দূর দেশের লোকগল্প— ২২৪
লুনান (স্কটল্যাণ্ড)
বুদ্ধির বহর
চিন্ময় দাশ
লুনান এলাকার লোকেদের অভ্যাস হোল, প্যাঁচার সাথে নিজেদের তুলনা করা। এমন অদ্ভূত ব্যাপারের কারণ? আসলে, তারা বিশ্বাস করত, জ্ঞানের দিক দিয়ে বিচার করলে, দুনিয়ার সব জীবের মধ্যে, প্যাঁচাই হোল সবার সেরা। তাই নিজেদের জ্ঞানের জাহির করতে, প্যাঁচার উদাহরণ টানত তারা।
প্যাঁচাদের কথা থাক। লুনানের সেই লোকেদের জ্ঞানবুদ্ধির কেমন বহর, এই গল্পটা থেকে বেশ বোঝা যাবে।
অনেক কাল আগের কথা। লুনানের দুটো লোক বেড়াতে বেরিয়েছে। তাদের বেড়ানো বলতে, যেদিকে মন চাইল, চলে গেলাম—এইরকম আর কী।
দুজনের পরণে প্যান্ট, শার্ট, হাফকোট, মাথায় টুপি। পার্থক্য বলতে, একজনের বগলে লম্বা বাঁটের একখানা ছাতা। অন্যজনের ইয়াব্বড় এক নাক। মুখ থেকে সামনের দিকে অনেকখানি বেরিয়ে আছে নাকটা। তাকালেই চোখে পড়বে। আর, সেটা দেখলেই মনে হবে, দুনিয়ার সবকিছুতেই নাকটাকে গলিয়ে দেবার জন্য মুখিয়ে আছে মানুষটা।
পথ চলছে। আর, সারা দিনই কথা বলে চলেছে দুজনে। পথে যা কিছু চোখে পড়ছে, সব কিছু নিয়েই কথা বলছে তারা। যেন দুনিয়ার সব কিছুই তারা জানে।
চলতে চলতে সাসেক্স এলাকায় এসে পড়েছে। সেখানে এক বুড়ো চলেছে হাটের পথে। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েছে শরীরটা। পাশের গাঁয়ে একটা হাট বসে। একটা পাকা কুমড়ো বগলদাবা করে, হাটে যাচ্ছে বুড়ো। বিক্রি করলে, দুটো পয়সা আসবে হাতে।
একেবারে সামনে এসে পড়েছে বুড়োটা। কিন্তু তার দিকে না চেয়ে, কুমড়োটার দিকেই চেয়ে আছে দুজনে। এ জিনিষ তো আগে কখনও দেখেনি তারা। নিজেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে তারা ঠিক করল, জিনিষটা কী, জেনে নিতে হবে।
একজন বলল—জেনে নিতে দোষ কী? সবকিছু কি আর আগে থেকে জানা যায়?
অন্যজন বলল—অবহেলা না করে, সবকিছু জেনে নেওয়াই প্রকৃত জ্ঞানীর কাজ।
বুড়োকে দাঁড় করিয়ে, তারা বলল—সুপ্রভাত, খুড়োমশাই। নমস্কার।
দুজনেই মাথার টুপি খুলে হাতে নিয়েছে। মাথা ঝুঁকিয়ে যেভাবে কথাগুলো বলল, যেন দেশের রাজাকে কুর্ণিশ করছে।
🍂
দুজনের ভাবভঙ্গী আর কথা শুনে, ভারি মজা লাগল বুড়োর। সাথেসাথেই জবাব দিয়ে বলল—সুপ্রভাত, নমস্কার। তা বাপু, কোথা থেকে আসা হচ্ছে দুজনের? ঠিক চেনা লোক বলে তো মালুম হচ্ছে না।
--ঠিকই তো। আমাদের চিনবে কী করে? আমরা হোলাম গিয়ে লুনানের লোক।
অন্যজন বলতে লাগল—যে লুনানের লোকেরা …
তাকে থামিয়ে দিয়ে, বুড়ো বলল—খুব জ্ঞানী হয়, এই তো? এ আর বলতে হবে কেন? এ তো সবাই জানে। তা, জ্ঞানী মানুষদের বাছারা, এদিকে কী মনে করে?
