জ্বলদর্চি

সেদিনের সেই বইমেলা /মিলি ঘোষ

সেদিনের সেই বইমেলা

মিলি ঘোষ

 জ্ঞান হবার পর থেকেই বইমেলা দেখছি। বাড়িতেই। মেলা বললেও ভুল হবে। বইয়ের পাহাড়। আমার শিক্ষক বাবা ছেলেমেয়েদের মুখে রাজভোগ তুলে দিতে পারেননি। কিন্তু বইয়ের অভাব হয়নি। বাংলা ইংরেজি সব রকম বই ছিল। অতশত বুঝতাম না। চোখ ছিল নন্টে ফন্টে, হাঁদা ভোঁদার দিকে। ছবিতে গল্প। কোন শিশুর না ভালো লাগে। ছোটোবেলায় কে আর স্রষ্টাকে মনে রাখে। সৃষ্টিতেই আনন্দ খুঁজে পেতাম। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক সব পত্রিকাই আসত। পুরস্কার মানে বই, উপহার মানেও বই। তাই মেলাও ফুলেফেঁপে সমৃদ্ধ হতে থাকত। মোবাইলের তো নামই শুনিনি। টিভিও ছিল না। তাই যা কিছু আনন্দের কেন্দ্রস্থল ছিল বই। 

বাড়ি থেকে সাত কী আট মিনিট হাঁটলেই একটা বড়ো মাঠ ছিল। আজও আছে। নাম কালীতলা মাঠ। নামই বলে দিচ্ছে মাঠটি কেন বিখ্যাত। বিশাল আয়োজন করে মহা সমারোহে সেখানে কালীপুজো হতো। এখনও হয়। ওই মাঠের পাশ দিয়ে আমরা স্কুল যেতাম। বন্ধুরা সবাই তখন রাজকুমারী। বাবা রাজা হোক বা না হোক। ফেরার সময় দেখতাম মাঠে ফুটবল খেলা চলছে। সেই মাঠই কালীপুজোর সময় অন্য রূপে। মাঠের একটা বিরাট অংশ জুড়ে মেলা বসত। নাগর দোলা, ঘোড়ার দোলা আরও যা যা দোলা আছে দুনিয়ায় এসব রেখেও প্রচুর স্টল থাকত। খেলনা, সাংসারিক জিনিসপত্রের সঙ্গে কিছু ছিল বইয়ের স্টল। এই ধরনের মেলাতে বইয়ের ষ্টলে ভিড় না হওয়ারই কথা। কিন্তু তখন হতো। খুব না হলেও মানুষ কিনত। এখন সেখানে বইয়ের স্টল দিয়ে কোনও বই বিক্রেতা যেচে লোকসানের মুখে দাঁড়াতে চাইবেন না বলেই আশা করা যায়। তা ছাড়া কলকাতা বইমেলা তো আছেই। সেখানে না যেতে পারলে স্ট্যাটাস থাকবে কেন? কী নেই সেখানে? গান, নাটক, খাবারের স্টল। খালি হাতে যাওয়া, খালি হাতে ফেরা। পরদিন ফেসবুক পোস্টানো। আরে ভাই মেলা তো। 

🍂

যাইহোক, ফিরে যাই ছোটবেলার বইমেলায়। কালীতলার মেলা থেকে কোনোদিনই কিছু পাইনি। খেলনাবাটির প্রতি আকর্ষণ তেমন ছিল না। সুযোগ পেলেই মাঠ। মাঠ ছেলেদের দখলে গেলে ( অলিখিত নিয়ম ) রাস্তা আমাদের। খেলা কে আটকায়! একবার বাবার কাছে আমার একটা আবদার মা'র মারফত পৌঁছে গেছিল। তার আগে দু'দিন গেছি মেলায়। ঘুরঘুর করেছি বইয়ের স্টলের সামনে দিয়ে। বাড়িতে বলতে পারিনি। ততদিনে পথের পাঁচালী পড়ে ফেলেছি। আমার নিদ্রায় জাগরণে তখন দুর্গা। দুর্গার শরীরের উষ্ণতায় মেশা নিশ্চিন্দিপুর অহোরাত্র আমার চোখের সামনে। সেই অবস্থায় আমি পেয়েছিলাম 'ছোটদের অপরাজিত'।
মনসাপোতা গ্রামে থাকতে অপুর স্কুল থেকে ফেরার পথে পথ চলতি মানুষদের যেচে নানান প্রশ্ন করা , এক সাঁওতাল শিকারির তির ধনুক দেখে তার থেকে জেনে নেওয়া এই তির দিয়ে কী কী শিকার করা যায় এ সবই আমার অতিরিক্ত মনে হয়েছিল। এ যে অপুর অজানাকে জানার আগ্রহেরই বহিঃপ্রকাশ তা বোঝার মতো বয়স বা বুদ্ধি কোনওটিই আমার তখন হয়নি। কলকাতার কলেজে পড়ার সময় অপুর আর্থিক অনটন আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। হেড মাস্টার মহাশয় যখন অনুভব করেছেন, তাঁর ত্রিশ বছর শিক্ষকতা জীবনে এমন ছাত্র একটিই এসেছিল এবং চলে গেল। তখন অপু কেন তাঁর কাছে গিয়ে নিজের অনটনের কথা বলতে পারেনি! আসলে সব সময় একটা সমাধানের পথ খুঁজে বেড়াতাম। বড় হয়ে বুঝেছি মুখ ফুটে এসব কথা বলা বাস্তব জীবনে কতটাই কঠিন। আবার সর্বজয়ার সেই বেদনাবিধুর দিনগুলো, যখন সে রেলগাড়ির বাঁশি শুনে ভাবত এই বুঝি অপু এল, অথচ অপু আসত না । এরপর সর্বজয়া আশা করতেও ভুলে গেছিল যে অপু আসবে। পাঠকের উথালপাথাল কষ্টের এই অংশগুলো আমাকে প্রায় পাগল করে দিত। ভাবতাম আমার হাতে কলম থাকলে আমি এক আঁচড়ে এদের সুখী করে দিতাম। আমার অপরিণত মন উদ্গত কান্নাকে এভাবেই চাপা দেবার চেষ্টা করত। স্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটেও ট্রেনে না উঠে মায়ের কাছে ফিরে আসা অপুকে ভুলি কী করে! দীর্ঘদিন পরে বাড়ি ফিরে অপুর মা! মা! ডাক আজও আমার কানে বাজে। তবে, সর্বজয়ার মৃত্যুর বর্ণনা আমাকে তেমনভাবে স্পর্শ করেনি। যতবারই পড়েছি এই জায়গাটা একটু দ্রুত পার হয়ে পরের অংশে চলে যেতাম। কালের নিয়মে আপনজনদের যখন একে একে হারাতে শুরু করলাম তখন বুঝেছি সর্বজয়ার মৃত্যুর সে বর্ণনা কী ভয়ঙ্কর বাস্তব ছিল।

২৪ বছরের জীবনে অপু বারবার নিশ্চিন্দিপুরের কথা ভেবেছে। তার ছোটবেলার স্মৃতিবিজরিত গ্রাম, সেখানেই সে ছেলেকে রেখে গেল রানুদির দায়িত্বে। একবারও ভাবল না শিশু হৃদয় বাবার জন্য কতটা ব্যাকুল হতে পারে। রানুদিকে বলেছিল অপু, খোকাকে তোমার দায়িত্বে রেখে গেলাম ... যদি আমি না ফিরি ...ওকে কষ্ট পেতে দাও। আরো কিছু কথা , এখন পরিষ্কার মনে নেই। এই 'যদি আমি না ফিরি' কথাটার মধ্য দিয়েই লেখক বুঝিয়ে দিলেন অপু আর ফিরবে না। আর জীবনকে প্রায় না দেখা আমি ওই 'যদি' শব্দটাকে বিশেষ গুরত্ব দিয়ে আশা করলাম অপু একদিন ফিরবেই। কোথাও কি অপুর দায়িত্ববোধের অভাব দেখা দিল? কাজল বুঝত বাবা ছাড়া আর রানু পিসি তাকে খুব ভালোবাসে। নিশ্চিন্দিপুরের মাঠ-গাছপালা-পাখির সঙ্গে একাত্ব হয়ে গেল কাজল। তবু শিশু মন বারবার পিসির কাছে জানতে চাইত, বাবা কবে আসবে? কতদিন দেরি হবে? অপু জানত একটি শিশুর বেড়ে ওঠার পক্ষে নিশ্চিন্দিপুর আদর্শ জায়গা। তবু মা বাবা ছাড়া একটি শিশুর জীবন পরিপূর্ণতা পায় কি? এ প্রশ্ন আমার সেদিনও ছিল, আজও আছে। 

ছোটবেলার বইমেলা লিখতে গিয়ে অপুর জীবনে ঢুকে পড়লাম। কারণ বইমেলা থেকে প্রথম পাওয়া বই আমার 'ছোটদের অপরাজিত'।
তবু একটু বড়বেলায় আসতেই হচ্ছে। ১৯৯৭ সাল। ময়দানে বইমেলা চলছে। হঠাৎ আগুন লাগে। কেন আগুন, কীসের থেকে আগুন সে প্রসঙ্গ এই লেখায় অবান্তর। বেশকিছু স্টল পুড়ে ছারখার। মানুষের হুড়োহুড়ি। একজনই মারা গেছিলেন। তিনি আমার এক সহপাঠিনীর বাবা। মেয়ে পড়েছে রাজকুমারী স্কুলে। কিন্তু তিনি রাজা হতে পারেননি। মানুষ তাঁকে ভুলে গেছে।

Post a Comment

0 Comments