বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫৩
রক্তচন্দন
ভাস্করব্রত পতি
'পুষ্পা নাম শুনকর ফ্লাওয়ার সমঝি ক্যায়া? ফায়ার হ্যায় ম্যায়' ---
সাম্প্রতিক সময়ে আল্লু অর্জুনের ‘পুষ্পা : দ্য রাইজ’ এবং 'পুষ্পা : দ্যা রুল' সিনেমার কাহিনি তৈরি হয়েছে রক্তচন্দন বা লালচন্দন কাঠ পাচারের ওপর ভিত্তি করে। এ ডায়লগ এই সিনেমায় রক্তচন্দন পাচারের সিণ্ডিকেটের মূল ব্যক্তি পুষ্পারাজের।
রক্তচন্দন
বাল্মীকি রামায়ণে উল্লেখ আছে- "দেহের দাহকে প্রশমন করার জন্যে গ্রীষ্মকালে শ্রীরামচন্দ্রের দেহে রক্তচন্দন মাখানো হ'তো"। হিন্দুদের পূজায় লাল চন্দন ব্যবহৃত হয়। বিশ্বাস যে, এটি অত্যন্ত পবিত্র। হিন্দুদের ধারণা — লাল চন্দন ঘরে সুখ আনে। এর নিয়মিত ব্যবহার জীবনে আনে সুখ। বৌদ্ধ তান্ত্রিকগণ রক্তচন্দনের তিলকের দ্বারা বশীকরণের কাজ করেন। বিভিন্ন সাহিত্য এবং অলঙ্কারশাস্ত্রে প্রেমিকার প্রথম প্রণয়ের চিঠি লেখার রীতি বর্ণনা করা আছে রক্তচন্দনের মাধ্যমে। এখানে সেই চিঠির অক্ষর পদ্মফুলের পাপড়িতে রক্তচন্দনের কালি দিয়ে লেখা হতো।
রক্তচন্দনের পাতা
রক্তচন্দনের বিজ্ঞানসম্মত নাম Pterocarpus santalinus Linn.f। এটি Liguminosae পরিবারভুক্ত। এছাড়াও রয়েছে Lingoum santalinum (Lf) Kuntze। আর শ্বেতচন্দনের বিজ্ঞানসম্মত নাম -- Santalum album Linn। এটি Santalaceae পরিবারের অন্তর্গত। রক্তচন্দন পরিচিত তাম্রসার, তামসারক, তিলপর্ণী, পত্রাঙ্গ, রঞ্জন, কুচন্দন, ক্ষুদ্রচন্দন, অর্কচন্দন, রক্তাঙ্গ, প্রবালফল, পত্তঙ্গ, পস্তা, রক্তবীজ নামে। এছাড়াও এই রক্তচন্দন Yerra Chandanam, Chenchandanam, Red Sanders, Red Saunders, Red Sandalwood, Rakta Chandana, হার্টউড, রুবি কাঠ, আগারু, অনুকম এবং লাল চন্দন নামেও পরিচিত। অনেকে Adenanthera pavonina Linn বা রঞ্জনাকেও রক্তচন্দন বা লাল চন্দন বলে থাকে। এটি Liguminosae পরিবারের অন্তর্গত। কোথাও কোথাও একেও রক্তচন্দনও বলে। এই গাছ ২৫ - ৩০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। এদের কাঠ থেকে ঔষধ তৈরি হয়। স্থানীয়রা একে Red Sandalwood, Coral wood, Peacock flower fence, Red beadtree বলে। এটি Fabaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কেউ কেউ মনে করেন চন্দনের আদি নিবাস ইন্দোনেশিয়ার তিমুর দ্বীপে।
'পুষ্পা' সিনেমায় রক্তচন্দনের সিন্ডিকেটের হেড পুষ্পারাজের ভূমিকায় আল্লু অর্জুন
ঋক্, সাম ও যজুর্বেদে রক্তচন্দন সম্পর্কে কোনও তথ্য মেলেনা। তবে অথর্ববেদের বৈদ্যক কল্পে এবং অন্যান্য কল্পেও এটির সম্পর্কে লেখা হয়েছে --
'কুসীদং যো নিষদনং পর্ণে বসতিস্কৃতা।
যোনিং ইৎ কিলাসং অথবত্ত সনবথ জ্বলনম্॥
(বৈদ্যককল্প ১৩।৩৯। ১৩০ সূক্ত)
মহীধর ভাষ্যে পাই --
'কুসীদং রক্তচন্দনং।
বো যুষ্মাকং নিষদনং স্থানং, যোনিং, কিলাসং = কুষ্ঠং, পর্ণে পলাশে বসতিকৃতা সনবথ জ্বলনং চ ইৎ দাহান্সিং প্রশময়সি।'
অর্থাৎ - যোনির ক্ষত ও কুষ্ঠ, গাত্রকুষ্ঠ এবং দাহের বসতিস্থলে (চর্মে) রক্তচন্দন থাকুক। তার পাতাতেও সবসময় আগুনের বসবাস রয়েছে। । অর্থাৎ রক্তচন্দনের পাতাগুলিও ঐসব স্থানের প্রদাহ প্রশমিত করে।
এখানে আছে - 'কুসীদং'। অর্থাৎ কুৎসিত স্থানে তার কর্মক্ষেত্র। তবে শুধু গোপন স্থানে নয়, পরবর্তীতে নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আয়ুর্বেদাচার্যরা রক্তচন্দনের মাধ্যমে রক্তপ্রদর, শ্বেতপ্রদর, কামজ উন্মাদ, কুষ্ঠ, বিসর্প ও বিভিন্ন রোগজ দাহের উপশম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে থাকেন। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য প্রশ্ন তুলেছেন, 'এই দাহ প্রশমনের শীর্ষ দ্রব্য হিসাবেই কি সাধকগণ সূর্যার্ঘ্য দেওয়ার সময় রক্তচন্দনকে আবশ্যিক উপচার রূপে নির্ধারণ ক'রেছিলেন'? হিন্দুদের পূজায় রক্তচন্দন মাখিয়ে পুষ্পার্ঘ্য দেওয়া হয় দেবতার পদতলে।
এটি একটি ছোট গাছ, যা উচ্চতায় ৫ - ৮ মিটার পর্যন্ত হয়। গাঢ় লাল রঙের গাছটির বড় হতে ৭ - ১২ বছর সময় লাগে। পাতাগুলো বিপরীত দিকে ৩ - ৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুলের রঙ হলুদ। বাজারে রক্তচন্দনের চাহিদা বিশাল। তাই এর নাম ‘রেড গোল্ড’। আন্তর্জাতিক বাজারে এক টন রক্তচন্দন কাঠের দাম ৮০ লাখ থেকে থেকে দু কোটি টাকা। চিন, অষ্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপানে এই কাঠের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মূলতঃ বাদ্যযন্ত্র, আসবাবপত্র এবং নানা ভাস্কর্য তৈরিতে রক্তচন্দনের চাহিদা বেশি। চিনের কিং রাজবংশের সময়কালে রক্তচন্দনের কথা বলা হয়েছে। চিনা ভাষায় একে বলে জিটান বা tzu-t'an (紫檀)। আজও চিনের কিং রাজবংশের রাজাদের ব্যবহার করা রক্তচন্দনের অতি সুন্দর এক প্রাচীন চেয়ার সংগৃহীত আছে বেজিংয়ে।
অথর্ববেদে থাকা রক্তচন্দন সম্পর্কে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন আয়ুর্বেদাচার্যরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে দেহের রোগ প্রশমনে, অলঙ্করণে এবং দেহরঞ্জনে ব্যবহার করেছে রক্তচন্দনকে। বিভিন্ন বৈদিক সূক্তের নামকরণের মধ্যেও লুকিয়ে আছে রক্তচন্দনের গুনাগুন। রক্তচন্দন ব্যবহৃত হয় antipyretic, tonic, hemorrhage, dysentery, aphrodisiac, anti inflammatory, anthelmintic, anti hyperglycaemic এবং diaphoretic উপাদান হিসেবে। রক্তচন্দনের মধ্যে যেসব কেমিক্যাল পাওয়া যায় সেগুলি হল -- (a) Glycosides (b) Colouring matter এবং (c) Marsupium।
রক্তচন্দনের ব্যবহারে রক্তপিত্ত, অনিয়মিত রক্তস্রাব, রক্ত প্রস্রাবের জ্বালা যন্ত্রনা, হাতের তালুতে চষিপোকা লাগা, দাদ বা Ringworm, প্রবল জ্বরের প্রদাহ, নুনছাল ওঠা' রোগ, দাঁতের মাড়ির রক্ত পড়া, দূষিত ঘা বা ক্ষত, কর্ণমূলের শোথ বা Mumps, বিষ ফোঁড়া, স্তনের ফোঁড়া বা ঠুনকো, মাথার যন্ত্রণা, বাতরক্ত, নাক কানের রক্তস্রাব উপশম হয়।
২০০০ সালে ভারতে রক্তচন্দন কাটা, বিক্রয় এবং রপ্তানিসহ সকল প্রকার কারবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এখন চোরাকারবারিরা ভারতের বাইরে পাচার করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করছে। সেই ঘটনাই ফুটে উঠেছে পুষ্পা সিনেমার মাধ্যমে। পুষ্পার মুখের জনপ্রিয় ডায়লগ আজ সারা পৃথিবীর পুষ্পাপ্রেমীদের মুখে মুখে -- 'পুষ্পা কো কিসি নে ফ্লাওয়ার সমঝ লিয়া থা.. উসকো সমঝাইয়ে কি পুষ্পা ফায়ার হ্যায়'।
একসময় চন্দনকাঠ চোরাকারবারির সঙ্গে যুক্ত ছিল দস্যু বীরাপ্পনও। বহু খুন অপহরণের ঘটনা ঘটেছে সেসময়। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল 'চন্দনদস্যু'। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আই ইউ সি এন) ২০১৮ সালে রক্তচন্দন গাছকে ‘Endangered species' হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং কর্নাটকের পূর্বঘাট পার্বত্য অঞ্চলে রক্তচন্দন গাছ বেশি জন্মায়। তামিলনাড়ু লাগোয়া অন্ধ্রপ্রদেশের চার জেলা নেল্লোর, কুর্নুল, চিত্তুর এবং কাডাপ্পা জেলাতে রক্তচন্দন গাছ মেলে। চিত্তুর জেলার শেষাচলম জঙ্গলে পাওয়া রেড স্যান্ডালউড বা রক্তচন্দনের কথা শোনা যায় পুষ্পা সিনেমাতেও। সেই রক্তচন্দনকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে পাচারকারী ও পুলিশের মধ্যে।
পঞ্চদশ শতকের রাজনিঘণ্ট নামের এক গ্রন্থে মেলে ছয় রকমের চন্দনের নাম। কিন্তু আজ সেসবের খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। পশ্চিমবঙ্গেও অল্প কিছু গাছ রয়েছে। তবে ইদানিং রাজ্য সরকার চেয়েছে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় মোট ৪৩ হাজার রক্তচন্দনের চারা লাগানো হবে। এখানে সাফল্য এলে ভবিষ্যতে রাজ্যের অন্যত্র রক্তচন্দনের চারা লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এই মুহূর্তে আরাবাড়ি রিজার্ভ ফরেস্ট, বিষ্ণুপুর, হিড়বাঁধ এবং মানবাজারের প্রতিটিতে প্রায় ১১ হাজার করে রক্তচন্দন চারা এবং ৫৫ হাজার শ্বেতচন্দনের চারা বিষ্ণুপুর, হিড়বাঁধ, আরাবাড়ি ও বীরভূমের সিউড়ির লাগোয়া জঙ্গলে। এই মুহূর্তে সারা ভারতে মাত্র ৫ শতাংশ রক্তচন্দন গাছ অবশিষ্ট রয়েছে। 'দেবী' কবিতায় জনি কর্মকার লিখেছেন --
'দেবী তোমার আরাধনায় মগ্ন
আমি এক অধম পূজারী।
রক্তচন্দন ধুতরা ফুলে যদি না পাই মন
তবে কিসে পূজিবে তোমারে? কহ কথা দেবী!'
🍂
0 Comments