জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৪ / সালেহা খাতুন

১৯৯৪ - ৯৬ এর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহাধ্যায়ীরা যখন ২০১৩ তে অধ্যাপকরূপে উইন্টার স্কুলে যোগ দিই।

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৪ 
 সালেহা খাতুন

নিজেদের কর্মী বলে পরিচিতি দিলেও আড়ালে আমরা কয়েকজন কলিগ নিজেদের উৎকৃষ্ট শ্রেণির গাধা বলেই অভিহিত করি। রূপকথার গল্পের মতো রাজকুমারের সারাদেহের সূঁচ তুলে যাই। কিন্তু কেউ না কেউ একজন থাকে যে শুধুমাত্র চোখের সূঁচটা তুলেই রাজকুমারের রূপকে সমস্ত কৃতিত্বের অধিকারী হয়। মেঘনাদের মতোই মেঘের আড়াল থেকে খেলে যাই। ইন্দ্রিয়গুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখি। কাজ কাজ আর কাজ করে যাই। দাদিমার কাছে শোনা প্রবাদ সত্য হয়ে যায় – “গরিবের বেটি গতরে মানায়”। নিজেকে বড়ো বোকা মনে হয় কখনও কখনও। বুঝি সব কিছু। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও দেখি, একই প্রতিষ্ঠানে একই ডেজিগনেশনে কাজ করতে করতেও দেখি কেমন একটা মালিক শ্রেণি আর শ্রমিক শ্রেণির সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা। নিজে অধ্যাপক হলেও মাঝে মাঝেই কেমন বিজিত লাগে। ভালো কাজ আসলে এক ধরনের সংগ্রাম। জীবিত অবস্থায় ভালো কাজের তেমন মূল্যায়ন হয় না।

যাঁদের কাজকে সহজ করার জন্য নিজেকে প্রায় সঁপে দিয়েছিলাম, তাঁরা অনেকেই মনে রাখেন নি ; কেউ মনে রাখেন না। অবশ্য উপকৃত ব্যক্তি ভোলার আগেই আমি সে সব ভুলেছি। তবে যাঁদের কাছ থেকে উপকার পেয়েছি তাঁদের চিরকাল আমি স্মরণ করে যেতে চাই। কলেজ এবং বিভাগের কাজে বড়োদের সাহায্য করতে করতে কখন যে ছোটোদেরও সহায়ক হয়ে উঠেছি ! অনেক সময়ই অনেক কলিগ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, “দিদি বিলো ডিগনিটির কাজ করো না।” তাকে বলেছি ভাই ভেদাভেদ করো না। প্রতিষ্ঠান সবার উপরে। সবাই একজোট হয়ে কাজ করি বলেই তো প্রতিষ্ঠানের এতো খ্যাতি। “ভালো মানুষ” বলে লোকে দাগিয়ে দেয়, ফলে মাশুল দিতে হয়। নিজেকে নিংড়ে দিতে থাকি। আর আমার কাছে মূল মন্ত্র তো আছেই। মানুষের পৃথিবীতে কেউই আমার পর নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সাথে সাথে সারাজীবনব্যাপী যে শিক্ষা পেয়েছি এবং এখনও পাচ্ছি তা আমার মস্তিষ্ক এবং হৃদয়কে আনন্দে পরিপূর্ণ রাখে।

অ-পরের কাজ নির্দ্বিধায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি বারবার। ২০১৪-র দুই জুলাই বাংলা বিভাগে প্রথম সিলেবাস ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। তখনও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পেতে কয়েকটা দিন বাকি কিন্তু এক্সপার্টদের চিঠি পাঠানো, তাঁদের দেখভাল করা, তাঁদের যথাযোগ্য সাম্মানিক দেওয়া, সার্টিফিকেট দেওয়া, টি এ বিল দেওয়া, ড্রাফট সিলেবাস তৈরি করা সব সব কিছু আমার দায়িত্বে। ঐ যে এডুকেশন বিভাগের ওই একই কাজ কদিন আগে নিজের হাতে করে পারদর্শী হয়ে উঠেছি। তার প্রয়োগ এখানে অনায়াসেই করে দিলাম। অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে নিত্যদিন নতুন নতুন জিনিস শিখতে থাকি। এইসব কাজই আমার অভিজ্ঞতা বাড়িয়েছে এবং সফলতার সুযোগও এনে দিয়েছে।

 কলেজ স্বশাসিত হওয়ার পর যখন বাংলা বিভাগের নিজস্ব সিলেবাস তৈরি হয় তখন এক্সপার্ট হিসেবে এসেছিলেন গৌড়বঙ্গ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বিকাশ রায়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. অলোক চক্রবর্তী, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মীর রেজাউল করিম, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লায়েক আলি খান এবং নাড়াজোল রাজ কলেজের ড. নীলাঞ্জনা ভট্টাচার্য্য। নীলাঞ্জনা এবং লায়েকবাবু ছাড়া আর সবার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়।

🍂

পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেখানে যেখানে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়, সবার সিলেবাস পর্যবেক্ষণ করে বহু আলাপ আলোচনার পর একটি কাঠামো নির্মিত হয়। তারপর ২০১৪ – এর দশ সেপ্টেম্বর প্রথম বিওএস মিটিংয়ে সে সিলেবাসের মডিফিকেশন করে চূড়ান্ত রূপ গৃহীত হয়। ততদিনে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছি আমি। সুস্নাতদা ভার নিয়েছেন পিজি কোঅর্ডিনেটরের। বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় তিরস্কার এবং পুরস্কার দুটিই জুটেছিল আমার কপালে। তিরস্কার কে করেছিলেন স্পষ্ট করবো না এখানে। তবে সুস্নাতদা পুরস্কারস্বরূপ একটি পত্রিকা দিয়েছিলেন সেদিনই যেদিন বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করি। আসলে কাজের ক্ষেত্রে তিরস্কারের ভয় এবং পুরস্কারের লোভ কোনোটাই আমার ছিল না, আর আজও তা নেই। ২০১৪-২০১৬ বিভাগ পরিচালনায় আমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছিলেন সুস্নাতদা। আমাদের পারফেক্ট কোঅর্ডিনেশন ছিল। অনেক কাজ হয়েছে সে সময়। কাজকে ভালোবেসেই নিজেকে ভালোবেসেছি। কাজের আনন্দকে অভ্যাসে পরিণত করেছি। স্বশাসিত হওয়ার পর কলেজে সমস্ত দায়িত্ব রোটেশনাল হয়ে যায়। পুরোনো অনেক কিছু নিয়মনীতি বদলে যুগোপযোগী করা হয়।

এক্সটার্নাল এক্সামিনার, পেপার সেটার, মডারেটর ইত্যাদির লিস্ট বানানো আমার পক্ষে খুব সোজা ছিল। কেননা দুটি রিফ্রেশার্স কোর্স এবং একটি উইন্টার স্কুলে অংশগ্রহণ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহু অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায়। আর বন্ধু নীলাঞ্জনা বিওএস মেম্বার থাকায় আমাদের দুজনের অনেক কমন ফ্রেন্ড ছিল, তাতে কাজে সুবিধা হতো। এমনও হয়েছে নেতাজী সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটির সল্টলেক ক্যাম্পাসে দুজনে ওডিএল এর একটি ওরিয়েন্টেশানে গিয়ে লাঞ্চের সময় কাকে কাকে পেপার সেটারের দায়িত্ব দেওয়া যায় তা নিয়ে ভেবেছি।

 ১৯৯৪-৯৬ এর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সহাধ্যায়ী বন্ধুরা স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। তাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে আমার কলেজের কাজে সাহায্য চেয়েছি এবং পেয়েছিও। টুনু , অয়ন্তিকা, এবং অলোক ও রফিকের পাঠানো প্রশ্নপত্রের মডারেশান চলাকালীন ওদের হাতের লেখা দেখে এমন এক অনুভূতি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা। সব বন্ধুরা হয়তো কাঙ্ক্ষিত এবং মনের মতো পেশায় নিযুক্ত হইনি। 

তবে টুনু, তনুমিতা আমাদের বেশিরভাগ বন্ধুকে যেভাবে জুড়ে দিয়েছিল তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২০-২০২২ সময়কালে পিজি কোঅর্ডিনেটর থাকাকালীন প্রোটোকল মেনে আমি যে সমস্ত বন্ধু কলেজে পড়ায় তাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে আমাদের কলেজে পেপার সেটার রূপে তাদের BOS-এর অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। 

২০২২ এর জুন মাসে ওদের কাছে চিঠি যায়। অনেকেরই সময় ছিল না, বিভিন্নকাজে ব্যস্ত থাকায় ঠিক সময়ে প্রশ্ন পাঠাতে পারে নি। অমল, শ্যামল, নন্দিতা, গার্গী, অপর্ণা, চৈতালী, মমতাজ, ইন্দ্রাণী, সমরেশ, সিদ্ধার্থ, কার্তিক, সুফল, আশুতোষ সবাইকে বিওএসের রেকমেণ্ডেশন অনুযায়ী কলেজ থেকে চিঠি পাঠায়। চিঠি অনেকটা দেরি করে পৌঁছায় বলে হয়তো বন্ধুদের হাতে সময় ছিল না। ফলে ওরা টাইম প্ল্যানিং করতে পারে নি। বাইশের জুলাই থেকে বিভাগের পরিচালনার ভার থেকে মুক্ত হয়ে যাই বলে আর জানতে পারি নি ঐ সময় বন্ধুরা কে কী প্রশ্নপত্র পাঠালো। তবে বিওএস-এর মিটিংয়ে বন্ধুদের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলার কলেজের সঙ্গে মেদিনীপুর কলেজের একটা সংযোগ স্থাপিত হয়ে যায়।
সহাধ্যায়ী সমরেশ পড়াচ্ছে যোগমায়া দেবী কলেজে।

মনে আছে আশুতোষ আমাদের সবার আশুদা যখন মানবাজার কলেজে পড়াচ্ছে সেসময়ে ওর কাছে মেদিনীপুর কলেজের একটি খাম গেলে অবাক হয়ে যায়। ভাবতে থাকে “আমার কথা কীভাবে জানতে পারলো?” আসলে বন্ধুদের অনুমতি না নিয়েই ওদের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। আমাকেই আসামী আন্দাজ করে একদিন রাতে আশুতোষ ফোন করে আর আমরা ফিরে যাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে আর খবরাখবর নিই বর্তমানের। সে বন্ধু আমার এখন একটি কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছে। কার্তিকও কলেজের টিচার ইন চার্জের দায়িত্ব পালনের জন্য একাডেমিক কাজে মন দিতে পারছে না বলে জানায়। ও রয়েছে মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়ে। সুফল রয়েছে শিলিগুড়ির সূর্যসেন মহাবিদ্যালয়ে। সমরেশ রয়েছে যোগমায়া দেবী কলেজে। সাউথ সিটি মলে একদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়। ওখানেই অপর্ণার সঙ্গেও একদিন দেখা হয়। অপর্ণা আছে মুরলীধর গার্লস কলেজে। চৈতালী গার্গী আছে স্কটিশ চার্চ কলেজে। গার্গী তখন জানিয়েছিল নবনির্মিত বাসস্থান ঘিরে ও প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকায় এবার পেপার সেট করতে পারছে না। সিদ্ধার্থ আছে রানাঘাট কলেজে। ঠিক সময়ে ওর ফোন ধরতে না পেরে নিজেকে অপরাধী করে রেখেছি। 

বন্ধু নন্দিতার কাছ থেকেই একমাত্র জানতে পেরেছিলাম ও সঠিক সময়ে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছে। নন্দিতা আছে কালনা কলেজে। জঙ্গীপুর কলেজে আছে অমল আর শ্যামল মালদার চাঁচল কলেজ থেকে চলে গেছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরো অনেক গবেষক বন্ধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে আছে জড়িয়ে আছে। অয়ন্তিকা আনন্দমোহন কলেজ থেকে চলে গিয়ে এখন অধ্যক্ষ হয়েছে নববালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ে, প্রশাসনিক কাজ বেড়েছে ওর। তবে আনন্দের কথা এর আগে রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি অসাধারণ আলোচনা করেছিল অয়ন্তিকা আমার মেদিনীপুর কলেজে এসে। আর অনলাইনে রবীন্দ্রনাথ ও কাজী আবদুল ওদুদ প্রসঙ্গে কোভিডের সময়কালে বক্তৃতা দিয়েছিল মমতাজ। পার্থকেও নাটক নিয়ে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করেছিলাম। ওর ব্যস্ত সময় থেকে কিছুটা সময় দিতে তৈরি ছিল ও । পরীক্ষা পরীক্ষা করে আমরাই সে সময় বের করতে পারিনি। তবে হাল ছাড়ছি না। বন্ধুদের সবার সাথে জুড়েই থাকবো। জুড়ে আছিও।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments