জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২২৫/তানজানিয়া (আফ্রিকা)হাল ছাড়তে নাই/চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোকগল্প— ২২৫

তানজানিয়া (আফ্রিকা)
হাল ছাড়তে নাই
চিন্ময় দাশ

একদিন ছোট্ট দুটো মোরগ আর মুরগি বেরিয়েছি স্ট্রবেরি জোগাড় করতে। যেতে যেতে দুজনে আলোচনা করে নিল, যা ফল পাওয়া যাবে, সমান সমান দু’ভাগে ভাগ করে নেবে তারা।
হয়েছে কী, প্রথম স্ট্রবেরিটা পেল মুরগি। যেমন ফয়সালা করা আছে। মোরগকে ডেকে, দুজনে আধাআধি ভাগ করে খেল সেটা। আহা, কী মিষ্টি স্বাদ! মজা করে খেলো দুজনে।
খানিক বাদে মোরগ পেয়েছে একটা। মুরগির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে, টুক করে মুখে পুরে দিল ফলটা। এমন জিনিষের ভাগ দেওয়া যায় কখনো? মুরগিকে জানতেই দিল না কিছু। চটপট পেটে চালান করে দিতে চাইল। 
কিন্তু চালাকি করলে, যা হয়। ফল মিলে গেল সাথেসাথেই। গলায় আটকে গেল ফলটা। হাজার চেষ্টাতেও কিছুতেই গিলে ফেলা যাচ্ছে না। বেজায় ফাঁপরে পড়ে গেল বেচারা। 
গলা টানটান করে ঢোঁক গিলছে। মাথা ঝুলিয়ে দিচ্ছে সামনে একবার, তো পেছনে একবার। লাফাতে লেগেছে উপর-নীচ করে। যতো কসরৎ করা যায়, সবই করে যাচ্ছে ফলটাকে পেটে চালান করতে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। যেন গলায় গেঁথে গিয়েছে ফলটা। দম আটকে আসছে তার। ছটফট করতে শুরু করেছে মোরগ।
মোরগের দিকে চোখ পড়তে, মুরগি চমকে উঠেছে। ভয়ও পেয়েছে খুব। রীতি মতো খাবি খাচ্ছে তখন মোরগ। নিশ্চয় গলায় কিছু আটকেছে। এ সময় জল খাওয়া দরকার। জলের খোঁজে দৌড়ল মুরগি। 
খানিক দূর গিয়েছে, একটা ঝরণার শব্দ কানে এলো। ঝরণাকে গিয়ে বলল— ঝরণা দিদি, ঝরণা দিদি! আমার মোরগ ভাইয়ের ভারি বিপদ। এক আঁজলা জল দেবে তোমার?
ঝরণা বলল—তোমার ভাইয়ের বিপদ। কেন দেব না জল? তবে, এমনি এমনি তো দেব না গো। তুমি লিন্ডেন গাছের একটা পাতা এনে দাও আমাকে। জল পেয়ে যাবে।
ছোট্ট মুরগি দৌড় লাগালো লিন্ডেন গাছের খোঁজে। তাকে গিয়ে বলল—গাছ ভাই, গাছ ভাই! একটা পাতা দেবে তোমার আমাকে? 
গাছ বলল-- পাতা নিয়ে কী উপকার হবে তোমার ভাইয়ের?
মুরগি বলল-- পাতা নিয়ে গেলে, ঝরণা জল দেবে আমাকে। জল নিয়ে গেলে বিপদ কাটবে আমার ভাইয়ের। 
গাছ বলল-- তোমার ভাইয়ের বিপদ। কেন দেব না পাতা? তবে, চাষিবউরা মাথায় যে রুমাল বাঁধে, তুমি আমাকে একটা রুমাল এনে দাও আগে। তারপর পাতা নিয়ে যেও। 
মুরগি দৌড় লাগাল চাষিদের পাড়ায়। এক বউকে ডেকে বলল—একটা রুমাল দেবে আমায়? আমার ভাইয়ের খুব বিপদ। 

🍂

বউটি বলল-- রুমাল নিয়ে কী উপকার হবে তোমার ভাইয়ের?
--রুমাল পেলে, পাতা দেবে লিণ্ডেন গাছ। পাতা নিয়ে গেলে, জল দেবে ঝরণা। জল নিয়ে গেলে, বিপদ থেকে রেহাই পাবে আমার ভাই। 
বউ বলল—দেব না কেন? তোমার ভাইয়ের বিপদ বলে কথা। তবে তুমি আমাকে খানিকটা সিল্ক এনে দাও মোড়ল বউয়ের কাছ থেকে। তবে তো রুমাল দেব।
ছোট্ট একটা মুরগি। কটুকুই বা তার গায়ের জোর। ছোটাছুটি করে হাঁফিয়ে উঠেছে বেচারি। কিন্তু দমে গেলে তো চলবে না। মোরগ যে ছটফট করছে সেখানে। 
ছুটতে ছুটতে মোড়লের বাড়িতে গিয়ে হাজির।  বলল—মোড়লবউ, মোড়লবউ! আমার মোরগ ভাইয়ের ভারি বিপদ। একটু সিল্ক দেবে আমায়?
--সিল্ক নিয়ে কী উপকার হবে তোমার ভাইয়ের?
 --সিল্ক পেলে, রুমাল দেবে চাষি বউ। রুমাল পেলে, পাতা দেবে লিণ্ডেন গাছ। পাতা নিয়ে গেলে, জল দেবে ঝরণা। জল নিয়ে গেলে, বিপদ থেকে রেহাই পাবে আমার ভাই।
মোড়ল বউ মুচকি হেসে বলল—তোমার ভাই বিপদে পড়েচে? কেন দেব না সিল্ক? তুমি সুন্দর দেখে একজোড়া জুতো এনে দাও আমাকে। সিল্ক পেয়ে যাবে তখন। 
ছুটতে ছুটতে মুচির বাড়ি গিয়ে হাজির হোল মুরগি—মুচিদাদা, মুচিদাদা! আমার মোরগ ভাইয়ের ভারি বিপদ। সুন্দর দেখে একজোড়া জুতো দেবে আমায়? 
মুচি বলল-- জুতো নিয়ে কী উপকার হবে তোমার ভাইয়ের?
--জুতো পেলে, একটু সিল্ক দেবে মোড়ল বউ। সিল্ক পেলে, রুমাল দেবে চাষি বউ। রুমাল পেলে, পাতা দেবে লিণ্ডেন গাছ। পাতা নিয়ে গেলে, জল দেবে ঝরণা। জল নিয়ে গেলে, বিপদ থেকে রেহাই পাবে আমার ভাই।
মুচি বলল—আহারে, ভারি হাঁফিয়ে গেছ দেখছি। বিপদে পড়ে দৌড়ে এসেছ আমার কাছে। দেব না কেন জুতো? তবে, শুকরছানার একগোছা লোম এনে দাও আমাকে। জুতো পেয়ে যাবে।
ছুটতে ছুটতে এক খোঁয়াড়ে গিয়ে হাজির হোল মুরগি-- শুকর ভাইটি! আমার মোরগ ভাইয়ের ভারি বিপদ। তোমার এক গোছা লোম দেবে আমাকে। 
শুকরছানা বলল—আমার লোম নিয়ে কী উপকার হবে তোমার ভাইয়ের?
--লোম পেলে,  একজোড়া জুতো দেবে মুচিদাদা। জুতো পেলে, একটু সিল্ক দেবে মোড়ল বউ। সিল্ক পেলে, রুমাল দেবে চাষি বউ। রুমাল পেলে, পাতা দেবে লিণ্ডেন গাছ। পাতা নিয়ে গেলে, জল দেবে ঝরণা। জল নিয়ে গেলে, বিপদ থেকে রেহাই পাবে আমার ভাই।
সবাই জানে শুকরছানারা ভারি গোঁয়ার। সে হেঁকে উঠল— তোমার ভাইয়ের বিপদ তো আমার কী তাতে? খামোকা তোমাকে লোম দিতে যাবো কেন আমি? তবে হ্যাঁ, যদি একটা নরম ভুট্টা এনে দিতে পারো আমাকে, লোম দিয়ে দেব তোমাকে। 
আর পেরে উঠছে না মুরগিটা। হাঁফিয়ে উঠেছে বেচারি। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। ভাইকে তার বাঁচাতেই হবে। 
এবার ছুটতে ছুটতে এক খামারে গিয়ে হাজির। কতকগুলো লোক কাজ করছে খেতে। মুরগি বলল-- আমার মোরগ ভাইয়ের ভারি বিপদ। তোমরা একটা ভুট্টা দেবে আমাকে?
লোকগুলো শুনে অবাক। বলল-- ভুট্টা নিয়ে কী উপকার হবে তোমার ভাইয়ের?
-- ভুট্টা পেলে, এক গোছা লোম দেবে শুকরছানা। লোম পেলে, একজোড়া জুতো দেবে মুচিদাদা। জুতো পেলে, একটু সিল্ক দেবে মোড়ল বউ। সিল্ক পেলে, রুমাল দেবে চাষি বউ। রুমাল পেলে, পাতা দেবে লিণ্ডেন গাছ। পাতা নিয়ে গেলে, জল দেবে ঝরণা। জল নিয়ে গেলে, বিপদ থেকে রেহাই পাবে আমার ভাই।
শুনে ভারি দয়া হোল লোকগুলোর। বলল—আহারে, বিপদে পড়ে, এত ঝক্কিঝামেলা সয়ে এখানে এসেছ। নিশ্চয় দেব তোমাকে। তবে, তুমি কি একটু উপকার করে দেবে আমার? 
--বলো আমি কী উপকার করতে পারি?
--গরীব-গুর্বো মানুষ আমরা। একবার মাখন খাওয়ার ভারি সাধ। একটু মাখন এনে দেবে আমাদের? লোকগুলোর চোখেমুখে আবদার। বলল—আমাদের মালিকের বাড়িতে যাও। সেখানে মাখন পেয়ে যাবে তুমি। 
মালিকের বাড়ি পৌঁছে, তার বউকে বলল—মালকিন, আমার মোরগ ভাইয়ের ভারি বিপদ। খানিকটা মাখন দেবে আমাকে? 
মাল্কিন বলল-- মাখন নিয়ে কী উপকার হবে তোমার ভাইয়ের?
--মাখন পেলে, একটা ভুট্টা দেবে খেতের মুজুরেরা। ভুট্টা পেলে, এক গোছা লোম দেবে শুকরছানা। লোম পেলে, একজোড়া জুতো দেবে মুচিদাদা। জুতো পেলে, একটু সিল্ক দেবে মোড়ল বউ। সিল্ক পেলে, রুমাল দেবে চাষি বউ। রুমাল পেলে, পাতা দেবে লিণ্ডেন গাছ। পাতা নিয়ে গেলে, জল দেবে ঝরণা। জল নিয়ে গেলে, বিপদ থেকে রেহাই পাবে আমার ভাই। 
মালকিন বলল—এমনি এমনি কি মাখন দেওয়া যায় কাউকে? এক আঁটি ঘাস এনে দাও আমার গাইগরুর জন্য। মাখন পেয়ে যাবে তাহলে। 
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল মুরগির। এক আঁটি ঘাস জোগাড় করা কি চাট্টিখানি কথা না কি? করবেই বা কী করে? লাগবেও তো অনেক সময়! তত সময় বাঁচবে তো আমার ভাই? 
তবে, হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় সে। ছুটতে ছুটতে  মাঠে গিয়ে হাজির। বিশাল মাঠখানা। যত দূর চোখ যায়, ঘাস আর ঘাস। সবুজ ঘাসের গালিচা পেতে রেখেছেন কেউ। কিন্তু এক বোঝা ঘাস কি চাট্টিখানি কথা? সে জোগাড় করবে কী করে?
দুটো উটপাখি চরে বেড়াচ্ছিল মাঠে। তারা এগিয়ে এসে বলল—তুই আবার কে? এখানে তো দেখি না কোনদিন তোকে! 
এই বিশাল ফাঁকা মাঠে, সেও আসেনি কোনদিন। বিশাল চেহারার পাখি দুটোকে দেখে, মুরগির বুক দুরু দুরু। তবে, ভড়কে গেলে চলবে না। সাহস করে মুরগি বলল—এক আঁটি ঘাসের জন্য এসেছি আমি।, আমার মোরগ ভাইয়ের ভারি বিপদ। 
--কিছুই তো বুঝলাম না। বাইয়ের বিপদ, তো ঘাস দিয়ে কী করবি? পাখু দুটো জানতে চাইল।
মুরগি বুঝিয়ে বলল-- এক আঁটি ঘাস দিলে, মালিকের বউ খানিকটা মাখন দেবে আমাকে। মাখন পেলে, একটা ভুট্টা দেবে খেতের মুজুরেরা। ভুট্টা পেলে, এক গোছা লোম দেবে শুকরছানা। লোম পেলে, একজোড়া জুতো দেবে মুচিদাদা। জুতো পেলে, একটু সিল্ক দেবে মোড়ল বউ। সিল্ক পেলে, রুমাল দেবে চাষি বউ। রুমাল পেলে, পাতা দেবে লিণ্ডেন গাছ। পাতা নিয়ে গেলে, জল দেবে ঝরণা। জল নিয়ে গেলে, বিপদ থেকে রেহাই পাবে আমার ভাই। 
চেহারায় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় চেহারার পাখি হোল উটপাখি। চেহারাখানা বড় হলেও, ভারি দয়ালু তারা। সব শুনে, পুঁচকে মুরগিটার উপর ভারি দয়া হোল তাদের। বলল—অনেক ছোটাছুটি করে হাঁফিয়ে গিয়েছিস। বসে একটু জিরিয়ে নে। আমরা তোর ঘাসের জোগাড় করে দিচ্ছি। তার বদলে কিছু করতে হবে না তোকে।
মুরগির তো আনন্দ ধরে না। 
খানিক বাদেই এক আঁটি ঘাস এনে দিল পাখি দুটো—এই নে তোর ঘাস। এবার দৌড়ে যা মালকিনের বাড়ি। অনেক কাজ বাকি এখনো। 
ঘাসের আঁটি পেয়ে, মালকিন মাখন দিয়ে দিল। মাখন পেয়ে, আনন্দে লাফাতে লাগল মজুরেরা। তারা ভুট্টা দিয়ে দিল মুরগিকে। ভুট্টা পেয়ে, শুকরছানা বলল—নিয়ে যা একগোছা লোম। লোম পেয়েছে, সুন্দর একজোড়া জুতো ধরিয়ে দিল মুচি। মোড়লবউ সিল্ক দিল জুতোজোড়া পেয়ে। সিল্ক পেয়ে, রুমাল দিল চাষি বউ। রুমাল পেয়ে, লিণ্ডেল গাছ দিল একখানা পাতা।
পাতা পেয়ে ঝরণা তো আহ্লাদে আটখানা। তার কত দিনের সাধ ছিল এই পাতার জন্য। সে বলল—এক আঁজলা কেন রে? যতটা লাগে তোর, জল নিয়ে যা। 
জল পেয়েছে এতক্ষণে। আনন্দ ধরে না মুরগির। সে দৌড় লাগিয়েছে স্ট্রবেরি বাগানে। এদিকে মনে ভয়, কাজে লাগবে তো জল? কী জানি, বড়সড় কোনও বিপদ হয়ে গেছে কি না। 
এসে যখন পৌঁছলো, মাটিয়ে এলিয়ে পড়ে আছে মোরগ। চোখ দুটো ওলটানো। তবে, বুকের ধুকপুকুনিটা একেবারে থেমে যায়নি।  
ধড়ে প্রাণ এলো মুরগির। ফোঁটা ফোঁটা করে জল দিয়ে যেতে লাগল মোরগের মুখে। আর, ভগবানকে ডাকতে লাগল—ঠাকুর, আমার ভাইকে বাঁচিয়ে দাও। দয়া করো আমাকে।
খাইক বাদে চোখ মেলে, উঠে বসল মোরগ। 
হাল ছেড়ে না দেওয়ার ফল, হাতেনাতে পেয়ে গেল ছোট্ট মুরগিটা।

Post a Comment

0 Comments