জ্বলদর্চি

স্বর্ণ চিত্রকর (পটশিল্পী, নয়া, পিংলা)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫৮
স্বর্ণ চিত্রকর (পটশিল্পী, নয়া, পিংলা) 

ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম নয়া (পিংলা) থেকে তাঁর স্বপ্নের উড়ান। রঙ তুলির জড়ানো ভালোবাসায় তিনি এক অনন্য পটশিল্পী। পটচিত্র নিয়ে কাজ করা স্বর্ণ চিত্রকর হলেন মুষ্টিমেয় পটুয়াদের মধ্যে একজন, যিনি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি ব্যবহার করে শতাব্দীপ্রাচীন এক পারিবারিক লোকশিল্পকলার ধারা জিইয়ে রেখে নিজের শৈল্পিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন দেশ থেকে বিদেশে। সম্পূর্ণ নিজের দক্ষতা এবং কাজের প্রতি অনুরাগ, তাঁকে একজন কর্মঠ শিল্পী বানিয়েছে। 
নিজের বাড়িতে কাজে ব্যস্ত স্বর্ণ চিত্রকর

এক সময় মেয়েদের পট আঁকার অনুমতি ছিলনা। এই ধারা ভেঙেছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারজয়ী বিখ্যাত পটশিল্পী গৌরী চিত্রকর। এরপর দুঃখুশ্যম চিত্রকর সেই ধারা বজায় রেখে মহিলাদের পটচিত্র আঁকতে উৎসাহিত করতে শুরু করেন। তার ফলেই তিনি আজ পটশিল্পী হতে পেরেছেন। 

ছোটবেলায় বাবা অমর চিত্রকরের কাছে শিখেছেন পটচিত্র অঙ্কনের প্রাথমিক কারিকুরি। এরপর নিজের কাকা তথা আরেক পটশিল্পী দুঃখুশ্যাম চিত্রকরের কাছে শিখেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ কাজ। একজন মহিলা হয়েও পুরুষদের সঙ্গে একাসনে বসে পটচিত্র আঁকার কঠিন কঠোর কাজ যখন করতে শুরু করেন, তখন কি তিনি জানতেন একসময় এই পটচিত্র তাঁকে পরিচিতি দেবে, সম্মান দেবে, অর্থ দেবে? আজ তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠিত পটশিল্পী। একাধারে শিল্পী, অন্যদিকে পটচিত্রের প্রশিক্ষক। নতুন শিল্পীদের হাতে ধরে শিখিয়ে দিচ্ছেন পটচিত্র অঙ্কনের হাজারো নিয়মকানুন। 
বিদেশীদের সাথে স্বর্ণ চিত্রকর

তিনি তাঁর কাজে ১০০ শতাংশ প্রাকৃতিক রঙ্গক ব্যবহার করেন। তিনি কুঁদরি ও সীমপাতা পাতা থেকে সবুজ, গুঁড়ো জাফরান ও হলুদের কন্দ থেকে হলুদ, পোড়া ধানের শীষ ও চারকোল থেকে কালো ও ধূসর, অপরাজিতা ফুল থেকে উজ্জ্বল নীল, লটকন বীজ থেকে লাল, কুসুম মাটি থেকে সাদা, সেগুনের পাতা থেকে বেগুনি রঙ তৈরি করে ছবি আঁকেন। প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহারের ফলে ছবি সবসময় উজ্জ্বল থাকে বহু বছর ধরে। কোনও কেমিক্যাল আঁঠা ব্যবহার করেন না। পোকামাকড় থেকে রক্ষা করতে বেলের আঁঠা ব্যবহার করেন। এসবই তিনি শিখিয়ে দেন পটচিত্র শিখতে আসা শিল্পীদের। পৌরাণিক, আধুনিক, সামাজিক পটের গঠনশৈলী এবং রূপরেখা তাঁর করতলগত। সেসব বিবরণ তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে বিলিয়ে দেন প্রতিটি শিবিরে। আর নিজে একটার পর একটা শিল্পসুষমাপূর্ণ কাজ উপহার দিয়ে চলেছেন দেশবিদেশের শিল্পরসিকদের। 

এই মুহূর্তে তাঁর বাড়ির মোট ছয়জন পটচিত্রের কাজে যুক্ত। স্বর্ণ চিত্রকরের স্বামী শম্ভু চিত্রকর সহ সমীর চিত্রকর, রুনা চিত্রকর, ঝুমুর চিত্রকর এবং নুপুর চিত্রকর রঙ তুলি দিয়ে নানা ধরনের পটচিত্র তৈরি করছেন। স্বর্ণ চিত্রকররা মোট ছয় ভাইবোন। বাবলু চিত্রকর, স্বর্ণ চিত্রকর, মনু চিত্রকর, আনোয়ার চিত্রকর, সানোয়ার চিত্রকর এবং সালমা চিত্রকর। প্রত্যেকেই এই কাজে আজ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। 
আমেরিকার সান্টা ফে'তে দেওয়া রূপবান চিত্রকরের (স্বর্ণ চিত্রকর) সার্টিফিকেট

স্বর্ণ চিত্রকর তাঁর সৃজনশীলতা এবং গতিশীল কাজের অভিব্যক্তির কারণে আলাদা হয়ে উঠেছেন অন্যদের চেয়ে। তিনি তাঁর কাজে নির্বিঘ্নে মিশিয়ে দিয়েছেন আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যকে। ফলে তাঁর কাজ দেশের সমসাময়িক শিল্পের একেবারে শীর্ষে। তিনি কেবল একজন লোকশিল্পী নন, তিনি লোকশিল্পের ছাঁচ ভেঙে আধুনিকতার মোড়কে উপস্থাপন করেছেন পটচিত্রের ঘরানাকে। তিনি সিআইএমএ গ্যালারীর (সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল মডার্ন আর্ট) তালিকায় থাকা বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছেন আজ। 

২০০৩ সালে স্বর্ণ চিত্রকর তাঁর ভাইয়ের সাথে একটি লোকশিল্প উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য সুইডেনে যান। সেখানে তিনি ৯/১১ এর ঘটনা নিয়ে একটি ছবি আঁকেন। বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিকের উপরেও কাজ করেছেন। নিউ মেক্সিকোর সান্তা ফে-তে অবস্থিত আন্তর্জাতিক লোকশিল্প জাদুঘরেও প্রদর্শনী করেছেন এবং ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ২০০৮ সালের সোথবির নিলামে স্বর্ণ চিত্রকরের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল। 
বাড়ির সবাই একসাথে পটচিত্র অঙ্কনে মগ্ন

পটচিত্রের সুবাদে তাঁকে দেশের বিভিন্ন শহর ছাড়াও যেতে হয়েছে বিদেশেও। তিনি চারবার প্যারিস, দুবার লণ্ডন ছাড়াও গিয়েছেন হুইস্টন, ওয়াশিংটন, বোস্টন, সান্টা ফে, ডিমই, ইটালি, জাপান, সুইডেন, জার্মানি গিয়েছেন। স্বর্ণের বড় মেয়ে পটচিত্রের জন্য তিনবার আমেরিকা, দুবার প্যারিস এবং একবার করে জার্মানি, ডেনমার্ক, ইটালি, বাহরিন গিয়েছে। আর মেজ মেয়ে সোনালী গিয়েছে মাসকট, জার্মানি, হংকং এবং জাপান। মোট পাঁচ মেয়ে। প্রত্যেকেই যুক্ত পটচিত্রের সাথে। 
Crafts Council of Telengana থেকে সম্মান (২০২৩), সিল্ক রিভার সম্মাননা (২০১৭), West Bengal State Academy of Dance, Drama, Music and Visual Arts এর বিশেষ সম্মান (২০০২), ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় মানব সংগ্র হালয় এর সম্মাননা (২০১৫), USA এর Museam of International Folk Art থেকে সম্মান (২০০৬), আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নারী সম্মান (২০২০), রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ কালচার এর সম্মাননা (২০১৯), রাঁচির ড. রামদয়াল মুণ্ডা ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে সম্মান, সঙ্গীত মহাসম্মান, শিব সম্মান ইত্যাদি পেয়েছেন তাঁর নিরলস কাজের গুণে। স্বর্ণ চিত্রকর এক অনন্য শিল্পী। তিনি ছবি আঁকেন, গান লেখেন এবং গান গাইতেও পারেন। এই তিনটি গুন সকলের মধ্যে নেই। তাই তিনি অন্যদের থেকে এগিয়ে।

🍂
ad

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousMay 23, 2025

    এতো মূল্যবান তথ্য জানতে পেরে ধন্য হলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete