জ্বলদর্চি

চিন্ময় দাশ (লোকগবেষক, মন্দির বিশারদ, প্রবন্ধকার, মেদিনীপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩৬
চিন্ময় দাশ (লোকগবেষক, মন্দির বিশারদ, প্রবন্ধকার, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

তখন ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের বুকে চলছে মুক্তিযুদ্ধের লড়াই। পাকিস্তানের হানাদারদের হাত থেকে বাঙালিদের রক্ষা করার তীব্র আন্দোলন এবং লড়াই। বাংলাদেশের বুকে তখন দারুণ যুদ্ধ চলছে। উত্তাল গোটা দেশ। আসলে পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতেই হবে। তখন এই কাহিনীর নায়ক পুরুলিয়ার লালমাটির এক বনাঞ্চলে কর্মরত। লাল রঙের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা। তাই তিনি লাল রক্তের প্রতি অমোঘ টান অনুভব করতে পেরেছিলেন সেসময়। ভাইয়ের রক্তে রাঙানো হাতের কাহিনী তিনি শুনেছিলেন পুরুলিয়ার বুকে দাঁড়িয়েও। মনের মধ্যেকার তেজ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বেগ মানেনি সেদিন। মৃত্যভয় তাঁকে টেনে ধরেনি অন্যদের মতো। বুক চিতিয়ে চলার পথ বেছে নিয়েছিলেন সেসময়। 
স্ত্রীর সাথে

তখন তিনি মাত্র চব্বিশ বছরের যুবক। টগবগ করছে রক্ত। চোখের কোনে মুক্তির আহ্বান। চাকরিরত অবস্থায় চললেন বনগাঁ সীমান্ত। ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত। তিনি যুদ্ধ করবেন। বাঙালিদের নাগপাশ থেকে মুক্ত করবেন। পাকিস্তানের সেনাদের হঠাবেন। বুকের মধ্যে জ্বলছে তীব্র আগুন। বাংলাদেশের বাঙালি ভাইদের জন্য তাঁর অন্তরাত্মা যে ডাক দিয়েছে, সে ডাক ফেরাতে চাননা তিনি। কোনও এক ভোরবেলায় সীমান্তে হাজির মেদিনীপুরের এক অন্যতম লোকগবেষক চিন্ময় দাশ। তখনও তিনি একজন প্রোথিতযশা মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবক্ষেত্র মেদিনীপুরের একজন বিপ্লবী চেতনার মানুষ। সেদিন কপর্দকশূন্য সেই যুবকের হাতে কমলেশ পট্টনায়ক তুলে দিলেন ১০০ টাকা। হাজির বনগাঁ সীমান্তে। সেখান থেকে গোপনে এবং অন্ধকারে ঝিকরগাছাতে চলে যান। সেই জায়গা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। সেই স্মৃতি আজও অমলিন। চারিদিকে গুলিগোলার শব্দ। যে হাতে অসি ধরতে গিয়েছিলেন সমরভূমিতে, সেই হাতে মসি ধরলেন অবশেষে। ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে ফিরে আসেন মেদিনীপুরে। শুরু করলেন নতুন জীবন। নতুন ভাবে পথচলা। 
কাজে মগ্ন চিন্ময় দাশ

১৯৪৭ এর ৩ রা এপ্রিল লোক গবেষক চিন্ময় দাশ জন্মগ্রহণ করেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার চণ্ডীপুরের গড়বেড়িয়া গ্রামে। বাবা রবিকান্ত দাশ এবং মা শান্তিলতা দাশের তিনিই বড় ছেলে। মোট ছয় ভাই এবং দুই বোন। পাকা রাস্তা থেকে ৯ কিমি দূরে পশ্চিম দিকে অজ পাড়া গাঁয়ে তাঁর বসবাস। তাঁর গ্রাম। নিজের গ্রামে কোনও প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলনা সেসময়। ফলে দেড় কিমি পথ পেরিয়ে পাশের গ্রামের স্কুলে যেতেন। ভগবানপুর হাইস্কুলে পড়েন পঞ্চম শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। বাড়ির কাছে চৌখালি জুনিয়র হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর ফের স্কুল বদল। এবার গোপীনাথপুর হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানে নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৬২ তে এখানে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর প্রি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে বেলদা কলেজ চলে যান। তখন এখানে অধ্যাপক ছিলেন ড. পিনাকীনন্দন দাস মহাপাত্র। এই গুণী মানুষটির সাথে সখ্যতা, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায় তখন থেকেই। তিনিই লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব এবং লৌকিক উপাদান সংগ্রহের বীজ পুঁতে দেন তাঁর মননের গভীরে। বেলদা কলেজ থেকে আর্টস নিয়ে পড়ার পর বাজকুল কলেজে ভর্তি হন। এখানে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তে পড়তে বাবা রবিকান্ত দাশ মারা যান। ব্যাস, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়ে। চা পান বিড়ি সিগারেট খাননি খরচ কমানোর জন্য। আসল লক্ষ্য ছিল ভাইয়েদের পড়াতে হবে। তাঁদের মানুষ করে তুলতে হবে। সংসারটাকে দাঁড় করাতে হবে। 
চিন্ময় দাশের লেখা একমাত্র বই -- মেদিনীপুরের দেউল সমগ্র (প্রথম খণ্ড)

১৯৬৫ সালে চাকরি পান পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে ভূমি রাজস্ব দপ্তরে। সেখানে ছিলেন আড়াই বছর। এরপর মহকুমা অফিসে তিন বছর চাকরি করেন। তখন ১৯৭১। যুদ্ধ করতে চলে গেলেন ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায়। ফিরে এলেন জন্মভূমিতে। শুরু করলেন নিজের মতো করে বেঁচে থাকার লড়াই। সৃষ্টিশীল ভাবনাকে জাগরিত করে এগিয়ে চললেন সুমুখপানে। মায়ের কাছ থেকে বই পড়ার অভ্যাস করেছিলেন। পরবর্তীতে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। আসলে পড়াশোনা তাঁর রক্তে ছিল। আজও কখনও খামতি রাখেননি নিয়মিত বই পড়ার ক্ষেত্রে। 
আপনজন সম্মাননা স্মারক ২০২৪

ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজে প্রথমবার ড. পিনাকীনন্দন দাস মহাপাত্রের সঙ্গে গিয়েছিলেন কাঁকড়াঝোড়। সেসময় জঙ্গলমহলের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা অজস্র লৌকিক উপাদান আহরণের পাঠগ্রহণ করেছিলেন তাঁর প্রিয় স্যারের হাত ধরে। সঙ্গে পেয়েছিলেন আর এক লোকগবেষক ঝর্ণা আচার্য্যকে। এই 'ত্রিফলা' পরবর্তীতে বাংলার লোকসংস্কৃতি নিয়ে অসংখ্য কাজ করেছেন। মেদিনীপুর জেলার পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঋদ্ধ করেছেন মেদিনীপুরের ইতিহাস, মেদিনীপুরের সংস্কৃতি, মেদিনীপুরের গৌরব। 

বামপন্থী ভাবাপন্ন চিন্ময় দাশ একসময় যুক্ত হন পশ্চিমবঙ্গ লেখক শিল্পী সংঘের সাথে। সংগঠনের জেলা নেতৃত্ব তাঁকে দায়িত্ব দেন 'শব্দের মিছিল' পত্রিকায় বিশেষ 'তেভাগা আন্দোলন' নিয়ে ক্রোড়পত্র তৈরি করে দেওয়ার। আর তিনি তো কাজপাগল মানুষ। কর্মঠ মানুষ। তেভাগা আন্দোলনের অসংখ্য অজানা কাহিনী তুলে আনেন নিবিড় ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে। এজন্য ঢুঁ মেরেছেন খেজুরি, নন্দীগ্রাম, কাঁথি, চণ্ডীপুর, সুতাহাটা এলাকায়। এরপর যে ক্রোড়পত্রটি তিনি প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন, তা মেদিনীপুরের তেভাগা আন্দোলনের দলিল হয়ে উঠেছে। 

জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকশিল্পের সন্ধানে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। বৈষ্ণবচকের বিষানশিল্প, চৈতন্যপুর, নয়া, মুরাদপুরের পটশিল্প, সারতার মাদুরশিল্প, ঢাঁইকুসুমের পাথরশিল্প, শিমূলপালের হাঁসাপাথর, কেশপুরের আমলপুরের নকশিকাঁথা শিল্প, পটাশপুরের গালাশিল্প সহ ডোকরাশিল্প, মুখোশশিল্প, শোলাশিল্প, শঙ্খশিল্প ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেছেন নিবিড়ভাবে। তুলে এনেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। উল্লেখ করেছেন শিল্পীদের নিদারুণ যন্ত্রনার কথা। শিল্পীদের জোটবদ্ধ করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন দিনের পর দিন। শুধু লোকশিল্প নয়, মেদিনীপুরের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং জড়িয়ে থাকা লোকসাংস্কৃতিক উপাদান সংগ্রহের মাধ্যমে জেলাবাসীর গৌরব বৃদ্ধির কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে নিভৃতে। মেদিনীপুরের লোক উৎসব, জনজাতি, ভাষা বৈচিত্র্য, জনবসতি, জনসংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, চালচলন, পথপরিচয়, লোকসঙ্গীত, লোক পালাগান, লোকক্রীড়া ইত্যাদি নিয়ে কলম ধরেছেন একজন পূর্ণাঙ্গ ক্ষেত্রসমীক্ষক হিসেবে। আদ্যন্ত হাসিখুশি স্বভাবের রসিক এই মানুষটি সত্যিকারের কাজপাগল গবেষক। আপোষহীন লড়াইয়ের প্রতিভূ। 

'উপত্যকা' পত্রিকার সম্পাদক তাপস মাইতির সম্পাদনায় প্রকাশিত 'মেদিনীপুরের গ্রামের কথা' বইতে তিনিই ছিলেন মূল লেখক। এই বইয়ের প্রথম ৮ টি খণ্ডে মেদিনীপুরের বিখ্যাত ৮০ টি গ্রামের সর্বাঙ্গীণ বিবরণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। যা এই গ্রামগুলির সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে পারবে গবেষকদের। এছাড়াও 'শহর মেদিনীপুরের কথা' শীর্ষক বইতেও তিনি ছিলেন অন্যতম লেখক। মোট চারটি প্রবন্ধ তুলে ধরেন তাঁর লেখায়। মেদিনীপুর শহরের মধ্যে অলিগলিতে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য অজানা স্থাপত্য, ইতিহাস ফুটে উঠেছে তাঁর বর্ণনায়। যা আগে কেউ কখনও জানাতে পারেনি। আসলে তিনি যখন কাজ করেন, তখন তাঁর কাজের মধ্যে থাকে গভীর নিষ্ঠা এবং আপোষহীন পরিশ্রম। অজানাকে জানার ঈপ্সা থাকে তাঁর পথচলায়। প্রতিটি বিষয়ের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন এবং সেঁচে আনেন অজস্র মনিমুক্তো। 'মেদিনীপুরের ধর্মচর্চা' বইতেও তিনি তাঁর লেখনীর কৃতিত্বের ধারা বজায় রেখেছেন। একজন যথার্থ মেদিনীপুরপ্রেমী লেখক হিসেবে চিন্ময় দাশ হয়ে উঠেছেন অনন্য এবং অসাধারণ। 
নিজের লাইব্রেরিতে

২০১৪ এর নভেম্বর মাস থেকে নিশীথ দাস সম্পাদিত 'বিপ্লবী সব্যসাচী' পত্রিকায় প্রথম লেখেন গোপীবল্লভপুর এলাকার চিত্রেশ্বর মন্দিরের বিবরণ। সেই শুরু। একসময় তারাপদ সাঁতরা এবং ড. প্রণব রায় মেদিনীপুরের মন্দির নিয়ে কাজ করেছিলেন। এরপর চিন্ময় দাশ যেভাবে জেলা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য জানা অজানা মন্দির এবং সেগুলির বিবরণ তুলে ধরছেন ধারাবাহিকভাবে, তা অমূল্য রতন হয়ে উঠছে গবেষকদের কাছে। প্রতিটি কাজ জানান দেয়, কি অসাধারণ ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং মন্দির সম্পর্কে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি তিনি ঢেলে দিয়েছেন প্রতিটি গবেষণায়। ক্রমশঃ তিনি হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের অন্যতম মন্দির গবেষক। এ পর্যন্ত ৬৯০ টি মন্দির দেখে সমীক্ষা করে ফেলেছেন মেদিনীপুরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে ফিরে। শারীরিক অসুবিধাকে দূরে সরিয়ে এখনও গলায় ক্যামেরা এবং নোটবই ও কলম নিয়ে দিনের পর দিন কাজ করছেন অক্লেশে এবং অক্লান্তভাবে। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ৬১৩ টি মন্দিরের বিবরণ! ২০২৪ সালে হলদিয়ার আপনজন পত্রিকা থেকে পেয়েছেন সেরা প্রাবন্ধিক এবং গল্পকার হিসেবে স্মারক সম্মাননা। 
কাজ পাগল চিন্ময় দাশ, মন্দির সমীক্ষায় রত। ছবি তুলেছেন সুতনু ঘোষ

পুরুলিয়াতে চাকরির সময় শুরু করেছিলেন গল্প লেখা। আজও লিখে চলেছেন। দেশ বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত গল্পের অনুবাদও তিনি করছেন নিজের মাতৃভাষা বাংলায়। ফলে আপামর বাঙালি পাঠকদের নানা স্বাদের গল্পের স্বাদ আহরণে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন। এ পর্যন্ত অবশ্য একটি মাত্রই বই লিখেছেন তিনি। 'মেদিনীপুরের দেউল সমগ্র' (প্রথম খণ্ড)। বইয়ের সংখ্যার বিচারে তাঁর কাজের পরিমাপ করা যায়না। তাঁর ভুরি ভুরি গবেষণামূলক অজস্র কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জেলা এবং জেলার বাইরের রাশি রাশি পত্র পত্রিকায়। মেদিনীপুরকে ভালোবেসে, মেদিনীপুরকে কাছে টেনে, মেদিনীপুরকে বুকে জড়িয়ে তিনি কলমের ডোগায় বাঁচিয়ে রাখতে চান তাঁর জীবনের অন্যতম মুহূর্তগুলো। সজীব রাখতে চান মেদিনীপুর জেলার সমস্তকিছু। দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে রাখা কলম দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন।

🍂

Post a Comment

2 Comments

  1. মেদিনীপুরের দেউল সমগ্র ছাড়াও নয়ের দশকে চিন্ময় দাশ একটি গল্প সংকলন প্রকাশ করেছেন। সম্ভবত বকুলকথা নাম।

    ReplyDelete
  2. দারুন।। তথ্যটি যুক্ত করে দেবো পরবর্তীতে।।

    ReplyDelete