জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৮ /বিজন সাহা

ইভাঙ্কভস্কি বাধ

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৮ 

বিজন সাহা 

মস্কো সাগর 


ইভানকোভস্কোয়ে রিজারভয়ার যা লোকমুখে মস্কো সাগর বলে পরিচিত উজানের দিক থেকে আপার ভোলগা রিজারভয়েরের পর ভোলগার উপর দ্বিতীয় রিজারভয়ার। এই রিজারভয়ার আপার ভোলগার দক্ষিণ প্রান্তের নিম্নভূমিতে অবস্থিত। এর উৎপত্তি হয়েছে ইভানকভস্কি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধের কারণে। এই বাঁধের সাহায্যে ভোলগার জল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়াও এই বাঁধ মস্কো কানালের মুখ। এই রিজারভয়ার তার নাম পায় ইভানকভস্কি জনপদের নামানুসারে যা ১৯৬০ সালে দুবনার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই রিজারভয়ার মস্কো সাগর এবং ভোলঝস্কোয়ে রিজারভয়ার নামেও পরিচিত। এই জলাশয়ের আয়তন ৩১৬ বর্গ কিলোমিটার। প্রতি বছর এখান থেকে এক বিলিয়ন কিউবিক মিটার জল তোলা যায়। মস্কো সাগর মস্কো রেজিয়নের বৃহত্তম জলাশয় আর তভের অঞ্চলের তৃতীয় – রীবিনস্ক ও উগলিচের পরে। ১৯৩৭ সালে ইভানকভা জনপদে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৩০০ মিটার লম্বা ও ২২.৫ মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হলে এই জলাশয় সৃষ্টি হয়। জলের সীমা নিয়ন্ত্রের জন্য এই বাঁধে রয়েছে আটটি ২০ মিটার চওড়া গেট। এই জলাশয় তৈরির ফলে ৩২.৭ হাজার হেক্টর ভূমি জলের নীচে চলে যায়। জলমগ্ন হয় ৭.৪ হাজার হেক্টর বন, ১৪.৮ হাজার হেক্টর আবাদী ভূমি, ৪.৮ হেক্টর বাসযোগ্য ভূমি। এর ফলে এক সময়ের সমৃদ্ধ জনপদ করচেভা আর কানাকোভার একটি অংশও চিরতরে হারিয়ে যায় জলের নীচে। এই সময়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ স্থানান্তরিত হয়। সাথে যায় বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা, গৃহপালিত পশু ইত্যাদি। জলাশয়ের পূর্ণ আয়তন ১১২০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার, উপকারী আয়তন ৮৮৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। জলাশয়ের দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার, প্রস্থ ৪ কিলোমিটার (সর্বোচ্চ ১২ কিলোমিটার), এর উপকূলরেখার দৈর্ঘ্য ৫২০ কিলোমিটার। গড় গভীরতা ৪ মিটার, সর্বোচ্চ গভীরতা ১৯ মিটার। মস্কো সাগর মস্কো রেজিয়ন, তভের, স্মলেনস্ক ও নভগোরাদের ৪১ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা থেকে জল সংগ্রহ করে।   

সর্প দ্বীপ

যদিও মস্কো সাগরের সাথে আমার পরিচয় ছাত্র জীবনে তবে সেই সময়ের কথা কিছুই মনে নেই। এর আগে কোন এক পর্বে ইয়ারোস্লাভল থেকে নদীপথে মস্কো ভ্রমণের কথা উল্লেখ করি। চাই বা না চাই সেই যাত্রা হয়েছিল দুবনা হয়ে। আর আমরা যখন তভের যাই তখন এই মস্কো সাগরের উপর দিয়েই যেতে হয়েছিল। সেই সময়ের অনেক কথা, বিশেষ করে উগলিচ আর তভেরের কথা খুব ভালো ভাবে মনে থাকলেও না দুবনা, না মস্কো সাগর – এসবের কথা কিছুই মনে নেই। তাই সে অর্থে মস্কো সাগরের সাথে আমার পরিচয় দুবনায় আসার পরে। ওদিকে মাঝে মধ্যে যেতাম ঘুরতে, ছবি তুলতে। ২০০০ সালের দিকে আমার এক পরিচিত ভ্যালেরি জামিরালভ ইটালি থেকে ইয়ট নিয়ে মস্কো যাবার পথে আমাদের মস্কো সাগরে ঘুরায়। সে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এর পরে আমরা ফটো ক্লাবের বন্ধুরা মিলে নৌকা করে মস্কো সাগরে ঘুরে বেড়াই ছবি তোলার জন্য। সেটা ২০১১ সালের কথা। আলেগ আর মাশা ছিল সহযাত্রী। তখন আমরা সবাই ফোকাসের মানে আমাদের ফটো ক্লাবের সদস্য। আলেগ অনেক দিন হয় মস্কো চলে গেছে। মাশা নিজের মত করে ছবি করে, ক্লাবে আসে না। এই গল্প লিখতে গিয়ে ২০১১ সালের ২৭ জুলাই মস্কো সাগরে আমাদের ভ্রমণের ছবিগুলো আবার দেখলাম। সেদিন প্রায় ৭০০ মত ছবি তুলেছিলাম, এডিট করেছিলাম গোটা ২৫। এখন মনে হল ছবিগুলো এডিট করা দরকার যাতে আপনারাও মস্কো সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। কারণ মস্কো সাগর শুধু জলরাশি নয়, দ্বীপ, গাছপালা, ফুল, পাখী আরও কত কী! এ এক অন্য জীবন। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির মাঝে। সেই সময় পরিচিত হই মস্কো সাগরের বিভিন্ন দ্বীপের সাথে। সর্প দ্বীপ আমাকে সব সময়ই সাপের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুবনা থেকে এটা প্রথম দ্বীপ। শুনেছি ওখানে সাপের আনাগোনা আছে বলেই এই নাম। এ ছাড়াও আছে দ্বীপ এ, দ্বীপ বি। আছে লিপনিয়া যেখানে আমাদের ইনস্টিটিউটের তরুণ বিজ্ঞানীদের কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। এসব জায়গায় হোটেল আছে সামারে থাকার জন্য। তবে যাওয়া হয়নি কখনও। এমনকি এক সময় এসব দ্বীপে গিয়ে কয়েক দিন থাকার জন্য ছয় জনের একটি টেন্ট পর্যন্ত কিনেছিলাম আমরা দুজন আর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে যাব বলে। এখন সবাই বড় হয়ে যে যার মত থাকে, তাই ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে কি না সেটা বিশাল প্রশ্ন সাপেক্ষ। 

🍂

এই জলাশয় তিনটি বৃহৎ অঞ্চলে বিভক্ত – ভোলঝস্কি, শোশিনস্কি ও ইভানকভস্কি। ১৯৬৭ – ১৯৭২ সালের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী এখানে ৬১১ ধরণের শৈবাল রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ফাইটোপ্লাঙ্কটন রয়েছে শোশিনস্কি এলাকায় আর এর পরিমাণ ইভানকভস্কি অঞ্চলে ভোলঝস্কি অঞ্চলের চেয়ে দ্বিগুন বেশি। মস্কো সাগরে ৩৮ ধরণের মাছ দেখা যায় যার মধ্যে ২২ টি কার্প জাতীয় ও ৪ টি পার্চ জাতীয়। বিভিন্ন সময়ে দুবনার খোলা বাজারে মস্কো সাগরের মাছ পাওয়া যায়। এসব বিক্রি করে মূলত শৌখিন জেলেরা। আমি সুযোগ পেলেই এসব কিনি। মাঝে মধ্যে বোয়াল জাতীয় মাছের দেখাও মেলে। তবে আমি সাধারণত লেশ নামক সরপুঁটি জাতীয় এক ধরণের মাছ পছন্দ করি। এখানে স্থানীয় মাছ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কার্প, হোয়াইট কার্প, সিলভার কার্প ইত্যাদির চাষ করা হয়েছিল। স্থানীয় প্রজাতির মধ্যে লেশ বা ব্রীম সংখ্যা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এরপর প্লতভা বা রোচ, ওকুন বা পার্চ, শুকা বা পাইক এবং সর্বশেষে সুদাক বা পাইক পার্চ উল্লেখযোগ্য। 

