সেই আমার ছেলেবেলার বইমেলা
গৌতম বাড়ই
কলকাতায়, বা তখনকার দ্যা গ্রেট ক্যালকাটা সিটিতে একটা বইমেলা শুরু হয়েছে। যেখানে আস্ত একটা বই বাজার নতুন আর পরানো মিলে, কলেজ স্ট্রিট জুড়ে, সেখানে এ অভিনব হলেও, ভীষণ আশ্চর্যের নয়। ইওরোপের থেকে শুধু ভাবনাটা হ্যাক করা হয়েছে। আধুনিক যা ভালো তার তো ইউরোপ থেকে নেওয়া, ক্ষতি নেই তাতে। বাস্তবিক কলকাতা কালচারাল সিটি, বোম্বে টাকার গরমে আর উঁচু উঁচু বহুতলে সেইসময় যতই হম্বিতম্বি করুক। মনে পড়ে, সেইহময়ের দৈনিক কাগজে বইয়ের বিজ্ঞাপন কত কী ছড়াছড়ি। মনে তার আঁচ লাগল। আমরা ক্ষুদ্র এক মহকুমা শহরের নাগরিক তখন। নাগরিক বলতে যা বোঝায় সেটুকুও না। বয়স তখন কত মেরে কেটে বছর দশেক। হাফ নাগরিক। তারপর একদিন আমাদের শহরেও বসল বইমেলার আয়োজন। সম্ভবত কলকাতার বাইরে সবচেয়ে পুরানো জেলার এই বইমেলা। একটা স্ট্রাটেজিক অবস্থানের জন্য আমাদের এই শহর ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমবঙ্গে রাজধানী কলকাতার পর। তবে শহরটির মধ্যে আরও একটি মজার জিনিস লক্ষ্য করবার মতন অতীতের সেই সময়ে , এই শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মেডিক্যাল কলেজ, একটি আকাশবাণীর বেতার কেন্দ্র রয়েছে। তবে কলেজ সবেধন নীলমণি একটি, আর সেই বিল্ডিং - এ রাতের কমার্স কলেজ ধরলে দুটো কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় আছে নাম তার উত্তরবঙ্গ, মেডিক্যাল কলেজ সেটাও উত্তরবঙ্গ। আর শুনছি উত্তরবঙ্গের অলিখিত রাজধানী নাকি আমাদের এই শহর। প্রধান রেলস্টেশনের নামও নিউ জলপাইগুড়ি( এনজেপি)। এয়ারপোর্ট তাও আছে এই শহরের কাছেই। তো এখানেই উপযুক্ত জায়গা, ধুমধাম করে সাড়ম্বরে শুরু হল শিলিগুড়ি বইমেলা তথা উত্তরবঙ্গ বইমেলা। যে সব বন্ধুরা ভীষণ ভাগ্যবান তারা কলকাতা বইমেলা দেখে কত কী গল্প করছে স্কুলের ক্লাসরুমে। আমরা অবাক হয়ে শুনি কলকাতা শহরের কথা। একদিন বাস্তবিক সেই বইমেলা আমাদের হাতের মুঠোয় এল। সেই ছোট্ট বয়সে আমরা আমাদের বাড়ির অল্প দূরে শক্তিগড় পাড়ার শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের সদস্য হয়েছি পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে। মাসিক চাঁদা পঁচিশ পয়সা। এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে তখনকার লাইব্রেরিয়ান কানাইদার কথা। আরও একটা মিষ্টি স্মৃতি আছে এই লাইব্রেরি ঘিরে। পরে বলছি। আগে বলি সেই প্রথম দেখা বইমেলার কথা। যা আজও উজ্জ্বল স্মৃতির মণিকোঠায়।
🍂
বইমেলা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল শিলিগুড়ি বয়েজ স্কুলে । কেউ বলে তরাই তারাপদ আদর্শ বিদ্যালয়ে। আসলে এখনও গুলিয়ে ফেলি ওই মহকুমা গ্রন্থমেলা আর উত্তরবঙ্গ বইমেলা মিলিয়ে। উত্তরবঙ্গ বইমেলার বয়স সবথেকে বেশি, হয়ত প্রথম বইমেলা ওই উত্তরবঙ্গ বইমেলা। স্মৃতি যদি খুব বিশ্বাসঘাতকতা না করে শিলিগুড়ি বয়েজ হাই স্কুলের ওই বইমেলাই আমার প্রথম বইমেলার অভিজ্ঞতা। এবারে উত্তরবঙ্গ বইমেলাটি ৪২ বছরে পদার্পণ করেছে জানতে পেরেছি। একটাই প্রশ্ন মনের মধ্যে রয়ে যায় প্রতিবার, এখন যেমন উত্তরবঙ্গ বইমেলা দূরত্বের কারণে দেখা হয়ে ওঠে না, তবুও মনে হয় মহকুমা গ্রন্থমেলা আর উত্তরবঙ্গ বইমেলা মিলিয়ে একটা বড় আকারের বইমেলা কী শিলিগুড়ি শহরে করা যেত না। আশপাশের পাহাড় , সমতল , রাজ্য, ভিন্ন দেশের লোকেরাও এখানে আসতে পারতেন। গুরুত্বপূর্ণ শহর আর অজস্র পর্যটন আর ব্যবসার সম্ভাবনা থাকলেও শুধু উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে এ শহর আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। প্রথম সেই বইমেলায় বড়মামা, মেশো আর বাবার হাত ধরে গিয়েছিলাম। তাদের কেউই নেই এখন এ ধরাধামে। তবে তাদের বইমেলার উপহারগুলো এখনও মনে আছে, দেব সাহিত্য কুটিরের পূরবী বলে একটা ঢাউস পুজো সংখ্যা। সিন্দবাদ সওদাগর আর মনে পড়ছে শিবরাম চক্রবর্তীর একটা কিশোর উপন্যাস। সেই রহস্য উপন্যাসটি ছিল দার্জিলিং বেড়ানো নিয়ে। আজ এ লেখা লিখতে বসে মনে পড়ে গেল। আর কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিনিবুক কিনেছিলাম। আবোল তাবোলও ছিল তাতে। সেই বইমেলার স্মৃতি যেন চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে উঠছে। তবে সেইসময় আমাদের সবারই একটু আধটু বইপড়ার অভ্যাস ছিল। বই নিয়ে আলোচনাও ছিল। সবখানেই, বাড়িয়ে বলছি না। তারপরের বইমেলায় সম্ভবত দেব সাহিত্য কুটির কিংবা শৈব্যা পুস্তকালয়ের ' মা আমি ও অশোক' বলে একটি বই পেয়েছিলাম। যা পড়তে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি, ঝরঝর করে কেঁদেছিলাম। মা তাই না দেখে বলেছিল, " আমিও তোর মতন কেঁদেছি বাবু দুপুরে ওই বইটি পড়তে গিয়ে।" সেই যে বইমেলা স্থায়ী হয়ে গেল মনের ভেতরে, এখনও চলছে তা।
তখন ইচ্ছে থাকলেও বইগুলো কিনতে না পেরে নেড়েচেড়ে দেখে চলে আসতাম। এখন প্রতি বছর এই যে এত এত বই কিনি, গভীর ভাবে ভাবি সব কী আর পড়া হয়ে উঠবে এ জীবনে! এ প্রসঙ্গে বলি, বইমেলার বই আর কিছু এদিক ওদিক থেকে সংগ্রহ করে একটা ঘরোয়া লাইব্রেরি পর্যন্ত বানিয়েছিলাম। নাম দিয়েছিলাম 'আগমনী পাঠাগার' । কেন ওই নামকরণ তাও নিজেই বলতে পারব না। দুর্গাপুজোর মুখে করেছিলাম বলেই কী! সেই লাইব্রেরী স্থানান্তরিত হয়েছিল দেবকাকু বলে একজনের ঘরে। দেবকাকু ছিলেন অকৃতদার, সরকারি চাকরিজীবী। যখন বড় হচ্ছি, আরও বড়। বইগুলো আমার কাছ থেকে সরে গেল। বাইরে পড়তে যাচ্ছি, কাকু কতদিন বলেছিল বইগুলো নিয়ে যেতে। আর নেওয়া হয়ে ওঠেনি। বইগুলো হয়ত হারিয়ে গিয়েছে, বা জ্বালানি কিংবা ঠোঙা হয়েছে। যদি কারও কাছে থাকে, তা হবে পরম মানসিক শান্তি। দেবকাকুও বেশ অনেক বছর হল শুনেছি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বইমেলার সাথে ওই বইগুলোর কিছু স্মৃতি উল্লেখ করলাম।
এবারে ফিরে আসি সেই মিষ্টি স্মৃতিতে, আমাদের ওই শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারে কচি স্যার বা কচিদা বলে একজন সমস্ত ম্যাগাজিনগুলো প্রথম দাবীদার হয়ে পড়তেন, আন্ডারলাইন করতেন বিভিন্ন লেখায়। আমরা হা- পিত্যেশ করে বসে থাকতাম উনি ছাড়লেই আনন্দমেলা পড়ব বলে, দেশ পড়ব বলে, কিশোরভারতী পড়ব বলে। সেই কচি স্যার কিন্তু বর্তমানের সুসাহিত্যিক বিপুল দাশ। ওঁনার হয়ত মনে নেই, আমার স্পষ্ট মনে আছে তাঁকে। বইমেলা আর বইয়ের সাথেও এও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যেমন বইপোকাদের নাকে লেগে থাকে নতুন বইয়ের গন্ধ। বইমেলা কিন্তু প্রতিবছর যেন আরও রঙীন হয়ে ওঠে নতুন মানুষে, কলেবরে। এখন যখন দেখি আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলাতে। ভাগ্যিস আমাদের বাঙালিদের একটা বইমেলাও আছে। যা আমাদের বর্তমানে বারো মাসে চৌদ্দ পার্বণ।
0 Comments