জ্বলদর্চি

যেসব কথা লেখা হয় না /পর্ব- ৭/সুমনা সাহা


যেসব কথা লেখা হয় না

পর্ব- ৭

সুমনা সাহা

ববি-পিসি, রঞ্জু-মাসি আর নীলা-দিদি, তিনজনেই সেসময় আইবুড়ো, মানে বিয়ের ক্যান্ডিডেট। সবার বাড়ি থেকেই এই আইবুড়ো মেয়েদের বিয়ের দেখাশোনা চলছে। নীলাদি খুব সুন্দরী। রঞ্জু-মাসির গায়ের রঙ ছিল সাহেবের মত আর লম্বাও প্রায় ৬ ফুটের কাছাকাছি। ওরা সবাই কাছাকাছি বয়সের। আমার ববি-পিসির গায়ের রঙ খুব কালো না হলেও শ্যামবর্ণা। স্বাস্থ্যও মোটার দিকে ঘেঁষা। পিসির মাথার চুল ছিল অসম্ভব কোঁকড়া, সবসময় এলোমেলো হয়ে থাকত। মা মাঝেমাঝেই পিসির চুলে তেল মাখিয়ে বিনুনী বেঁধে দিত আর বলত, “এই মেয়ে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে, নিজের চুল বাঁধতে জানে না। লোকে কি বলবে?” আমাদের আদরের পিসিমণিকে কেন কারো পছন্দ হচ্ছে না, আমরা ভেবেই পেতাম না। ওদিকে নীলার বিয়ে পাকা হয়ে গেল। পিসিমণির খুব মনখারাপ। মেজ-পিসি এসে পিসিমণিকে শিবের বার করার পরামর্শ দিল। তাতে ওজনও কমবে আর শিবের বরে ভাল বরও জুটবে। পিসি শিবরাত্রি করবে, তো আমরাও করব। কোনও কথা শুনব না। বড়রা যতই বলে, ছোটদের এসব করতে নেই, আমার জেদ তত বেড়ে যায়। শেষে বাবা বলল, “আচ্ছা করুক না চাইছে যখন। ববির সাথে ওরাও ফল খাবে আর দুধ সাবু খাবে, আর আমরা ইলিশ মাছ ভাজা খাব ওদের  দেখিয়ে দেখিয়ে।” আমাকে তবুও টলানো গেল না। আর আমি উপোস করব মানে বোন তো করবেই। আবার নির্জলা উপবাস করব। তখন আমার বয়স পাঁচ বছর, আর বোনের তিন, সেজ বোনের বোধহয় সবে জন্ম হয়েছে। সেই শিবরাত্রি করার শুরু। পিসিমণির বিয়ে হয়ে গেল শিবরাত্রি করে, শিবের মতোই বর পেয়েছিল বটে, দীর্ঘদেহী, ধবধবে ফর্সা রঙ, কিন্তু বড়রা আড়ালে যেটা বলাবলি করত, সেটা হল ‘অকম্মার ঢেঁকি!’ চুক্তি হয়েছিল, বড়লোকের বেকার ছেলেটিকে বাবা একটা চাকরি জোগাড় করে দেবে। সেটি হয়ে ওঠেনি, ফলে প্রতিশোধস্বরূপ, পিসিমণির বাপের বাড়ি আসা ওরা বন্ধ করে দিল। বাড়িতে এই নিয়ে শক্তিশেল বাণের মত একটা গভীর বেদনা মা-বাবাকে শেষ দিন পর্যন্ত বুকে লালন করে যেতে দেখেছি। 


