বংশীর খেলাধূলা পর্ব ৩
আজি বারি ঝরে ঝরো ঝরো। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে সারারাত। উঁচুতলার মানুষরা খুব খুসি, এ কিউ আই কমে গেছে, নো পলিউশান। নীচে যতই হই চই হোক, জল কাদা, ইলেক্ট্রিক তার ছুঁয়ে কিল বিল করতে করতে হোক দু একজনের গঙ্গা লাভ, উপরে বেশ ঠান্ডা হাওয়া, ভিউ, শহরটা এখন ভালোই লাগে। কলকত্তা। লোকে যাই বলুক ব্যবসা এখানে ভালোই হয়। সবাই বৃষ্টি দেখতে দেখতে শেয়ারের হিসেব করে। আজ উঠল না পড়ল? সেই মত কাল আবার শুরু হবে কেনাবেচা।
বংশী এখন আর কিছুই ভাবছে না। এখন ওর খুব ঘুম পেয়েছে, মাথার মধ্যে দপদপ দপদপ শব্দটা আস্তে আস্তে থেমে আসছে। পা টিপে টিপে মাথায় এসে ঢুকছে হাল্কা হলুদ রঙ্গের একটা হাওয়া। কাল রাতে কি যে হোলো, বড্ড বেশি ভাবনা তাকে পেয়ে বসেছিল, ভাবনার পোকাগুলো সারারাত কুরে কুরে খেয়েছে, কে যেন কানের কাছে খালি বলে গেছে, এত রক্ত কেন? এত রক্ত কেন? তারপর যেন বৃষ্টির মত নেমে এল মন খারাপ। ঝির ঝির করে ঝরতে লাগল বৃষ্টির সঙ্গে, ওকে ঘিরল, ভেজালো, তারপর কখন যেন কেউ বলল, চল এবার ডুবি। এই ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের শিশির সবকটা একসঙ্গে মুখে দিয়েছে, মাথার পোকা গুলো মরছে, একটা একটা করে মরছে, শান্তি, আরাম।
সুস্মিতার আজ ডিউটি আছে বংশীর কাছে। আবার দুপুরে মিছিল আছে, বিচার চাই চলছে এখন সব জায়গায়, সেই মিছিল, পাড়ার এক দাদা এসে বলে গেছে, সবাই যাবি কিন্তু, তোদের দাবি তোরাই তো তুলবি। দাদা তো দাদাই। দল যায় আসে দাদা থাকে। বাধ্য বোনটি হয়ে শুনতে হয়। নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। যেতে বললে তো যেতে হবেই। কিন্তু জরুরী কাজও আছে। আজ একটা লেখা পাঠাবে বংশীকাকু, মানুষের স্বর নামে একটা পত্রিকায়, লাস্ট ডেট। সুস্মিতা চটপট রেডি হয়ে দৌড়ল অটো ধরে বংশীর ফ্ল্যাটে। ছাতাটা ছাঁট আটকায় না, তবে একটু বৃষ্টি ধরেছে, রাস্তা একটু ফাঁকা, আজকাল অনেকেই অসুবিধে হলেই ওয়ারক ফ্রম হোম করে দেয়। অটোওলাদের তা করলে চলে না।
🍂
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বেল বাজাল। এক সাইডটা বেশ ভিজে গেছে, একটা হাঁচিও হল। ছাতাটা মুড়তে জল পড়তে লাগলো, সিঁড়ি দিয়ে জলের একটা ধারা।
বেল বাজল। একবার দুবার। একটু সময় দিয়ে আবার তিনবার। কিন্তু দরজা খোলে না কেউ। বংশী স্যারের দরজা নিস্তব্ধ। এত ঘুমোয় না কোনদিন, রাতে তো ঘুম আসেইনা কাকু বলে । ভিতরে কান পাতল, কোন নড়চড়ার আওয়াজ নেই, টিভির আওয়াজ নেই, জল পড়ার আওয়াজ নেই। বেল বাজিয়ে বাজিয়ে যখন ওর মাথায় ভয় ঢুকতে শুরু করেছে, বৃষ্টিতে ভেজা ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে আবার ধাক্কা দিচ্ছে, তখন পাশের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলেন ও বাড়ীর বউদি। তিনি ব্যস্ত মানুষ, কোন আইটি কমপানীর এইচ আর ম্যানেজার, সবাই একটু ভয় পায়। উনি নাকি হাজার লোকের চাকরি একদিনে খেয়ে থাকেন।
সুস্মিতা কিছু একটা বলার আগেই নাইটি পরা আইটির বউদি ভ্রু কুঁচকে বললেন, একটু আস্তে, বড্ড আওয়াজ হচ্ছে, বলেই সুড়ুত করে ঢুকে গেলেন আবার।
অগত্যা দাদা নবীনকে আরজেন্ট কল। নবীনের আজ ডিউটি নেই, স্যার গেছেন দিল্লীতে মিটিং করতে। ও বসে চা খাচ্ছিল আর নিশার সঙ্গে একটা কিছু আলোচনা করার কথা ভাবছিল তখনি ফোন,
‘দাদা শীগগির আয়, বংশী স্যার সাড়া দিচ্ছেন না, কি জানি কিছু একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছে।‘
ইতিমধ্যে দরজায় বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে কোন কাজ হয় নি। নীচে গাড়ী ধুতে আসে তপন। সে একটা বেঢপ রবারের বর্ষাতি কোত্থেকে জোগাড় করেছে, তাই পরে গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, ধোয়ার আজ দরকার আছে কি। কিন্তু কাজ না করলে পয়সা পাবে না। সুস্মিতা গিয়ে তাকে ডেকে আনল,
‘একটু আসবেন? কাকুর দরজায় পনেরো মিনিট ধরে ডাকছি, সাড়াই দিচ্ছে না। ‘
তপন গাড়ি মোছার ঝাড়নটা নিংড়ে নিয়ে একটা গাড়ীর মধ্যে ঝুলিয়ে দিয়ে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। বেল বাজাল, ধাক্কা দিল বেশ কয়েকবার, কাকু কাকু উঠুন কত ঘুমোবেন বলে চিৎকার করল, কিছুতেই কিছু হয় না। সুস্মিতার ভয়টা, যেটা এতক্ষণ মাথায় খচখচ করছিল, বলার সাহস হচ্ছিল না, সে কথাটাই বলে ফেলল তপন ‘কাকু মরে যায় নি তো?’
‘কি যে বল ভুলভাল। দেখ অজ্ঞান হয়ে গেছে বা ঘুম থেকে উঠছে না। একবার দেখতে পারো না কার্নিশ দিয়ে উঠে?’ কিছু যে হবে না, হতে পারে না, এই বিশ্বাসটা জোর করে আঁকড়ে সুস্মিতা তপনকে তাড়া দেয়।
একটা লোক কার্নিশ দিয়ে উঠতে দেখে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল। চারজন নতুন বোরডার ffff হয়ে পিট্টু ব্যাগ নিয়ে চলে গেল আইটি পারকে। একবার দেখল, কিন্তু ওদের পাঞ্চ করতে হয়, নইলে হাফডে। এসব দেখে সময় নষ্ট করার মত হাতে নেই। অন্য কেউ হলে লোকে চোর চোর বলে হইচই বাঁধাত, তপন চেনা শোনা লোক। রোগা ছেলে, কিন্তু হাতে পায়ে জোর আছে রোজ একশোটা গাড়ী মুছে মুছে, ও তড়বড় করে উঠে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ব্যাপারটা দেখল। বংশী হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে, হাতের পাশে খালি শিশি।
‘সুইসাইট সুইসাইট, চীৎকার করতে করতে নেমে এসে সুস্মিতার বিহ্বল মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তপন বলল ‘জানলা ভাঙতে হবে’
ইতিমধ্যে নবীন এসে পড়েছে, তার গাড়ীটাও নিয়ে এসেছে বুদ্ধি করে, জানলা ভাঙা দরজা খোলা, গাড়ীতে তোলা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সব সুস্মিতার চোখের সামনে দিয়ে সিনেমার রীলের মত দ্রুত বয়ে গেল, হাসপাতালের এমারজেন্সীর সামনে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের স্টাফকে বোঝাতে বোঝাতে, পিছনে পর পর এসে দাঁড়াল আরও কয়েকজন। সুস্মিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে নিশা না? নিশা নামছে অটো থেকে। তারপর টেনে নামাচ্ছে একজন ভাঙ্গাচোরা বুড়োমানুষকে। ওর বাবা নাকি?
নিশার বাবার বোধহয় পেটের ভিতরে ফেটেই গেছে, মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, নিশা বিহ্বল হয়ে ওর দিকে না তাকিয়েই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল, সামনে বাবা, বাবাকে ও জড়িয়ে ধরে কোনমতে সোজা রাখছে। ওদের ঠিক পিছনে।
কিন্তু দাঁড়ালে কি হবে। এমারজেন্সী খোলা কিন্তু শুনশান। এডমিশান বন্ধ। ডাক্তার নেই। তারা মিছিলে গেছে, তারা প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ করতে গেছে সেই ভীষণ বড় নারকীয় ঘটনার। বিচার না পেলে তারা ফিরবে না।
নিশা আর না পেরে বাবাকে নিয়ে বসেই পড়ল রাস্তায়। তারপর কাঁদতে বসলো। সুস্মিতাও কাঁদছে।
নবীন বুঝতে পারছে না কাকে ও থামাবে। চারপাশে আরো অনেক লোক, কারো পাএর ওপর দিয়ে লরী চলে গেছে, কেউ ক্যান্সারের শেষ অবস্থা, নেতিয়ে পড়ছে, কেউ পেটের যন্ত্রণায় কাতরে কাতরে গড়িয়ে পড়ছে। একজন ইউটিউবার ফেশবুক লাইভ করছে, তিরিশ তলার ওপরে বসে দেখবেন সজ্জন মানুষেরা, তাদের জন্য। দেখতে দেখতে বলবে, কলকত্তার সবই ভালো। কালচার আছে। কালী মা আছে। কিন্তু বড্ড চেঁচায় লোকগুলো।
নবীনের পেটটা হঠাৎ আবার ঝড়াং করে খোঁচা দিল। পেটের মধ্যে যেন একটা ছোট পাহাড় ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, ব্যথায় ঝনঝন করছে শরীর, ও পেটে চেপে বসে পড়ল, মাথা নীচু করে লুকোতে চেষ্টা করল, ব্যাথার ঝোঁকটা, অস্পষ্ট স্বরে নিশার দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘একটু জল দিবি কেউ, আর পারছি না, ভীষণ ব্যথা করছে রে।
এমারজেন্সীর গেটের সামনে বড় লাইন। গ্রাম গঞ্জ থেকে টেম্পো চেপে, পাড়ার নেতার এম্বুলেন্সে চড়ে, ট্রেনের কামরায় কাতরাতে কাতরাতে আসা জনতার এখন বেশ একটা ভীড়। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে আমাদের এই লেখার সংসারের চরিত্রের দল, বংশীবদন ( পদবী নেই), নিশার বাবা, নবীন ড্রাইভার। যেন চিত্রগুপ্তের দপ্তর খোলার আশায়। কিন্তু কয়েকজন ডোম ছাড়া আর কারো দেখা নেই। হাসপাতাল তো বন্ধ। যদিও কাগজে কলমে আইনী পর্চায় হাসপাতাল পুরোদস্তুর চালু।
এদিকে বৃষ্টিটা আবার বাড়তে শুরু করল, মাথা বাঁচাবার জায়গা খুব বেশি নেই, এখানে, ওখানে কার্নিশ দিয়ে জল ঝরছে। তারপর হঠাত এলো ঝম ঝম করে বৃষ্টি অঝোর ধারায়।
সবাই ভিজছে। ভেসে যাচ্ছে দেশ, আন্দোলনে, রাগে সবাই নিজের হাত কামড়ে কামড়ে রক্ত বার করে ফেলছে। বারিধারায় মিশে যাচ্ছে সেই রক্ত, বয়ে যাচ্ছে কালো এস্ফাল্ট দিয়ে।
এইভাবে সেই অদ্ভুত নাট্যমঞ্চের কুশীলবরা যখন ধীরে ধীরে বৃষ্টিতে গলে গিয়ে ছায়ার মত হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এই শহরটাই জলের বন্যায় মিশে গলে গিয়ে নেমে যাচ্ছে হাইড্রেন্ট দিয়ে, সেই সময় হঠাৎ বংশীবদন স্ট্রেচারে উঠে বসলেন জোম্বির মত।
ঘোলা চোখে তাকিয়ে দেখলেন চারদিকে। কিছুতেই বুঝতে পারলেন না তিনি এখন কোথায়? গাজায় না বাংলা দেশে না ইউক্রেনে না কলকাতায়।
কোথা থেকে একটা বিটকেল দেখতে লোক, বহুরূপীর মত পোষাক পরে সামনে এগিয়ে এল, মাথায় একটা প্লাস্টিকের মুকুট, রংটা করেছে মানুষের হাড়ের মত। গালে মুখে অদ্ভুত রঙ লেপা, হাতে গ্লাভস। এসে বলল,
‘নড়ছেন কেন? টাইম পেরায় হয়ে গেছে। চুপচাপ শুয়ে থাকুন’
বংশীর শেষ মনে আছে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল, তারপর সেই বৃষ্টির রঙ কখন যেন কমলা থেকে লাল থেকে হলুদ হয়ে গেল, জানলা দিয়ে ঝাপটা আসছিল, ভয়ে পরদাও টানা যাচ্ছিল না। তাহলে কি আগুন লেগে গেল? নাকি বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল? এই কি সেই গীতা উদ্বুদ্ধ ওপেনহাইমারের শ্লোক, আই এম বিকাম ডেথ!
কে যেন লাঠি দিয়ে এক খোঁচা দিল। চোখ একটু একটু খুলছে, মনে হল একজন শান্তিরক্ষক। ওর চোখ খুলতে দেখে, সে চীৎকার করে উঠল
‘আরে শালা এ তো বেঁচে আছে, এখানে ঢুকিয়েছিস কেন?’
‘কাউন্টিং তো হয়ে গেছে, খাতায় লেখা হয়ে গেছে, বেঁচে ওঠার আর টাইম পেল না, ব্যাটা বুড়ো ভাম। কি করি এখন?’
‘কে লিখল এর ডেথ সারটিফিকেট? ডাক্তারবাবুরা তো মিছিলে?
‘ কে আর লিখবে, আমিই সই করে দিলাম। ওদের সঙ্গে লোক ছিল তারা ফরাম ভত্তি করল, আর হাসপাতালের স্টাফ তো শুধু আমি, সই করে দিলাম। এ তো নড়ছিল না, নাড়ীও নেই, সবাই তো বলল মরেই গেছে।
‘কি খেয়েছিলি?’
‘পুলিশদের মত তো আমরা খেতে পারিনি, ঐ দু এক ঢোক। এখন কি করি বলত? তোমার লাঠিটা দিয়ে দুঘা মাথায় দেব?’
ততক্ষণে বংশীর ঘোর কেটে গেছে। ও অবাক হয়ে শুনছিল, দু ঘা মাথায় দেবার কথা হতেই ওর সম্বিত পুরোটা ফিরে এল। ও হঠাৎ উঠে দৌড়তে শুরু করল।
পিছন পিছন তাড়া করে ডোম এবং পুলিশ। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে এখন গোল চাঁদ। ওরা তিনজন ঘুরতে থাকল চোর পুলিশ। মজার খেলা, তিনজনেরই খেলতে খেলতে খুব আমোদ হয়। এর মধ্যে একটা কুকুর আশ্রয় নিয়ে ছিল, তাকে কেউ এক লাথি মারল, সে কেঁউ কেঁউ করতে করতে এসে দেখল তিনজন বেশ দৌড়চ্ছে, ও মনের আনন্দে যোগ দিল সেই বৃত্তে। অন্ধকারে গা মুড়ে আরো কেউ দেহহীন তাতে যোগ দিলো কিনা সেটা শুধু দেখল বুড়ি চাঁদ। তাকিয়ে দেখতে থাকল সেই রিলে রেস, বিরাট নীল স্টেডিয়ামে একলা দর্শক।
যারা লাইনে দাঁড়িয়েছিল, তারা অনেকে ফিরে গেছে, অনেকে আর ফিরে যায় নি। কে আর অত খবর রাখে। টিভির পর্দায় ব্যোমকেশ সিরিজ চলতে থাকে, সঙ্গে সুইগি জোমাটোর টেংরি কাবাব। কাল আবার আন্দোলন হবে।
অনেকদিন পরে বংশী খেলায় মন দেয়। মনে পড়ে মিলখা সিঙের কথা, জেসি ওয়েন্সের কথা, উসেন বোল্টের কথা। তাকে তো দৌড়ে যেতে হবে যতক্ষণ না পিছনে দৌড়ে আসা লোকদুটো ক্লান্ত হয়। কপাটি কপাটি কপাটি।। সুস্মিতা দেখলে খুসি হত। ওরা হয়ত এখন দৌড়চ্ছে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে, এডমিশানে জন্য।
-শেষ-
0 Comments