--কিছুই মনে করে নয়। আমরা দেশ দেখতে বেরিয়েছি। আর, এই দেখতে দেখতেই কত কিছু জানা যায়। সেই জানা থেকেই…
এবারও লোকটাকে থামিয়ে দিল বুড়ো। বলল—সেই জানা থেকেই জ্ঞান। আর জ্ঞান থেকেই জ্ঞানী। লুনানের লোকেদের জানার কোন শেষ নাই বলেই, জ্ঞানী হিসাবে তাদের এত সুনাম! তা, বলো বাছারা, আমার কাছে কী জানতে চাও?
--আমরা জানতে চাই, তোমার বগলে ওটা কী বস্তু? অমন জিনিষ তো আমরা আগে দেখিনি!
লোকদুটোর বুদ্ধির বহর বুঝতে বুড়োর বাকি রইল না। জবাব দিল—দেখবে কী করে? সচরাচর যে জনিষ দেখা যায় না, সেটা আগে না দেখাটা এমন কোন খামতি বা কোন দোষের নয়। তবে বাপু, তোমরা প্রকৃতই ভাগ্যবান। এমন দুর্লভ জিনিষটা আজ তোমাদের দেখা হয়ে গেল। এটাও বেশ একটা জ্ঞানলাভের ব্যাপার।
--সে তো বটেই। কিন্তু খুড়ো, জিনিষটা কী?
খুব গম্ভীর হয়ে বুড়ো বলল—এটা হোল একটা ঘোড়ার ডিম। তাও আবার যে-সে ঘোড়া নয়, একেবারে …
তাকে কথা শেষ করতে দেওয়ার মত সময় বা ধৈর্য্য কিছুই নাই দুজনের। তারা উল্লাসে বলে উঠল—হায় ভগবান, তাই না কি? এতদিন ঘোড়ার ডিমের কথা কেবল শুনেই এসেছি। আজ আস্ত সেই জিনিষটা একেবারে আমাদের চোখের সামনে!
ভিতরে ভিতরে হাসির চোটে পেট ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে বুড়ো এখনও গম্ভীর। সেইভাবেই বলল—আরে, তাতে কী হয়েছে? মানুষ তা-ই দেখে, যা সচরাচর দেখা যায়। কিন্তু দুর্লভ জিনিষই এমন সুন্দর, আর এমনই বিচিত্র হয়।
লোক দুটো বলল—তা এমন একটা দুর্ল্ভ জিনিষ নিয়ে, তুমি চললে কোথায়?
--সামনের গাঁয়ে একটা হাট বসে। সেখানে এটা বেচতে যাচ্ছি।
--ওহ মা, তাই নাকি? তাহলে আর কষ্ট করে হাটে যাওয়ার দরকারটা কী? আমাদেরই বেচে দাও এটা।
বুড়ো বলল—দিতে আর আপত্তি কীসের? কিন্তু তোমরা কি আর অতো দাম দিতে পারবে?
--তুমি তো গাঁয়ের হাটেই যাচ্ছো, খুড়ো। সেখানেই বা কত দাম পাবে?
--ঠিকই বলেছ। এক্কেবারে লাখ কথার এক কথা। এই না হলে জ্ঞানী মানুষ! বেশ তারিফ করবার গলা করে, বুড়ো বলল-- সত্যিই তো, এমন জিনিষের দাম দেয়, গাঁয়ে তেমন লোক কোথায়?
লোকগুলো বলল-- তাহলে যাচ্ছো কেন?
বুড়ো বলল—আসলে সময় হয়ে এসেছে। যে কোন দিন বাচ্চা বেরুবে ডিম ফুটে। আর একে ঘরে রাখা ঠিক নয়। কেন না, আমি গরীব মানুষ। আমারই বলে পেট চলে না। ঘোড়ার খাবার জোটাব কী করে?
লোকদুটো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। বুড়ো বলল-- তাছাড়া, আসল কথা হোল, আমাদের এখানে একটা সুবিধা আছে। হাটের দিনে জমিদারের সেপাই আসে। তেমন জিনিষ পেলে, তারা কিনে নিয়ে যায়। দাম সে যাই হোক না কেন। সে জন্যই হাটে যাচ্ছি গো, বাছারা!
লোক দুটো আবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। এমন একটা দুর্লভ জিনিষ! হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে? সুযোগ কারও জীবনে বার বার আসে না। আর, এসেই যখন পড়েছে, তাকে অবহেলা করা জ্ঞানী মানুষের কাজ নয়।
তারা বলল—বলো, কত দাম চাও?
--এ জিনিষের আবার দর-দাম কী? গুণে গুণে দশটি মোহর। একটা বেশিও নয়, একটা কমও নয়।
-- জিনিষটা দুর্লভ, সে আমরাও মানছি। কিন্তু খুড়ো, দামটা একটু বেশি হয়ে গেলো না?
--শোন, জ্ঞানী মানুষের বাছারা। হাটে গেলে, আমি এর বেশি দরও পেয়ে যেতে পারি। তবুও যে এই দরে দিয়ে দিচ্ছি, সেটা দুটো কারণে।
লোক দুটো খুব খুশি। ডিমটা পাওয়া যাচ্ছেই, এই সুযোগে কারণ দুটোও জানা হয়ে যাবে। সবাই জানে, যত জানা, তত জ্ঞান। তারা বলল— কী কারণ, বলো তো।
বুড়ো বলল—কারণ নাম্বার এক, তোমরা লুনানের লোক, জ্ঞানী মানুষ। সঠিক বলতে কী, দশটি মোহর দিয়ে তোমরা তো আর শুধু একটা ঘোড়ার ডিমই কিনে নিয়ে যাচ্ছো না। তোমরা নিয়ে যাচ্ছো, তোমাদের সারা জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা। আর জানো নিশ্চয়, অভিজ্ঞতাও তো জ্ঞানেরই উৎস। এই অভিজ্ঞতা তোমাদের সারা জীবন ধরে শিক্ষিত করবে।
এ কথা শুনে, চোখেমুখে বেশ একটা আলো ফুটে উঠল লোকদুটোর। ভারি পুলকিত হয়েছে তারা। বলল—দু’ নম্বর কারণটা কী?
দু’ নম্বর কারণ হোল, এখানেই খদ্দের পাওয়া গেলে, অতটা পথ আর হাঁটতে হয় না। যতই হোক, বুড়ো মানুষ তো।
লোক দুটো আর দেরি করল না। দশটি মোহর দিয়ে, কিনেই নিল কুমড়োটা। বলল—কিন্তু খুড়ো, পকেট যে ফাঁকা হয়ে গেল, আর এগোব কী করে?
মোহরগুলো পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বুড়ো বলল—আর এগোবার দরকারটাই বা কী? সোজা বাড়ি ফিরে যাও। একটা বৃহৎ জ্ঞান অর্জনেরও তো একটা বৃহৎ ধাক্কা আছে। সেটা সামলাবার জন্য, কিছুদিনের বিশ্রাম দরকার। নিজের বাড়ি ছাড়া কি আর প্রকৃত বিশ্রাম হয় না কি কোথাও? অবশ্য তোমরা জ্ঞানী মানুষ! তোমাদের আর আমি কী পরামর্শ দেব?
--আরে, না না। পরামর্শ সবার কাছ থেকেই নেওয়া যেতে পারে। জ্ঞানী মানুষেরা তাই করে থাকে।
--তাহলে, আমি আর একটা কথা বলি। ঐ হাটের পথে না ফেরাই ভালো। অনেকেই দু’চার পয়সা বেশি দাম দিয়ে, এটা বাগিয়ে নিতে চাইবে। তোমরা দূর দেশের লোক। সামাল দিয়ে উঠতে পারবে না।
কথাটা বেশ মনে ধরল দুজনের। হাটের পথে যাওয়া মানেই বিপদ। বাড়ির পথ ধরল তারা। কুমড়োটা এখন তাদের বগলদাবা। হাত নেড়ে, বিদায় জানাল বুড়োকে—চলি খুড়ো। আবার দেখা হবে।
বুড়ো মনে মনে বলল, আমার সাথে তোমাদের আর দেখাটেখা না হওয়াই ভালো। অন্তত আমার পক্ষে। মুখে বলল— সাবধানে নিয়ে যেও কিন্তু। বাচ্চা ফুটে বেরোবার সময় হয়ে এসেছে। দেখবে না, কী সুন্দর খয়েরি রঙ হবে বাচ্চার। আর, কী দূরন্ত গতি হবে চারটে পায়ে। নেহাত আমি গরীব মানুষ, তাই দিয়ে দিতে হোল।
--হ্যাঁ, মনে থাকবে, খুড়ো। চলি। বলে হাটের পথ ছেড়ে, পাহাড়তলির রাস্তা ধরল দু’জনে।
বকর বকর করতে করতে পথ চলা তাদের দুজনেরই অভ্যেস। এখন কিন্তু তারা দুজনেই চুপ। মনে মনে দুজনেই ঘোড়ার ডিমটার কথাই ভাবছে। দেশে ফিরে, লোকজনকে বড়াই করে বলবার মত একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। সুবর্ণ মুদ্রার বিনিময়ে সুবর্ণ সুযোগ!
একটা খেতের পাশ দিয়ে চলেছে। আল রাস্তা। দুজনেই অন্যমনস্ক। হঠাৎই হোঁচট লেগে কুমড়োটা গেল পড়ে। ফটাস করে একটা শব্দ হোল কেবল। ফেটে চৌচির হয়ে গেল কুমড়োটা।
এদিক হয়েছে কী, সেটা ছিল চিনাবাদামের খেত। আলের আড়ালে ছিল একটা খরগোশ। লুকিয়ে লুকিয়ে বাদাম খাচ্ছিল কুটুস-কুটুস করে। হঠাৎই এমন বেমক্কা একটা শব্দ। বলতে গেলে, একেবারে কানের পাশেই। আচমকা শব্দে, তিড়িং করে শূণ্যে লাফিয়ে উঠল খরগোশটা।
ঘটনাটা ঘটল লোক দুটোর একেবারে বিস্ফারিত চোখের সামনে। কামানের গোলার মতো কিছু একটা উঠে গেল আকাশে। নীচে পড়েই, লম্বা দৌড়।
আহা, কী সুন্দর চেহারা। চকচকে বাদামি রঙ। খুদে খুদে চারটে পা। ছোট্ট এক টুকরো লেজ। সুন্দর একজোড়া কান। সবই স্পষ্ট দেখতে পেলো তারা। তবে, সবচেয়ে সুন্দর তার চোখ জোড়া। লাল টকটকে। ঠিক যেন প্রবালের দুটো দানা বসিয়ে দিয়েছেন বিধাতা। গায়ের রঙটারই বা কী বাহার!
প্রথম লাফে বাদাম খেতের প্রায় মাঝামাঝি গিয়ে পড়ল খরগোশটা। তার পরে আবার লাফ। পরে, আবার একটা লাফ। মূহুর্তেই বাদামের খেত পেরিয়ে, পাহাড়তলির জঙ্গলে সেঁধিয়ে গেল প্রাণীটা।
পুরো বিদ্যুৎ চমকের মত একটা ছবি। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল লোক দুটো।
এদিকে হয়েছে কী, পাশের বাদাম খেতেই কাজ করছিল কয়েকজন লোক। চাষিবাসি মানুষ। এরা দু’জন তাদের হাঁক পেড়ে বলল—ধরো, ধরো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছো কী? আমাদের ঘোড়ার বাচ্চাটা পালিয়ে গেল।
চাষিগুলোর কিছুই চোখ এড়ায়নি। কথাও কান এড়াল তাদের। এদের বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় বুঝতে বাকি রইল না কিছু। তারা জবাব দিল—ঘোড়ার বাচ্চাই বলো, বা সুযোগ—একবার হাত ছাড়া হলে, আর ফেরে নাকি কখনো?
লোক দুটো আর কী করে! কতক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল জঙ্গলটার দিকে।
অনেকক্ষণ পরে একজন বলল—দশটা মোহরও গেল ঘোড়ার বাচ্চাটার সাথে।
অন্যজন জবাব দিল—যা গেছে, তা যাক। কিন্তু ডিম ফুটে জলজ্যান্ত একটা ঘোড়ার বাচ্চা বেরুনো—সে দৃশ্যটার কথা ভাবো! তাও আবার একেবারে নিজের চোখের দোরগোড়ায়! এটা কি কম মূল্যবান অভিজ্ঞতা না কি?
অপর জন আবার বলল- তা অবশ্য ঠিক। আর, অভিজ্ঞতা মানেই তো জ্ঞান। সেজন্যই তো আমাদের ঘর ছেড়ে বাইরে বের হওয়া। সেজন্যই খরচ-খরচা।
0 Comments