বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৪৪
মূলা
ভাস্করব্রত পতি
সালটা ১৮০৬। সে বছর জনৈক মূলাচোরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তাঁর কৃতকর্মের জন্য। সেই থেকে খুব ছোট কাজের জন্য বড় সাজা দেওয়া হলে বা লঘু পাপে গুরু দণ্ডদান দেওয়া হলে আমরা বলে থাকি 'মূলাচোরের ফাঁসি' কথাটি। বাংলা প্রবাদে আমরা প্রায়শঃই মূলার অনুষঙ্গ এনে বলে থাকি -- উঠন্ত মূলা পত্তনেই চেনা যায়। আসলে যেটা করতে চাওয়া হয়, সেটা না হয়ে অন্য কিছু হলে তখন কথার মাঝে বলা হয়ে থাকে -- তুলা করতে মূলা হল, শেষে হল কাপাস। অল্প কাজ করে বেশি বেশি করে ফলাও করে বলার স্বভাব যাঁদের, তাঁদের জন্য বলা হয় - মূলা খেলে মূলার ঢেঁকুর ওঠে। এছাড়াও প্রবাদে আছে -- 'মূলার চেয়ে ধেড়ে (ডোগা) মোটা', 'মূলা তোলা, না বেগুন তোলা', 'রাঙা মুলা'। আবার আমরা বলে থাকি -- 'খালি পেটে খাবে কুল, ভরা পেটে খাবে মূল। আসলে দুটোই ক্ষতিকর এভাবে খেলে। লম্বা মূলা
মূলতঃ সাদা রঙের হয় মূলা। তবে লালচে গোলাপী, কালো, রক্তবর্ণ, হলুদ এবং সবুজ রঙের মূলাও পাওয়া যায়। জমিতে ভালোভাবে সূর্যের আলো পড়লে মূলার ফলন ভালো হয়। মূলা হল ডিপ্লয়েড প্রজাতির উদ্ভিদ এবং এর ১৮ জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে (২n = ১৮)। কবি ঈশ্বর গুপ্ত মূলার বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, --
'গোড়া সরু আগা গুরু শিরে শোভে টোপ।
শ্বেতকান্তি শঙ্খাকার ভিন্ন ভিন্ন ঝোপ।।
মূলে তার মূল নাই নাম ধরে মূলো।
রোগা পেটে খেতে হলে যেতে হয় চুলো।।
একদিন বাবাজীরে করিলে আহার।
ছমাস নির্গত হয় সমান উদ্দ্গার।।
খোট্টাদের কাছে তার সমাদর বাড়ে।
ঝাড়শুদ্ধ পেটে দেয় কিছু নাহি ছাড়ে।।
দুইমাস সাহেবেরা, সুখে পেট পালে।
নিয়ত হাজির করে হাজিরের কালে।।
কচুরির সহ প্রেম খোট্টার দোকানে।।
গোষ্ঠীপোষা ব্যঞ্জনেতে বড় মান বাড়ে।
জলপানে সমাদর সকলের স্থানে।
বাবাজীরে বেগুণের সঙ্গে সঙ্গে ছাড়ে।।
কচি মূলা রুচিকর ত্রিদোষনাশক।
পাকিলে বিনাশে বায়ু পিত্তের জনক।।
শোথ বাত শ্লেষ্মা নাশে শুকাইলে পরে।
অথচ শীতল গুণ আপনি সে ধরে।।
মূলাতে হিঙের গুণ আছে অবিকল।
কাঁচা খেয়ে নেচে উঠে সবল সকল।।
মূলক মূলক বটে, অমূলক নয়।
ব্যাভারে পেয়েছি তার মূল পরিচয়।।
মূলে কোন দোষ নাই, ভাল বটে মূল।
মূলে যে নিপাত করে তারে দেয় মূল।।
মূলকের কাছে কিছু অমূলক নাই।
মূলার হাট
মূলার বিজ্ঞানসম্মত নাম Raphanus raphanistrum subsp. sativus। এটি ব্রাসিকেসি পরিবারের অন্তর্গত। মূলাকে সংস্কৃতে 'মূলক', হিন্দিতে 'মূলী' আর ইংরেজিতে Raddish বলে। এটির বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় কাঁচা সব্জি। এরাজ্যের মানুষের সবজির তালিকায় মূলার স্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বরোদা ইত্যাদি রাজ্যে উৎপাদিত হয়।
সারা পৃথিবীতেই মূলার চাষ হয়। রোমানদের আগে ইউরোপীয়দের কাছে প্রিয় সবজি ছিল। তবে লাল মূলার আদি জন্মভূমি ব্রিটেন বলে অভিমত কারও কারও। বর্তমানে মূলার উন্নত বৈশিষ্ট্য যুক্ত প্রজাতির সৃষ্টিতে জাপান অনেক এগিয়ে। জাপানের সাকুরাজিমা মূলা সবদিক থেকে এগিয়ে। 'এপ্রিল ক্রস' হল একটি বড় আকারের জাতের সাদা হাইব্রিড মূলা যা একটু ধীরে বড় হয়। এছাড়াও মেলে এস্টার এগ, চেরি বেলি, স্নো বেলি, বানি টেইল, রেড কিং, মাসাটো রেড, মাসাটো গ্রীন, ব্ল্যাক স্প্যানিশ, মিউ, দামুজি, দাইকন, জোসিয়ান, চ্যাম্পিয়ন, রোড বল, হোয়াইট আইকেল, পাম পারপেল, ফ্রেন্স ব্রেকফাস্ট, সেনসিলি জায়ান্ট, গালা ইত্যাদি হল বিশ্বের বিখ্যাত মূলার প্রজাতির নাম। মুনসেন বিয়ার নামক মূলার এক প্রজাতির বীজ থেকে একসময় একজাতীয় মদ তৈরি হত জার্মানিতে। তবে এখানে যেসব উন্নত প্রজাতির মূলা চাষ হয়, সেগুলি হল পুসা দেশি, পুসা রেশমী, পুসা চেতকী, পুসা হিমানী, হিকারী, মিনো, আর্লি লং হোয়াইট, জাপানিজ হোয়াইট, কল্যাণী সাদা, কন্টাই লাল, কালিম্পং লাল, রেড বোম্বাই, নবীন, সুজাতা, স্কারলেট গ্লোব ইত্যাদি। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় লিখেছেন --
'মজিবে কমল কুল,
সাজাবে মূলার ফুল,
মূলা ও মূলা শাক
লম্বা এবং শঙ্কু আকৃতির দেখতে আলোচিত মূলা। মূলার ভেতরের অংশ সাদা। মাটির তলায় জন্মায়। মূলা চাষের জন্য কিরকম মাটি দরকার, তা মেলে এই গ্রাম্য ছড়ায় --
'মূলা ভুঁই তুলা
কুশরের ভুঁই ধুলা'।
অর্থাৎ মূলাচাষের জন্য মাটি তুলোর মতো নরম করতে হয়। আর 'কুশর' অর্থে ইক্ষু বা আঁখচাষের জন্য মাটি ধুলোর মতো করতে হয়। নেপালী ভাষায় শোনা যায় -- 'ধুলাকো তোরি হিলাকো মূলা' অর্থাৎ সরিষার মাটি ধুলা এবং ঢিলা মাটিতে মূলা। আর শীতকালীন এই সবজিটি চাষ করতে হয় শরৎকাল শেষ হলে। তা নিয়ে খনার বচনে পাই --
'বলে খনা শুন শুন
শরতের শেষে মূলা বুন'।
মূলাচাষের নিয়মকানুন সম্পর্কে চাষিদের মধ্যে কিছু রীতি নীতি কথিত রয়েছে। যা প্রচলিত আদ্যিকাল থেকে। কথায় বলে --
'ষোলো চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা
তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান'!
অর্থাৎ মূলার জমিতে ষোলো, তুলার জমিতে তার অর্ধেক তথা আটবার, ধানের জমিতে তারও অর্ধেক তথা চারবার এবং পান লাগানোর জন্য কোনও চাষের দরকার নেই।
এটিই ওড়িয়া ভাষায় বলে --
'ষাঢ়ে ওড় মূলা, তেকের অধ গুড়া
তেকের অধ ধান, তেবেসে চাষা খায়ে পান'।
আসামে অবশ্য তুলা এবং মূলার চাষের সংখ্যার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। অসমীয়া ভাষায় এই ছড়াটি উচ্চারিত হয় এভাবে --
'ষোল চাহে তুলা, তার অর্ধেক মূলা
তার অর্ধেক ধান, বিনা চাহে পান'।
অথর্ববেদের বৈদ্যককল্পে মূলাকে বলা হয়েছে 'মূলকং'। কিন্তু বেদে আছে 'মলকং' --
'ঊর্জো নর্পাৎ সুশস্তিভিঃ মলকং মন্দস্ব ধীতিভিহিতম।
ত্বে ইষঃ সন্দধূভূমিং মাতরা বিচরণ ভানুনা অনুন বর্চা'। (অথর্ববেদ, বৈদাককল্প ৫।৩৯২।৬২)
এই 'মলকং'ই পরে 'মূলকং' বা 'মূলা' নামে খ্যাত হ'য়েছে। চরকের লেখায় পাই --
'বালং দোষহরং বৃদ্ধং ত্রিদোষং।
স্নিগ্ধসিন্ডং, মারুতাপহম্।
বিশুষ্কং তু মূলকং কফবাতজিৎ'।
অর্থাৎ কচি মূলা ত্রিদোষ নাশক, পাকা মূলা তার বিপরীত (মাঘেই সেটা পাকতে সুরু হয়); স্নেহযুক্ত সিদ্ধ মূলা বায়ুনাশক। আর (শুক) শুনো মূলা বাত শ্লেষ্মা দূর করে। মূলা ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে পরিগণিত আছে বৈদ্যকারদের কাছে। হিক্কা, আমাশয়, শোথ, অল্প অল্প প্রস্রাব, ঋতুস্রাবের সময় পেটের যন্ত্রনার নিরাময়ে, প্রস্রাব থলিতে পাথরি নির্গমনে, বাতজ্বরে, ছালিতে মূলা খুব উপকারী।
বড় সাইজের মূলা
'কুমড়োপটাশ' কবিতাতে নতুন এক মূলার আমদানি করেছেন কবি সুকুমার রায়। এখানে পাই --
'(যদি) কুম্ড়োপটাশ নাচে --
খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে;
চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে;
চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে'!
হট্টমূলার দেশ আছে কি নেইতা বুঝে নেবে কুমড়োপটাশ। কিন্তু অতি সাধারণ মূলা যখন কোনো বেআক্কেলে গাধাকে সপ্রতিভ করে তোলে, তখন তো মূলার গুণগান গাইতেই হয়। কবি সুকুমার রায় তাঁর আরেকটি কবিতা 'অসম্ভব নয়'তে মূলা দিয়ে এক সাহেবের যুগান্তকারী কীর্তির কাহিনি লিখেছেন সরস ভঙ্গিমায় --
'এক যে ছিল সাহেব, তাহার
গুণের মধ্যে নাকের বাহার।
তার যে গাধা বাহন, সেটা
যেমন পেটুক তেমনি ঢ্যাঁটা।
ডাইনে বললে যায় সে বামে
তিন পা যেতে দুবার থামে।
চল্তে চল্তে থেকে থেকে
খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে।
ব্যাপার দেখে এম্নিতরো
সাহেব বললে, “সবুর করো-
মামদোবাজি আমার কাছে?
এ রোগেরও ওষুধ আছে।
”এই না ব’লে ভীষণ ক্ষেপে
গাধার পিঠে বস্ল চেপে
মুলোর ঝুঁটি ঝুলিয়ে নাকে।
আর কি গাধা ঝিমিয়ে থাকে?
মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে
দৌড়ে চলে লম্ফ দিয়ে-
যতই চলে ধরব ব’লে
ততই মুলো এগিয়ে চলে!
খাবার লোভে উদাস প্রাণে
কেবল ছোটে মুলোর টানে-
ডাইনে বাঁয়ে মুলোর তালে
ফেরেন গাধা নাকের চালে'।
🍂
0 Comments