🍂
ad

আমার শিবরাত্রি করার কথা মনে পড়লেই ছোটবেলায় বালানন্দের মন্দিরের কথা মনে পড়ে। বাড়ির কাছেই হাঁটা পথে ছিল সেই মন্দির। মন্দিরে বিরাট শিবলিঙ্গ। মন্দিরের সামনে একটা পুকুর। খুব শান্ত নিরিবিলি একটা বাগান ঘেরা জায়গা। বিকেল বেলা প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে ঐ পুকুরের ধারে গিয়ে বসে থাকতাম। প্রত্যেকটা পুকুরের আলাদা আলাদা চরিত্র ছিল আমার মনের ভিতরে। সময়ের হিসেব মনে নেই। কিন্তু যখন আধুনিক শিক্ষালয় থেকে বারুইপাড়ায় রামকৃষ্ণ-সারদা মিশনে ভর্তি হয়েছিলাম, অনেক স্তব-স্তোত্র শিখেছিলাম। স্তোত্রের আলাদা একটা ক্লাস হত। শিবরাত্রির দিন মন্দিরে গিয়ে সুর করে গাইতাম, ‘নগেন্দ্র হারায় ত্রিলোচনায়, ভস্মাঙ্গরাগায় মহেশ্বরায়, নিত্যায় শুদ্ধায় দিগম্বরায়, তস্মৈ ন কারায় নমঃ শিবায়’ কিম্বা ‘প্রভুমীশমনীশমশেষগুণম্ গুণহীনমহীশগরাভরনম্ রণ নির্জিত দুর্জয় দৈত্যপুরম্ প্রণমামি শিবম্ শিব কল্পতরুম্’, বা ‘পশুনাং পতিম্ পাপনাশং পরেশং গজেন্দ্রস্য কৃত্তিং বসানং বরেণ্যম্, জটাজূটমধ্যে স্ফুরদ্ গাংগ্যবারিম্ মহাদেবমেকং স্মরামি স্মরারিম্’, সমবেত লোকজন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত, “আরে এতটুকু মেয়ে উপোস করেছে আর এমন সুন্দর শিবের ভজন গাইছে!” এই যে স্মৃতি থেকে লিখে ফেললাম আজ এতবছর পরেও, শৈশবে মাথায় ঢুকে গেলে এমনই হয়। যাইহোক, সন্ধ্যা হলেই মা আসত, আমাদের নিয়ে যেতে। এসে দেখত সবাই আমাকে ঘিরে বসে গানের ফরমায়েস করছে আর ধন্য ধন্য করছে। আমিও প্রচণ্ড গ্যাস খেয়ে গান গেয়ে চলেছি। রাত্রে এক সময় বোন ঘুমিয়ে পড়ত। আমি জেগে বসে থাকতাম, মন্দিরে শুনে এসেছি, সারা রাত জাগতে হয়। পরে শিবরাত্রির দিন বিকেলে মা আমাদের মামাবাড়িতে নিয়ে যেত। তখন মেজমামা দিদিমা আর ছোটমাসিকে নিয়ে সপরিবার দমদমে থাকে। মামার মেয়ে আমাদের প্রায় সমবয়সী। সেও আমাদের তালে তাল মিলিয়ে উপোস করার বায়না ধরত। মামাবাড়ির আজীবন সদস্য বাংলাদেশ থেকেই সঙ্গে নিয়ে আসা ভানুমাসি আমাদের বুঝিয়েছিল, “দ্যাখ, আমি কিন্তু সব নিয়ম জানি। প্রথম প্রহরে জল দিয়ে আলো চালের ভাত, আলু কাঁচা কলা সিদ্ধ সোন্দক (সৈন্ধব) লবণ দিয়ে খাওয়া যায়। তাতে দোষ হয় না।” সেবার আমি রাজি হয়েছিলাম ভানুমাসির কথায়। কারণ মামাবাড়িতে সেইকালেই সাদাকালো একটা টিভি ছিল। আর রাত্রে সেদিন শিবশক্তি বা সতীর দেহত্যাগ এইরকম একটা নামের বাংলা সিনেমা দেখাবে। দূরদর্শন কেন্দ্র একটাই ছিল, ন্যাশনাল। শুধু রবিবার রিজিওনাল চ্যানেলে বাংলা সিনেমা দেখা যেত। ভানুমাসি বলত ‘বাংলা বই’। তা সেই বাংলা শিবের বই রাত জেগে দেখতে পারব না, যদি দুমুঠো ভাত না খাই। সেই কথা ভেবে কনসিডার করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল দুই বোনই ঘুমিয়ে পড়েছে, জেগে আছি কেবল আমি আর ভানুমাসি। দিদিমা সকালে উঠে বলল, “বাবা! মাইয়েডার কী জেদ! সারা রাত্তির জাগলো!”    

নীলার মা আবার আমার মায়ের মাসিমা। এই মাসিমাকে আমরা সামনে ঠাকুমা আর আড়ালে বিনীর মা বলতাম। বিনী তার বড় মেয়ে। বড়মেয়ের নামেই তিনি পাড়ায় বিখ্যাত ছিলেন। তার একটা কারণ আছে। ঠাকুমার ছোট ছেলে পাপ্পু ছিল আমাদের খেলার সাথী। যেদিন পাপ্পুর জন্ম, সেই দিনই বিনীর একটি মেয়ে হয়েছিল। পুত্র ও নাতনীর একই দিনে জন্ম বলে পাপ্পুকে আড়ালে আমাদের বড়দা ও তার ডেঁপো বন্ধুরা ‘নাতি’ নাম দিল। কিন্তু ছোট বাচ্চার পিছনে লাগা যায় না। তার তো কোন বোধ বুদ্ধিই হয়নি। ফলে পাপ্পুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, গাপ্পুকে খেলার মাঠে ‘নাতি’ ‘নাতি’ ডেকে সবাই অস্থির করে তুলল। এই নাতির অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রত্যেকদিন তরতাজা গুল মারা। তার প্র্যাকটিকাল জোকস-এর ঠ্যালায় পাড়ার অনেকেই বিভ্রান্ত হতো। যাই হোক, বিনীর মা রোজই আমাদের ঘরে একবার আসতেনই। আঁচলে লুকানো থাকত একটা ছোট কাপ। কোনদিন এক কাপ চিনি, কোনদিন চায়ের জন্য একটু দুধ, কোনদিন মুসুর ডাল এইরকম কিছু না কিছু চাইতে আসতেন। চাইতেন ভারি সুন্দর করে—“এই দেখো না, ছেলেটা হঠাৎ বায়না ধরেছে পায়েস খাবে। এখন ঘরে নেই এতটুকুও চিনি। তাই ভাবলাম তোমার কাছ থেকে একটু নিয়ে যাই। ও-বেলা বিনীর বাবাকে বলব নিয়ে আসতে, তখন ফেরত দিয়ে যাব।”

মা বলত, “আরে না না, এইটুকু চিনি আবার ফেরত দেওয়ার কি আছে?” 

এইরকম শুনতাম। উনি এলেই আমরা উঁকিঝুঁকি দিতাম, দেখার জন্য, কাপটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে? ওটা কখন বের করবে? এখন মনে হয়, আসলে কিছু চাইতে আসাটা ছিল ওঁর একটা ছুতো। আসল উদ্দেশ্য আড্ডা দেওয়া। শুধু মায়ের সঙ্গে আড্ডা নয়, আমরা, মানে কচিদের প্রাণে বিস্ময় জাগানোটাও উনি উপভোগ করতেন। এটা যে সময়ের কথা, তখন আমরা গল্পের বই পড়া আরম্ভ করেছি। আমাদের কাছে যেসব বই বা পত্রিকা পড়া নিষিদ্ধ ছিল, তার মধ্যে একটা ছিল ‘নবকল্লোল’। সেটা ওদের বাড়িতে আসে। কথার ফাঁকে শুনিয়ে রাখতেন। আমরা ওদের বাড়িতে গেলেই নবকল্লোল গিলে খেতাম। আর ছিল ‘প্রসাদ’ আর ‘উল্টোরথ’। পত্রিকায় সিনেমা আর্টিস্টদের ছবি দেখতাম মুগ্ধ বিস্ময়ে। ছবির সঙ্গে থাকত সুন্দর সব ক্যাপশন, যেমন- সুমিত্রা চট্টোপাধ্যায় আর জর্জ বেকারের হাসিমুখের ছবি, সুমিত্রা বলছে ‘এই বেকারের নামটা লিখে নিন তো এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের খাতায়!’ তো এই বিনীর মা-কে আমরা যখন ঠাকুমা রূপে পাই, তখন তাঁর বিবাহযোগ্যা তিন কন্যা—নীলা, ইলা আর জবা। নীলাদি সবচেয়ে সুন্দরী। ইলাদি একটু কোল কুঁজো। আর জবাদির হাইট কম। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই যথেষ্ট সুন্দরী, অন্তত আমাদের চোখে। নীলাদি পিসিমণির বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। তার বিয়ে হয়ে গেল পিসিমণির আগে। বিয়েতে আমরা খুব হৈ হৈ করলাম। নেমন্তন্ন খাওয়া পর্ব চলল প্রায় সাত দিন ধরে। আইবুড়ো ভাত থেকে শুরু করে বোধহয় দ্বিরাগমন পর্যন্ত। আমাদের পিসিমণিরও বিয়ে হয়ে গেল। এবার ইলার বিয়ে দেওয়ার পালা। তার পাত্র কিছুতেই পাওয়া যায় না। আমরা একের পর এক পরীক্ষা পাশ করে উঁচু ক্লাসে উঠছি। কিন্তু ইলাদি তখনও আইবুড়ো। বিনীর মা আমার মা-র কাছে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, “এখন আর বাছবিছ করি না। যে কোন সম্বন্ধ আসে, ভাল ঘর হলে তাতেই রাজি। শুধু আমার ইলার একটাই দাবি। ছেলে যেন লম্বা হয়।” ঠাকুমার ভাষায় ‘লাম্ফা’। তা ইলাদির ‘লাম্ফা’ বর আর পাওয়া যাচ্ছে না। মা বলত, “ইলা তো ঠিকই বলে। ওর হাইটের সঙ্গে মানানসই হতে হবে তো?” ইলাদির হাইট সাধারণ বাঙালি মেয়েদের থেকে একটু বেশিই ছিল। অবশেষে বহু খোঁজাখুঁজি, মেয়ে দেখতে আসা পর্ব মিটল, একটা পাত্র ঠিক হল। বিনীর মা মুখ কালো করে বলে গেল, “সবই ঠিক আছে, কিন্তু ছেলে তত লাম্ফা না।” আমার মা বলল, “আহা ঐ একটাই তো চাওয়া ছিল মেয়েটার!” ঠাকুমা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কি আর করা? যার যেমন কপাল! বয়স্থা হচ্ছে মেয়ে। আর কতদিন বসিয়ে রাখব?” 

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মেয়ের মায়ের মানসিকতা এরকমই ছিল। যাই হোক। অবশেষে ইলাদির বিয়ে। আমরা প্রত্যেকটা ঘটনার সাক্ষী। সাজাতে এসেছে ইলাদিকে, সেখানেও আমরা। নেমন্তন্ন খাওয়া হয়ে গেল। অনেক রাত হয়ে গেল। বর আসেনি। জেগে বসে আছি। বিয়ের লগ্ন অনেক রাত্রে। আমরা তখন নিতান্তই বালিকা। মা বকাবকি করে ঘরে নিয়ে এল। “কখন বর আসবে তার নেই ঠিক, সারা রাত জেগে বসে থাকবি নাকি? সকালে গিয়ে বর দেখবি। এখন ঘুমিয়ে পড়।” সকালে উঠে কোনরকমে দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে ছুটেছি ইলাদির বরকে দেখতে। গভীর রাত্রে বিয়ে হয়েছে। তাই সেভাবে বাসর জাগেনি কেউ। সবাই ক্লান্ত। ঘুমাচ্ছে। চলে এলাম। সন্ধ্যাবেলা বরের বাড়িতে চলে যাবে ইলাদি। আমরা সেদিন স্কুলে গেলাম। স্কুল থেকে ফিরেই দেখলাম ইলাদিকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়ার গাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। কোনরকমে একটু খেয়ে আমরা আবার ছুটলাম ইলাদিকে দেখতে। এবার ইলাদির নতুন বরকে একদম সামনে থেকে দেখলাম। খুব বেঁটে আর রুগ্ন চেহারা। দেখেই মনে হল, কোন অসুখে ভুগছে। ওই অল্পবয়সেও কেমন করে যেন সেটা বুঝে গিয়েছিলাম। ইলাদির সিঁথির জবজবে সিঁদুর কপালে নাকে মাখামাখি। সোনার গয়না আর বেনারসী শাড়িতে কী যে সুন্দর লাগছিল তাকে! ঠিক দেবীর মতো! গাড়িতে উঠে সে কী কান্না ইলাদির! আজকাল মেয়েরা হাসতে হাসতে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। আমরা কিন্তু ছোটবেলায় যত বিয়ে দেখেছি, সব কনেদের কাঁদতে দেখেছি। আমরাও খুব কাঁদলাম। সব কাজ মিটে গেলে বিনীর মা, আমাদের প্রিয় ঠাকুমা আমাদের ঘরে এসে খুব এক চোট আড্ডা দিয়ে বুক খালি করে গেল। পরে ইলাদি এল বরের সঙ্গে দ্বিরাগমনে। তখন তার আর দুঃখ নেই। বরং বরের চেয়ে যে ওর হাইট একটু বেশি, তাই নিয়ে দুজনের মধ্যে রঙ্গ রসিকতাও চলছে। ইলাদির হাসিখুশি মুখ দেখে খুব ভাল লাগলো আমাদেরও। যাক, লাম্ফা বর নাই বা হল, দুজনের মধ্যে ভাব তো হয়েছে?       

(ক্রমশ)    


Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete