জ্বলদর্চি

মুকুটমণিপুর /সাগুন টুডু


মুকুটমণিপুর
             
সাগুন টুডু 


পুজোর সেই একদিন, ষষ্ঠী নয়, বিজয়া নয়—ঠিক দুর্গাপূজার মাঝখানে, সবাই মিলে ঠিক করা হল ছোট্ট একদিনের বেড়াতে যাওয়া হবে। কোথায় যাবে? পছন্দ হল মুকুটমনিপুর। নদী, ড্যাম, বাতাস আর ছবি তোলার জন্য দারুণ সব স্পট। হোটেলে থাকা নয়, খাওয়াদাওয়া-সহ সকাল-সন্ধ্যার ছোট্ট এক অভিযান। গাড়ি ভাড়া করা হল—মিনিবাস নয়, ছোট ক্রুইজার গাড়ি।

সকাল সকাল বেরোনোর হইচই

সাগুনের মা ব্যস্ত হয়ে দৌড়চ্ছেন ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।

“সাগুন! দুধটা গ্যাসে রেখে এসেছিস তো? বাড়ি ফিরে পুড়ে গেলে মিষ্টি মুড়ি সব চুলোয় যাবে।”

সাগুন বিরক্ত হয়ে বলল, “মা! এবার একটু ছাড়ো তো! ঘুরতে যাচ্ছি, রান্নার ভাবনা বাদ দাও।”

দুই পিসিমা তখন ব্যাগ গোছাচ্ছেন। এক পিসি বললেন, “দিদি, লুচি এনেছ তো? না হলে আমি জানি কার মুখ ঝামটা খাবে দুপুরে।”

মা মুচকি হেসে বললেন, “লুচি এনেছি, সুজয়া আর সুপ্রিয়া তো খিদেতে হায়েনা হয়ে যাবে।”

সিলিকা পাশ থেকে বলে, “আর আমার চাটনির কথা ভুললে কিন্তু ঝামেলা হবে।”

সবাই গাড়িতে উঠল—সামনে পিসেমশাই, পিছনে বাকিরা। সিট নিয়েও শুরু হল ঠেলাঠেলি।

“আমাকে জানলার পাশে দাও,” বললেন এক পিসি। “তুমি জানলার পাশে গেলে আমি কোমর ধরে বসে থাকব!” আরেক পিসি উত্তর দিলেন।

🍂
ad

শেষমেশ সিলিকা বলল, “আমি মাঝখানে থাকি, তোমাদের দুই দিদির ঠাণ্ডা যুদ্ধ বন্ধ করাই ভালো।”

গাড়িতে উঠবার সময় সুপ্রিয়া দিদি তাঁর ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে উঠলেন। সে এখনো কথা বলতে শেখেনি, কিন্তু চোখে মুখে ছিল অসীম কৌতূহল। কখনো জানালার বাইরে তাকাচ্ছে, কখনো সাগুনের ক্যামেরার দিকে চেয়ে থাকছে।

পথের মজা, পথের গান

গাড়িতে উঠেই পিসেমশাই গান ধরলেন।

“এই পথ যদি না শেষ হয়...”

সুজয়া বলল, “বাবা, তুমিই একমাত্র যিনি গান গাইলে সবাই চুপ করে যায়—কে হেসে, কে ঘুমিয়ে পড়ে বোঝা যায় না!”

সুপ্রিয়া হেসে উঠল, “তোমার গলার একটা রিল বানিয়ে ইনস্টাতে দিলেই ভাইরাল!”

সাগুন তার প্রিয় DSLR নিয়ে সামনে বসে সব documenting করছে। মা একবার বললেন, “দেখিস, ঘোরার থেকে ছবি তোলায় বেশি সময় খরচ না হয়!”

সাগুন হাসল, “এই ট্রিপটা আমিই ফ্রেমে বাঁচিয়ে রাখব!”

ড্যামের ধারে-

মুকুটমনিপুর পৌঁছে সবাই মুগ্ধ। বাতাস, জল, আলো—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব আবহ।

সাগুন ক্যামেরা নিয়ে লাফাচ্ছে, “এই জায়গাটা! সিলিকা দাঁড়াও তো, পেছনে জল, সামনে তুমি—সুপার ফ্রেম!”

পিসেমশাই এক পাথরে বসে ভাবুক মুখে।

সুজয়া বলল, “বাবা, তুমি আবার কবি হয়ে বসেছ?”

পিসেমশাই হেসে বললেন, “ভাবছিলাম, তোমরা কত বড় হয়ে গেছো। ছোটবেলায় এইরকম দিন কল্পনাও করতে পারতাম না।”

সুপ্রিয়া পাশে বসে বলল, “এইরকম দিনগুলো থাকুক—ছবি ছাড়া, মনেও।”

সাগুন তখন কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে, সবার candid খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ একটা ছবি তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল।

সিলিকা হেসে বলল, “ফটোগ্রাফারের নিজেই ছবি হল এবার!”

তারপর শুরু হল ভাই-বোনেদের মধ্যে ছবি তোলার হিড়িক।

সুজয়া বলল, “এইবার আমার একটা পোজদার ছবি তুলবি।” সুপ্রিয়া বলল, “না না, আমারটা আগে! আমি ঠিক সানগ্লাস পরে দাঁড়াব, যেন নায়িকা!”

সিলিকা সেগুলো দেখে বলল, “তোমরা দুজনেই যদি নায়িকা হও, আমি তো এক্সট্রা হয়ে গেলাম!”

সাগুন ঘেমে গিয়ে বলল, “একটু দাঁড়াও! আলো পাল্টে যাচ্ছে, সবাই একসাথে দাঁড়াও তো—এইবার ক্লিক!”

সবার হেসে কুটিকুটি, ক্যামেরার সামনে ছোটখাটো নাটকই চলল যেন।

সুপ্রিয়ার ছোট্ট মেয়েটাকেও সবাই কোলে কোলে ধরে একাধিকবার ছবিতে ঢুকিয়ে দিল—সে একবার মায়ের কোল, একবার সিলিকার কাঁধে। সে শুধু ফোটোশুটে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে কখনো হাসছে, কখনো গম্ভীর মুখে ক্যামেরা দেখছে। যেন এক পুঁচকে মডেল!

একবার তো সে সবাই ব্যস্ত থাকার ফাঁকে লুচির বাক্স খুলে লুচি হাতে নিয়ে বসে পড়েছিল। খাচ্ছিল না, শুধু গোল লুচির দিকে তাকিয়ে ছিল এমনভাবে, যেন বুঝতে পারছে—এই গোলজিনিসটা নিয়ে বড়দের এত উৎসাহ কেন! তারপর নিজের মতন একটা কাগজের টুকরো খুঁজে নিয়ে সেটাকেই মুখে ঢুকিয়ে বসে, আর সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়।

খাবারের হইহই-

দুপুরের খাবারে লুচি, চাটনি, নাড়ু, মিষ্টি সব বেরিয়ে পড়ল।

“এই লুচি কার জন্য রেখেছিলাম?” বললেন মা। “আমার জন্য!” চেঁচিয়ে উঠল সুপ্রিয়া।

পিসি বললেন, “ছোটবেলায় যা খিদে ছিল, এখনো কমেনি দেখি!”

সিলিকা বলল, “এই চাটনি খেয়ে বাড়ি ফিরে আর বানাব না।”

সাগুন ক্যামেরা নিয়ে সবার চারপাশে ঘুরছে। “একটু বসো না! সবাই একসাথে—এই, পোজ দাও!”

মা বললেন, “এই ছেলেটা সারাদিন ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ঘুরে, নিজে খাচ্ছে কবে কে জানে!”

সাগুন হাসল, “খাবার তো ফ্রেমে নিলেই মনে রাখা যায়, খেতে হবে কেন?”

ফেরা পথে নীরবতা-

গাড়িতে ফেরার সময়, সূর্য ডুবছে। বাতাসে একটা ক্লান্তি, কিন্তু মন ভরা।

সুজয়া বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুপ্রিয়া গান চালাচ্ছে ফোনে, আর তার মেয়েটি তখনো বড় বড় চোখে চারপাশ দেখছে—আলো, ছায়া, রং… সব তার ছোট্ট মনে জমা হচ্ছে চুপিচুপি। কখনো হাত বাড়িয়ে বাইরের পাতা ছুঁতে চাইছে, কখনো জানালার কাচে নিজেকে দেখে মুচকি হাসছে। কথা বলতে না পারলেও, তার অভিব্যক্তিতেই যেন একটা ভাষা।

পিসেমশাই গুনগুন করে গাইছেন, “সেই সময়ে পথ চলা যায়, মনে থাকে না সেসব ঠিকানা...”

সাগুন ক্যামেরা নামিয়ে বলে, “এই ছবিটা তোলার দরকার নেই। এইটা মনে রাখলেই হবে।”

শেষে মা জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এইরকম দিন আবার আসবে তো?”

পিসিমা বললেন, “আসবে না কেন? শুধু প্ল্যান যেন আবার সবাই মিলে হয়!”

সবাই হেসে উঠল। আর গাড়ির জানলা দিয়ে পেছনে পড়ে রইল মুকুটমনিপুর—স্মৃতির মতো ধরা, ছবির মতো স্থির। গাড়ির মধ্যে, মুকুটমণিপুরের পথে

পিসেমশাই
— “এই GPS টা ঠিকমতো কাজ করছে তো? আমার মনে হচ্ছে ভুল রাস্তায় চলে এসেছি।”

সুপ্রিয়া দিদি (সামনের সিটে বসে ফোনে তাকিয়ে):
— “আরে বাবা, আমি তো আগেই বলেছিলাম বাঁ দিকে নিতে। কিন্তু আপনি তো সবসময় আমার কথার চেয়ে গুগলকে বেশি বিশ্বাস করেন।”

পিসেমশাই (আঁতকে উঠে):
— “তুই তো একখানা আইফোন নিয়ে ঘুরিস, ভাব যেন স্টিভ জবস্ নিজে! তোকে বিশ্বাস করলে তো আমরা হাওড়া পৌঁছে যেতাম মুকুটমণিপুরের বদলে।”

সুপ্রিয়া দিদি (হালকা হাঁফ ছেড়ে):
— “আর আপনি তো গাড়ি চালাতে চালাতে গান গেয়ে ভাবেন নিজেই GPS! ‘পথে এলো কে’ বলে শুরু করলেন, শেষে রাস্তা ছাড়িয়ে জঙ্গলে নিয়ে যাবেন না তো?”

(পেছনে বসে সিলিকা আর সুজয়া মুখ চেপে হাসছে, আবার একটু ভয়েও)

সিলিকা (চুপিচুপি):
— “এই জিনিস শুধু আমাদের পরিবারেই হয়। রাস্তাঘাট, গান আর ইগো – ত্রিকোণ ভালোবাসা।

Post a Comment

1 Comments