর্যটা তার হাড়ে শক্তি যোগাবে না, সেটা তিনি জানেন। কিন্তু তার হালকা উষ্ণতা মনটাকে ভরিয়ে দেয়। তিনি ভাবেন, তৃষা কি এখন স্নান সেরে খোলা চুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছে? কেন তিনি এসব ভাবছেন? নিজেরই নিজের ওপর রাগ হয়।
🍂
কিন্তু তৃষা যেন এক নতুন জীবন নিয়ে এসেছে তার জীবনে। একটা ফোনের মেসেজের অপেক্ষা, দু-চারটে সাধারণ কথার লেনদেন—এগুলোই এখন তার দিন কাটানোর কারণ হয়ে উঠেছে।
কয়েকদিন পর, তৃষা তার ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয়। হাতে কেক আর কফির মগ। “আপনাকে এত একা থাকতে দেখি, তাই ভাবলাম, একটু গল্প করি,” বলে সে হাসে। সেই হাসিটা যেন অরুণেশবাবুর মনের সমস্ত আঁধার মুছে দেয়।
তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তৃষা মাঝে মাঝে আসে। কখনো কফি বানায়, কখনো রান্নার নতুন রেসিপি নিয়ে, কখনোবা তার অফিসের কাজের ব্যাপারে আলোচনা করে। অরুণেশবাবুও তার পুরনো জীবনের গল্প শোনান—তাদের প্রেম, বিয়ে, সংসার, সন্তান। তৃষা মন দিয়ে শোনে।
একদিন, তৃষা হেসে বলে, “তোমার মতো বন্ধু আমার আগে কখনো হয়নি।” অরুণেশবাবু চমকে যান। এতদিন পর, কেউ তাকে “তুমি” বলেছে।
তৃষার হাসিটা যেন তার একাকিত্বের ওপর ঝরে পড়া সকালের রোদ। তিনি জানেন, তৃষা তার জীবনে একটি অল্প সময়ের অতিথি ,কিছুদিনেই তৃষার নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে কিন্তু এই ছোট্ট সম্পর্কটাই তার একঘেয়ে দিনগুলোতে এক রঙিন গল্প হয়ে রয়ে যাবে।
এটা কি ভালোবাসা? নাকি নিছক বন্ধুত্ব? সেটা বোঝার প্রয়োজন নেই। দুজন মানুষ, দুটো ভিন্ন প্রজন্ম, অথচ এক আশ্চর্য সাদামাটা কথায় বাঁধা পড়েছে।
0 Comments