দমকিনো উপসাগর

মস্কো সাগরের মূল কাজ হচ্ছে মস্কোয় অবিরাম জল সরবরাহ করা। ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মস্কো কানালের মাধ্যমে বছরে ১,৭ কিউবিক কিলোমিটার জল সরবরাহ করা হয়। এক সময় মস্কো সাগর ছিল মস্কোয় জল সরবরাহের একমাত্র উৎস। এখন অবশ্য ওকা থেকেও মস্কো জল সংগ্রহ করে। সে কারণে যুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী বার বার চেষ্টা করেছে দুবনার বাঁধ উড়িয়ে দেবার জন্য। সেটা করতে পারলে মস্কোয় জলের অভাব দেখা দিত। তবে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মস্কো সাগরের ভূমিকা খুবই নগণ্য। বার্ষিক উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ ১১৯ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার। এছাড়াও মস্কো সাগর গভীর জলপথ হিসেবে কাজ করে। এই পথে দুবনা থেকে তভের পর্যন্ত জাহাজ চলাচল করে। এছাড়াও এখান থেকে প্রতি বছর ১ মিলিয়ন কিউবিক মিটার বালু উত্তোলন করা হয়। প্রতি বছর এখানে প্রায় ২৫ লাখ লোক বেড়াতে আসে। এদের অনেকেই সাগর তীরে ও বিভিন্ন দ্বীপে অবস্থিত অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্রে অবসর যাপন করে। মস্কো সাগরের উপকূলে দুবনা, কানাকোভা, নভোজাভিদভস্কি, কাজলোভা, রাদচেঙ্কো ইত্যাদি শহর ও জনপদ অবস্থিত। যুদ্ধের সময় মস্কো সাগর সোভিয়েত সেনাবাহিনীকে জার্মান বাহিনীর মস্কো অভিমুখে যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে সাহায্য করে। যুদ্ধের সময় শীতে যখন সাগর জমে গেছিল তখন জল ছাড়া হয়, ফলে জলের উচ্চতা দুই মিটার কমে যায়। সে সময় জার্মান ট্যাঙ্ক বহর সাগর পাড়ি দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু জল ছাড়ার ফলে নীচে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। ফলে বেশ কিছু জার্মান ট্যাঙ্ক ডুবে যায়। জার্মান বাহিনী পরবর্তীতে এই পথে মস্কোর দিকে এগুনোর পরিকল্পনা বাদ দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এখনও মস্কো সাগর যখন বরফে ঢাকা পরে প্রচুর লোকজন এখানে যায় মাছ ধরতে। অনেকে গাড়ি নিয়ে যায় বরফের উপর দিয়ে। পুলিশের পাহারা, সতর্কবাণী ও নিষেধ সত্ত্বেও প্রতি বছরই একাধিক গাড়ি জলে ডুবে। কখনও কখনও মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। আমরা কখনও কখনও সামারে মস্কো সাগরে যাই সাঁতার কাটতে। কখনও সন্ধ্যা বেলায় সূর্যাস্তের ছবি তুলতে। মস্কো সাগর দুবনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও কানাকোভা যাবার সময় বা বিভিন্ন সময়ে জাহাজে করে মস্কো সাগরে ঘুরেছি, তবে সেই ২০১১ সালের নৌকা বেঁয়ে নিজেদের মস্কো সাগরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সেটা একেবারেই ভিন্ন রকম। এক দ্বীপে নেমে যখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল দেশের কথা যখন বন্ধুদের নিয়ে নৌকা করে যেতাম বনভোজনে। সেটা আমরা করতাম বর্ষা কালে, নিজেদের নৌকায়। সাধারণত সাথে থাকত মুরগীর মাংস আর নারকেল। এছাড়া মস্কো সাগরে নৌকা ভ্রমণের সময় বারবার মনে পড়ছিল ছোটবেলায় ঝিটকায় পিসি বাড়ি যাবার কথা। সেখানে আমরা যেতাম বর্ষায়, নৌকা করে। কালো জলের নীচ থেকে উঁকি দিত বিভিন্ন রকমের শৈবাল।     

ছবিতে মস্কো সাগর   

http://bijansaha.ru/album.php?tag=167

http://bijansaha.ru/album.php?tag=307

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments