অদৃশ্য শুভাকাঙ্ক্ষী
কমলিকা ভট্টাচার্য
সংগ্রাম আর কলি তাদের দুই শিশুপুত্রদের নিয়ে যখন হিথ্রো এয়ারপোর্ট পৌঁছল তখন সেখানে সবে সকাল হয়েছে।
আগস্ট মাস চলছে, যদিও তখন সেখানে গরমকাল তবু সকালের দিকে তাপমাত্রা বেশ কম, কলি বাচ্চাদের টুপি গুলো নিজের হ্যান্ডব্যাগেই রেখেছিল, তাই বাচ্চাদের সেইগুলো পরিয়ে দিল এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবার আগে। বাইরে এসে সংগ্রাম ট্যাক্সি নিয়ে নিল সোজা ক্যামব্রিজ, সংগ্রাম ছয় মাস আগে সেখানে এসেছে ছোট ছেলের জন্মের ঠিক একমাস পর, তাই তখন ওদেরকে সঙ্গে করে আনতে পারিনি, বাচ্চাটার পাসপোর্ট বানানোর ছিল , ৭ দিনের বাচ্চার পাসপোর্ট বানানো যেন এক অসাধ্যসাধন, আসলে পাসপোর্ট বানানো নয় পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলা, বাচ্চা তো চোখই খোলেনা, প্রায় তিন দিন ধরে বার দশেক চেষ্টার পর সেই অসাধ্য কাজ সাধন হয়ে ছিল।
সংগ্রাম যখন গিয়ে ছিল সেই সময় প্রচন্ড ঠাণ্ডাও ছিল তাই অত ছোট বাচ্চাকে নিয়ে যেতে সাহস করেনি, আর বড় ছেলেও সবে চার বছর।
একেবারে ছোট ছেলের পাঁচ মাসে মুখে ভাত দিয়েই রওনা।
ট্যাক্সিতে বসে কলি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, গত কয়েক মাস ধরে তার উপর দিয়ে যা গেছে সে শুধু একলাই জানে, দুটো বাচ্চাকে নিয়ে দেশের সংসার গুছিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া তার উপর একলাই সব দিক সামলানো ...
চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে বসলো কলি।
সংগ্রাম আলতো করে কলির হাতের উপর হাতটা রাখলো,
বলল "মিসড ইউ এ লট", সংগ্রামের জীবনও বিদেশে একলা কাটানো খুব একটা সুখকর নয়, আগে সংগ্রাম একটা ওয়ান বেডরুম এপার্টমেন্ট এ থাকত, ফ্যামিলি আসছে তাই বড় বাড়ি নিয়েছে কিন্তু বাড়িটাতে অনেক দিন কেউ ছিলনা, বাড়িটার ব্যাকইয়ার্ড পুরো ঝোপ ঝাড় হয়ে গেছে তাই বাড়িটা মিলতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে, তাই আজ সংগ্রাম কলিদের নিয়ে তার এক বন্ধুর বাড়িতে উঠবে, বাড়িওয়ালা বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিষ্কার করিয়ে হ্যান্ডওভার করবে।
হাইওয়েতে গাড়ি চলছে অনেক স্পীডে, গাড়ির চলার আওয়াজ সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজের মত লাগছে, ছোটো ছেলে বেবি কার সীটে ঘুমিয়ে, বড় ছেলেও তার অফুরন্ত প্রশ্নের ঝাঁপি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কলি আস্তে করে সংগ্রামের কাঁধে মাথা রাখে, সংগ্রাম কলির মাথার পিছন দিয়ে হাত দিয়ে কলিকে কাছে টেনে নেয়।
কলি বলে "আজ আমার একটা অপূর্ন স্বপ্ন পূরণ হলো"
সংগ্রাম বলে "হ্যাঁ, তবে তোমাকে বিয়ের পর হনিমুনে নিয়ে যেতে পারিনি, সেই দুঃখটা থেকে যাবে"
কলি বলে "সেটা ঠিক আছে, বাড়িতে সেই সময় পরিস্থিতি ঠিক ছিলনা তাই হয়নি কিন্তু সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া দেশের কত জায়গা ঘুরেছি, তবে লন্ডন দেখা আমার একটা স্বপ্ন ছিল।"
সংগ্রাম কলি নিজেদের পুরোনো কথার সুখের স্মৃতি রাজ্যে হারিয়ে যায়।
হিথ্রো থেকে ক্যামব্রিজ প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের জার্নি।
গাড়ি এসে একটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থামলো।
সংগ্রামের বন্ধু নীরজ এগিয়ে এল, ওরা দুজনে লাগেজগুলো ভিতরে আনলো।
ছোট ছেলে আর বড় ছেলে দুজনেই ঘুম ভেঙে ফুল ফর্মে এসে গেছে।
নীরজেরও দুটি বাচ্চা, মেয়ে বড়, প্রায় সময় বয়সী সংগ্রামের বড় ছেলের আর ছেলে এক বছর।
সংগ্রামের বন্ধুর স্ত্রী ঘর থেকে বাইরে এসে বললো "ফ্রিজে মিল্ক আর বাকি জিনিস আছে কিছু বানাবার থাকে বানিয়ে নিও," বলে সেই যে ঘরে ঢুকলো ....
কলি কিছু হাই হ্যালো বলার আগেই দরজা বন্ধ।
নীরজ খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেছে দেখে সংগ্রাম পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বন্ধুকে বললো "চল আমরাই আজ কিছু বানাই।"
এই রকম একটা আপ্যায়নের জন্য সংগ্রাম বা কলি কেউই প্রস্তুত ছিল না।
একটু ফ্রেশ হয়ে কলি রান্না ঘরে ঢুকলো, মনে মনে ভাবলো ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে।
পরের দিন কলিই ব্রেকফাস্ট বানালো, সংগ্রাম আর নীরজ অফিস বেরিয়ে গেলো, যাবার আগে সংগ্রাম কলিকে বলল সে আজ রেন্টাল অফিসে গিয়ে কথা বলবে, দেখবে যদি আগে বাড়িটা দেয়।
কলি বললো সে রকম হলে সে নিজে ক্লীন করে নেবে, তবে পরের দিন যদি বাড়িটা পাওয়া যায়।
সংগ্রাম কলির মুখের দিকে তাকালো গর্ব ভরা ভালোবাসা নিয়ে, কারণ সে জানে কলি এই ভাবেই সব বিপরীত পরিস্থিতিতে তার সাথ দিয়েছে, কলিই তার সবচেয়ে কনফিডেন্সের জায়গা।
বলল "দেখছি, যদি চাবিটা পাওয়া যায় , বাই।"
দুপুরে সংগ্রাম জানালো বাড়ির চাবি পেয়ে গেছে।
পরের দিন ওরা নিজেদের বাড়ি পৌঁছে গেলো।
একটা সুন্দর দোতলা ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাড়ি।
সামনে সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো লন, দরজায় একটা লেটার ফ্ল্যাপ একটা পেট ফ্ল্যাপ, ব্যস আর কি, কলির বড় ছেলে নতু, তার কোয়েশ্চন ঝড় শুরু, এই রকম জিনিস সে আগে কখনো দেখেনি, একবার করে বাইরে গিয়ে হাত ঢোকায় একবার ভিতর দিয়ে ছোটো জন গলুও হামাগুড়ি দিয়ে দাদার সাথে মিলে দারুণ মজার খেলা শুরু করে।
জিনিসগুলো ভিতরে এনে সংগ্রাম বলে, আগে পুরো বাড়ি ভাকিউম করতে হবে, কার্পেটগুলোতে অনেক নোংরা আছে,
কলি তো ঘোরের মধ্যে এইরকম বাড়ি সে শুধু fairy tale পড়েছে ছবি দেখেছে, সত্যি সত্যি ফায়ার প্লেস, চিমনি, বড় বড় সোফা "উফ কি দারুন ব্যাপার!"
সংগ্রাম বলে "এবার স্বপ্নরাজ্য ছেড়ে কাজে লেগে পড়।"
কলি বলে "হ্যাঁ, আগে রান্নাঘরটা করতে হবে"
বাড়িতে ঢুকতেই একটা লবি, সেখানে সাইড দিয়ে উপরে উঠার সিড়ি, লবিতে কোট ঝুলানোর লম্বা হুকের সারি, প্রথমে অবাক হলেও, UK তে থাকাকালীন পরে বুঝে ছিল দরজা দিয়ে ঢুকেই লবিতে হুকের সারি কেন।
নিচের তলায় বড় ড্রইংরুম আর তার লাগোয়া কিচেন কাম বিরাট ডাইনিং রুম, সব কিছু সাদা কাঠের তৈরী, ড্রইং ডাইনিং দুদিক দিয়েই পিছনের বাগানে যাওয়ার দরজা আছে। বাগানের দিকে দরজা খুলতে সংগ্রাম বারণ করলো কলিকে, বাড়ির মালিক বলেছে আগের Sunday cleaning করে দেবে, সেদিন সবে মঙ্গলবার।
উপরে দুটো রুম , একটা বড় একটা একটু ছোটো, একটা করিডোর যেটা দুটো রুমকে কানেক্ট করছে আর টয়লেট তাতেও কার্পেট।
দুটো ঘরেই বেড আলমারি ড্রেসিং সব আছে।
বড় ঘরে একটা বিরাট জানলা যা দিয়ে বাইরের রাস্তা আর হাইওয়েটাও দেখা যায়।
সংগ্রামের একবার অফিস যেতেই হবে কিছু দরকারী মিটিং আছে , ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার, তাই সংগ্রাম বেরিয়ে পড়ে, লাঞ্চের আগেই ফিরে আসবে বলে, তারপর ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার করা যাবে।
চারিদিক বড় নিঝুম , লোকজনও সেই রকম দেখা যায়নি, তবে সারি দিয়ে পর পর অনেক বাড়ি আছে যখন তখন লোকজন তো নিশ্চয় আছে।
তবে নিজের দেশের প্রতিদিন মেলা লাগার মতো রাস্তায় অত লোকজন এখানে নেই, তাই অদ্ভুত একটা ফাঁকা ফাঁকা শূন্যতা চারদিক জুড়ে।
ছেলে দুটোকে একটু খাইয়ে দিয়ে, ছোটো ছেলেকে pram-এ ঘুম পাড়িয়ে কলি রান্না ঘর পরিস্কার করতে লেগে পড়ে।
এদিকে নতু নিজের মনেই এত নতুন জিনিস পেয়ে তাদের রহস্য উৎঘাটনে ব্যস্ত। তবে খুব বাধ্য ছেলে আর অত ছোটো হলে কি হবে, নতু কলির খুব বড় হেল্পিং হ্যান্ড আর সবচেয়ে বড় হলো সব সময়ের সঙ্গী।
এত বড় রান্নাঘর তারপর সব কিছু সাদা, কলির একটু গাটা ছম ছম করতে লাগলো।
তবে কলি খুব সাহসী, বিয়ের পর থেকে তারা বাইরে বাইরে ঘুরছে, তাই পরিবারের সঙ্গ সেইরকম ভাবে পায়নি কোনোদিন, সংগ্রামকে অফিসের কাজে অনেক সময় বাইরে যেতে হয় তাই কলির একলা থাকার অভ্যাস আছে।
কলি ভয় কে আমল না দিয়ে কাজ শুরু করে , ফ্রিজটা খোলে, অনেকদিন বন্ধ ছিল তাই একটা ভ্যাপসা গন্ধ, খুলে ছেড়ে দেয়।
ওভেন সিঙ্ক ওয়ার্ক টপ সব ভালো করে পরিস্কার করে , তবে ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল ,কদিন ধরে ভালো করে ঘুম হয়নি,
সবে কিচেনের সব জিনিস ঠিক করে সাজিয়ে রাখবে বলে ঠিক করছে, গলু গেলো উঠে, তাকে আবার pram-এ বেল্ট লাগানো থাকলেও গলে ঠিক বেরিয়ে পড়বে নয় লাফ দেবে।
তাই কলি ছুটে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে ওপরে একটু রেস্ট করতে গেলো, নতুও পিছু পিছু উপরে এসে নিজের খেলনা বার করে খেলা করতে লাগলো।
সংগ্রাম ফোন করে বলল লাঞ্চে আসতে পারবে না, কলি যেন কিছু খেয়ে নেয়।
ছেলেদের পেট ভার ছিল, সংগ্রাম বেরোনোর আগে ওরা একটু ম্যাগি বানিয়ে খেয়েছিল, তাই একলার জন্য আবার.....
অনেক ক্লান্ত থাকায় কখন ঘুমিয়ে পড়ল খেয়াল নেই,
সংগ্রাম এসে ডাকতে ঘুম ভাঙ্গলো।
ছেলেরাও ঘুমিয়ে কাদা...
কলি বললো "কটা বাজে?"
সংগ্রাম বললো "সাড়ে পাঁচটা?, কিছু খেয়েছো? নাকি সারাদিন কিচেন পরিস্কার করেছো?"
কলি বলে "পরিস্কার করছিলাম, তবে সব হয়নি, জিনিসগুলো সব গুছোতে হবে, সব মেঝেয় ছড়ানো আছে.."
সংগ্রাম অবাক হয়ে বলে "তোমার কি ঘুম এখনও ভাঙেনি, আমি তো ভাবলাম, তুমি কিচেনে হবে তাই বাড়ি এসে কিচেনে গিয়ে দেখি সব পরিপাটি করে গুছোনো, তুমি তো কিচেনের ভোল পাল্টে দিয়েছো।"
কলি বলে "মজা করোনা, আমি সব পরিষ্কার করতে পারিনি, বড্ড টায়ার্ড লাগছিল, তারপর গলু উঠে গেলো তাই ওকে নিয়ে উপরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছি। "
সংগ্রাম জোরে জোরে হেসে বলল "তাহলে ভুতে করছে।"
কলির বুকের ভিতরটা ছমছম করে উঠলো....
কারণ যখন সে নিচে কাজ করছিল তখন তার বারবার মনে হচ্ছে ছিল কেউ যেন তার হাতে হাতে কাজ করছে।
কলি ছুটে নিচে আসে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে সত্যি রান্নাঘর পরিপাটি গুছোনো, ফ্রিজ খুলে দেখে তাতে জুস মিল্ক ব্রেড সব কেউ রেখেছে, কলি দেখে মাখনটা নেই, তখন ও মনে মনে হাসে , ভাবে এ নিশ্চয় নতুর কাজ, বাড়িতে মাখন মিসিং থাকলে তাহলে মাখন আর নতু দুজনকেই টেবিলের তলায় পাওয়া যাবে, তবে মনে খটকা ফ্রিজটা কে চালু করলো,
ততক্ষণে গলুকে নিয়ে সংগ্রাম নিচে আসে বলে "তোমরা রেডি হয়ে নাও, আমি কফি বানাচ্ছি, সামনে একটা Tesco supermarket আছে তাতে যাবো।"
কলি বলে "তুমি কি ফ্রিজটা চালিয়েছ?"
সংগ্রাম বলে" হ্যাঁ, অফিস থেকে ফিরে জুস খাবো বলে ফ্রিজ খুলে দেখি জিনিস ভরা তবে চালু নেই।"
কলি একটু স্বস্তি পায়, সে জানে ফ্রিজে জিনিস রাখতে নতু তাকে হেল্প করে, তাই ব্রেড জুস নতুই রেখেছে।
লবিতে এসে দেখে নতু দু পায়ে উল্টো জুতো আর jacketএর বোতাম সব উল্টো পাল্টা লাগিয়ে সে রেডী।
কলিকে দেখে বলে "দেখো মাম্মি আমি নিজে নিজে রেডী হয়ে গেছি"
আজকাল ভাই হওয়াতে নতু নিজেকে খুব বড় ভাবে, কি রকম একটা দায়িত্ববোধ জন্মেছে।
কলি নতুকে আদর করে জ্যাকেটের বোতাম ঠিক করে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে "তুমি জিনিস ফ্রিজে রেখেছো?"
নতু বলে" হ্যাঁ"
কলি বলে "আর মাখন?"
নতু মাথা নিচু করে।
কলি বলে "জুতো আবার উল্টো পড়েছ"
নতু কলির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কলি বলে "তুমি ভাইয়ের সাথে খেলো, আমি রেডী হয়ে নিই, তারপর আমরা ঘুরতে যাবো।"
কলি উপরে গিয়ে মাখনের ডাব্বাটা খাটের তলায় পায়, একটু হাসে তবে মনে একটা খটকা থেকেই যায় কারণ ফ্রিজে জিনিস নতু রেখেছে, কিন্তু বাকি জিনিসগুলো?
পরের দিন সংগ্রাম ছুটি নিয়ে ছিল, দুজনে মিলে বাড়িটাকে সাজিয়ে ফেললো।
সত্যি বলতে কিছু পেইন্টিং, সাজানোর জিনিস দিয়ে ওরা বাড়িটাকে ঘর বানালো।
"খালি পিছনের বাগানটা জঙ্গল থেকে গেলো, পরিস্কার হয়ে গেল কিছু গাছ লাগাবো, খুব ভালো লাগবে তাই না" কলি বলল।
সংগ্রাম বলল "বেশি বেশি ভেবো না, কালই বস বলছিল, সাউথহামটনে একটা নতুন প্রজেক্ট আসছে, হয়ত ওরা আমাকে পাঠাবার কথা ভাবছে।"
কলি বলল "আর আমরা, আমি আর একলা ছেলেদের নিয়ে এই বিদেশ বিভূমে একলা থাকতে পারবনা"
সংগ্রাম বলল "এখন থেকে এত ভাবার নেই, সবে প্রজেক্টের কথা হচ্ছে, কনফার্ম হতে টাইম লাগবে, অনেক রাত হয়েছে কাল অফিসে আছে, চলো শুয়ে পড়ি।"
কলির মনটা অশান্ত হয়ে যায়, এই সবে দুদিন এসেছে এখানে, এই বাড়িটা ঘিরে নানা স্বপ্ন সে দেখতে শুরু করেছে, আবার অন্য জায়গা।
কলি ভাবে এতদিন নতু ছোটো ছিল তাই এদিক ওদিক ঘুরেছে, কাল নতুকে নিয়ে স্কুলে ভর্তির জন্য নিয়ে যেতে হবে, এসব চিন্তা করে কলি অস্থির হয়ে ওঠে, বিয়ের পর থেকে কোনো বাড়িতে ছয় মাসের বেশি সে থাকেনি।
উপর থেকে সংগ্রাম ডাকে "চলে এসো"
কলি সবে আধা সিড়ি ওঠে, ওর মনে পড়ে দুধটা ফ্রিজে তোলা হয়নি, ফেটে গেলে খুব প্রবলেম হবে, Tesco ছাড়া আশেপাশে কোনো দোকান নেই দেশের মতো, Tesco তাও প্রায় দেড় মাইল।
রান্না ঘরের আলোটাও নেভানো হয়নি, কলি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে দেখে রান্না ঘরের আলো বন্ধ, একটু খটকা লাগে আলোটা জ্বালিয়ে দেখে দুধ বাইরে নেই, ফ্রিজ খুলে দেখে সেখানে তুলে রাখা আছে।
আলো বন্ধ করে কলি ছুটে উপরে যায়, সংগ্রামকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই দেখে সংগ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে, কলি চাদরটা টেনে সংগ্রামের গায়ে চাপা দিয়ে দেয়।
ঘরের আলোটা নিভিয়ে সে জানলার ধারে এসে দাড়ায়,
বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো ঘরটাকে হালকা আলোকিত করে রেখেছে।
হাইওয়েতে সেই একই ভাবে তুমুল স্পীডে গাড়ি চলছে।
সামনের রাস্তাটায় কোন লোকজন দেখা যাচ্ছেনা, একটা দুটো বাড়ি ছাড়া সব বাড়ি অন্ধকার। পর্দাটা টেনে কলি এসে শুয়ে পড়ে কিন্তু ঘুম আসেনা। নানা কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে জানে না। দেওয়াল ঘড়ির ঘণ্টার আওয়াজে ঘুম ভাঙে, সাতটা বেজে গেল, অনেক দেরি হয়ে গেছে, পাশে দেখে সংগ্রাম বিছানায় নেই, কলি তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে নিচে আসে, কিন্তু সংগ্রাম কে কোথাও দেখেনা, রান্না ঘরে গিয়ে দেখে ইলেকট্রিক কেটলিতে জল গরম হচ্ছে, টি ব্যাগ, কাপ সব জোগাড় সব রাখা, এমনকি ফ্রিজ থেকে দুধ ব্রেড ব্রেকফাস্টের সব জিনিস গোছ করে বাইরে রাখা, কলি মনে মনে খুশি হয় সংগ্রাম একলা থেকে অনেক কিছু শিখেছে, কিন্তু সে গেল কোথায়।
কেটলিতে জলটা ফুটে গেছে, কলি চা বানাতে লাগে।
হটাৎ মনে হয় পিঠে ঠাণ্ডা কিছু একটা জিনিস সুড়সুড়ি দিচ্ছে, কলির গলা শক্ত হয়ে উঠে, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, চিৎকার করতে চেয়েও গলা থেকে আওয়াজ বের হয়না।
সংগ্রাম পিছন থেকে কলিকে জড়িয়ে ধরে, কলি পিছন ফিরে সংগ্রামকে দুহাত দিয়ে দূরে ঠেলে বলে "তুমি, জানো আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, এই বাড়িতে আসা থেকে বিশেষ করে এই রান্নাঘরে আমার খালি মনে হচ্ছে কেউ আমার আশেপাশে ঘুরছে, হাতে হাতে কাজ করছে, মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব ঘটনা হচ্ছে, কাল রাতে..."
কলি কথা শেষ করার আগে সংগ্রাম বলে "ভালইতো ফ্রীতে ভুত কাজের লোক, তবে ভুত মেড তুমি এখন একটু বাইরে যাও আমি আমার বৌএর সাথে একটু প্রেম করবো"
কলি বলে "বাজে কথা না বকে, চা খাও"
কলি চায়ের কাপটা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে দেয়।
সংগ্রাম কলির হাতে ল্যাভেন্ডার ফুলের ডালটা দিয়ে বলে "বাগানটা দেখ ছিলাম , ভরা ল্যাভেন্ডার বুশ"
কলি ডালটা শুখে বলে "কি মিষ্টি গন্ধ"
কলি সংগ্রাম চায়ের কাপ নিয়ে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে,
সংগ্রাম কলিকে বলে ইয়েলো পেজ দেখে লোকাল কাউন্সিল অফিসে ফোন করতে, ওরাই নতুর স্কুলের ব্যাপারে সব বলে দেবে।
কলি সংগ্রামকে বলে "তুমি অফিসে বেরিয়ে গেলে, আমি সোজা উপরে যাবো নতু গলুর খাবার নিয়ে আর নিচে আসবো না, তুমি তো ইয়ারকি করবে, এই বাড়িতে সত্যিই কিছু আছে, ডোর ফ্ল্যাপটাতে ও মাঝে মাঝে আওয়াজ হয় কি যেনো ঢোকে বের হয় “
সংগ্রাম হেসে ওঠে হা হা করে, বলে, "তুমি সত্যি পারো বটে, তবে ভালো বিদেশে কোনো হেল্পার পাওয়া যায়না, তুমি যদি একজন ফ্রী হেল্পার পাচ্ছ ক্ষতি কি"
কলি বিরক্ত হয়ে বলে "তুমি ফ্রী হেল্পার বলছো, যদি গলা টিপে দেয় কোনোদিন, সকালে আমি যা ভয় পেয়েছিলাম, আমি অনেক গল্পে ইংলিশ ভুতের কথা পড়েছি"
সংগ্রাম বলে "এইবার বুঝলাম তোমার এইসব আজেবাজে কল্পনার মানে, তুমি না বড় সায়েন্স পড়েছ"
কলি বলে "তুমি স্নান করতে যাও, আমি গলু ওঠার আগে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে তোমার টিফনটা প্যাক করে দিই"
সংগ্রাম উপরে যায়, কলি রান্নাঘরে।
টিফিন প্যাক করে সবে কলি ব্রেকফাস্টের ব্রেড টোস্টারে দিয়েছে গলু উঠে কাঁদতে লাগে,
কলি তাড়াতাড়ি ছুটে উপরে যায়, কারণ গলু খাঠ থেকে নামতে পারে যদি সিড়ির কাছে চলে আসে....
সংগ্রাম স্নানে ঢুকেছে...
কলি গলুকে কোলে নিয়ে নিচে আসে, ছুটে রান্না ঘরে যায়, টোস্টারে টাইম সেট করা হয়নি নিশ্চয় এতক্ষনে পুড়ে গেছে
কিন্তু কলি দেখে সেরকম কিছু হয়নি ব্রেড টোস্ট হয়ে গেছে।
কলির একবার মনে খটকা লাগে, কিন্তু আমল দেয় না..
ততক্ষণে সংগ্রাম এসে যায় কলি সংগ্রামকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে , তাড়াতাড়ি নিজের আর ছেলেদের খাবার প্যাক করে নিয়ে উপরে রেখে আসে, মনে মনে ভাবে সংগ্রামকে এই ব্যাপারে বলে কোনো লাভ নেই, সংগ্রাম না থাকলে ও আর নিচে আসবে না।
সংগ্রাম অফিসে বেরিয়ে গেলে কলি ছেলেদের নিয়ে উপরে চলে গেল।
কাউন্সিলে ফোন করতে এরিয়া পিনকোড জেনে লিস্ট অফ nearby স্কুল পাঠাবে বললো কিন্তু নতুর জন্মতারিখ হিসাবে নতু স্কুল নভেম্বর মাস থেকেই যেতে পারবে বলল। কলি মনে মনে ভাবলো নতু তার এমনিতেই অনেক স্মার্ট , নিজের বয়সের বাচ্চাদের তুলনায় অনেক বেশি জানে। লন্ডন যাওয়ার আগেই নতু Noida তে একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুল যেত তাছাড়া কলি নিয়ম করে রোজ ওকে পড়ায়।
নতু একটু আপসেট হলো এখন নতুন স্কুল যাওয়া হবে না শুনে, কলি ওকে আদর করে বলল "এখানের বাচ্চাগুলোতো নতুর মত এত স্মার্ট নয় তাই ওরা ভাবছে নতু এখনও ছোটো আছে, কিন্তু ওরা তো জানে না নতু আমার কত বুঝদার ছেলে, তুমি যাও তোমার বই নিয়ে এসো আমরা পড়া করি "
পড়তে নতু খুব ভালোবাসে, ছুটে নিজের বই নিয়ে রেডী, কাল নতুই আবার ভাইয়ের জন্য একটা কাপড়ের বই Tesco থেকে নিয়ে এসেছে, তাড়াতাড়ি ছুটে নিচে গিয়ে বইটা নিয়ে এসে ভাইকে দিল। গলু বইয়ের কি বোঝে ওটা হাতে পেয়ে মুখে দিয়ে চিবোতে লাগলো, নতু ভাইকে অনেক করে বোঝাতে লাগলো ওটা বই , বই খেতে নেই পড়তে হয়, না হলে সরস্বতী মা রাগ করে।
কলি ওদের দুই ভাইয়ের কথপোকথন এনজয় করতে থাকে....
দুপুরে কলির সবে একটু চোখ লাগে
নতু চিৎকার করে উঠে’মাম্মি মাম্মি ‘
কলির রক্ত হিম হয়ে যায়,ছুটে যায় নিচে
দেখে নতু হাসছে,বলে” মাম্মি একটা মোটা black cat, ঐ ডোর ফ্লাপটা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আটকে গিয়েছিল, আমায় দেখে পালিয়ে গেল”
বলে নতু হাসতে থাকে।
কলির বুকে প্রাণ আসে।
বিকেলে অফিসে থেকে ফিরে সংগ্রাম বলে রেন্টাল অফিসে থেকে ওরা ওকে জানিয়ে ছিল রবিবারের আগে ওরা গার্ডেনটা ক্লীন করতে পারবে না, অথচ অফিস থেকে আসার সময় দেখলো বাগানটা সুন্দর করে পরিষ্কার করা।
কলি বললো কেউতো আসেনি,"
সংগ্রাম বলল "ওরা হয়ত বাইরে থেকে ঢুকে করে গেছে, তবে ওদের জানিয়ে আসা বা করে দেওয়ার পর বলা উচিত ছিল, ছেড়ে দাও পরিষ্কার হয়ে গেছে"
কলি বলে "তাহলে ওরা নিশ্চয় সব ল্যাভেন্ডার গাছ গুলো কেটে দিয়েছে"
সংগ্রাম বলে "না , অদ্ভুত ব্যাপার ওগুলো কাটেনি"
কলির একবার মনেহয় এটা আবার ওই অদৃশ্য হেল্পারের কাজ নয়তো, কিন্তু সংগ্রাম আবার মজা করবে তাই কিছু না বলে চা বানাতে নিচে যায়।
সত্যি বাগানটা কি সুন্দর লাগছে, আর বাগানের এক কোণে বাগান করার সব জিনিস গুছিয়ে রাখা, একটা গার্ডেন টেবিল আর দুটো চেয়ার ও আছে, এত ঝোপ জঙ্গল হয়ে গিয়েছিল কিছু দেখা যাচ্ছিল না।
প্রায় এই রুটিনেই ওদের দিন চলতে লাগল, রোজ সংগ্রাম অফিসে থেকে ফেরার পর ওরা কোথাও না কোথাও ঘুরতে যেত, নানা জিনিস শপিং করত , ওদের বেশ ভালই দিন কাটছিল...
কলির মন থেকেও সেই অদৃশ্য হেল্পারের ভয়টা চলে গেছে আর ও সংগ্রাম চলে গেলে উপরে যেত না, বাগানে বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাতো, বাগান সাজাতো। রান্না ঘরের, বাগানের নানা কাজে অদৃশ্য হেল্প করা, ছাড়া কলির কোনো ক্ষতি তো কোনদিন সে করেনি , বরং কলির অনেকবার মনে হয়েছে গলু আপন মনে যেন কারুর সাথে খেলা করে, ওখানে সবকিছু ফ্রোজেন পাওয়া যায় তাই আগে থেকে ফ্রিজার থেকে বার না করলে অনেক অসুবিধা হয়, কিন্তু কলির সেই অদৃশ্য শুভাকাঙ্ক্ষী এই ব্যপারে কলিকে যথেষ্ট সাহায্য করে। কলি এখন বেশ এনজয় করে সেই হেল্পটা, অদৃশ্য হেল্পার ধীরে ধীরে কলির বেশ ফ্রেন্ড হয়ে গেল, সত্যি বলতে সব যেনো কলির গা সওয়া হয়ে গেল, আর এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মনে মনে তাকে thanks বলতো।
হঠাৎ একদিন বিকেলে সংগ্রাম এসে বললো ওদের সাউথহ্যামটন যেতে হবে প্রজেক্টটা এসে গেছে, ও কাল সাউথহ্যামটন যাবে, আগে গিয়ে বাড়ি দেখে আসবে তারপর কলিদের নিয়ে যাবে।
সংগ্রাম দুটো টিকিট কলির হাতে দিয়ে বলে "এগুলো ঠিক জায়গায় রেখে দাও, বাসের টিকিট, কাল খুব ভোরে বেরোতে হবে"
কলির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
সংগ্রাম মজা করে বললো "তোমার কি হেল্পার ভূতকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে"
কলি কোনো জবাব করলো না, রান্না ঘরে চলে গেল।
সংগ্রাম কথাটা মজা করে বললেও কলির মন খারাপের কারণ সেটা অবশ্যই ছিল।
বিয়ের পর থেকে যেভাবে কলি একলা সব কিছু সামলেছে কেউ এই ভাবে কোনোদিন সত্যি ওকে হেল্প করেনি, এই ছোটো ছোটো হেল্পগুলো কত বড় হেল্প সেটা কেবল যে মেয়েরা একলা একলা সব করে তারা বোঝে।
সংগ্রাম কলিকে কাছে টেনে বলে, "আমি বুঝি তোমার উপর অনেক প্রেসার হয় বার বার এক জায়গা থেকে এক জায়গা যেতে, কিন্তু তুমি ই তো আমার ভরসা"
কলি সংগ্রামের বুকে মাথা রাখে, আসতে করে বলে "এই বাড়ির এত গুলো টাকা ডিপোজিট, একমাসেই ছেড়ে দিলে টাকা ফেরত দেবে তো"
সংগ্রাম বলে "কাল ফোন করে কথা বলব"।
পরেরদিন সংগ্রাম সাউথহ্যামটনের জন্য বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে যায় ভোরবেলায় , বেরোবার আগে টিকিটগুলো চায় কলির কাছে।
কলি বলে, "টিকিট তোমার ব্যাগে দেখো"
সংগ্রাম বলে "না ব্যাগে নেই"
কলি একদম মনে করতে পারে না কোথায় রেখেছে টিকিট গুলো, সারা বাড়ি খুঁজতে থাকে,
সংগ্রাম দেখে টিকিট গুলো ফায়ার প্লেসের উপর রাখা।
সংগ্রাম কলিকে বলে "দেখো এইখানে রেখে বলছো ব্যাগে রেখেছ, তার পর বলবে এসব তোমার হেল্পার ভুত খুঁজে দিল, তুমি এত চিন্তা করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমার দেরী হয়ে গেছে, তুমি খাবার বানিয়ে খাবে কিন্তু, আমি নেই তো বানাবেও না, এইরকম করবে না, বাই "
সেদিন রাতে সে ফিরবেনা, নেক্সট ডে রাত হবে ফিরতে।
কলি রান্না ঘরে যায় আর বলে "আমি জানি তুমি কেউ এখানে আছো, কেউ মানুক বা না, জানি আমি ভুলে যাই অনেক সময় কোথায় জিনিস রেখে তবে সেটা কি সব সময়? তুমি আমাকে তোমার বন্ধু ভাবো আমিও তাই, সত্যি বলতে তুমি যেভাবে আমাকে এই নতুন জায়গায় সেটল হতে সাহায্য করেছো তার জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী থাকবো, তুমি আমার একাকীত্বের সাথ দিয়েছো, তুমি সত্যি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, একদম নিজের লোকের মত, নিজের মানুষদের সাথও আমি কখনো এভাবে পায়নি, I am very sorry "
কলি কাঁদতে থাকে।
ফোনটা বাজে, সংগ্রাম ফোনে বলে ও বাসে চড়ে গেছে।
আবার ফোন আসে কলি দেখে ওর বন্ধু মিলির ফোন, মিলি ডাক্তার, লন্ডনে কিছু মেডিকাল কনফারেন্সে এসেছে, দেখা করতে চায়।
কলি জানতে চায় ও লন্ডনে কতদিন থাকবে কারণ নেক্সট উইক তারা সাউথহ্যামটন শিফট করবে, তারপর দেখা করা যাবে।
মিলি বলে "নো প্রবলেম"
সে এখন লন্ডনে তিন মাস থাকবে।
মিলি কলিকে বলে "তোর খবর কি বল"
কলি বলে "আর বলিস না , আজকাল কি যে হয়েছে কোথায় কি রাখি মনে থাকে না, এই সংগ্রাম বেরোনোর আগে টিকিট কোথায় রেখেছি আর মনে করতে পারছিনা...
তার উপর...
মিলি বলে" তার উপর কি?"
কলি বলে "তোকে বললে তুইও হাসবি, এই বাড়িতে অদৃশ্য কেউ আছে যে আমাকে হেল্প করে, হারানো জিনিস খুঁজে দেয়, .."
মিলি জোরে জোরে হেসে উঠে।
মিলি বলে "এসব কিছু নয় , তুই অনেক স্ট্রেস নিচ্ছিস, একটু রেস্ট কর, সেই বেবি হওয়া থেকে একলা একলা সব করছিস, সাউথহ্যামটনে শিফট হয়ে, এক সপ্তার জন্য লন্ডন চলে আয়, লন্ডন ঘুরে দেখবো, তোর মনটাও একটু হালকা হবে, তোর একটু রিলাক্স হওয়া দরকার"
কলি বলে "হ্যাঁ"
মিলি বলে "আমি রাখি রে, এখন NHS যেতে হবে, বাই ".
কলি ভাবে সত্যি অনেক স্ট্রেস হয়ে যাচ্ছে...কিন্তু সব টাই কি তার মনের ভুল..
বিকেলে সংগ্রাম ফোন করে জানায় রেন্টাল অফিসে তার কথা হয়েছে, প্রথমে তারা রাজী হচ্ছিল না, কারণ ওরা বলছিল সংগ্রামের রিকোয়েস্টেই ওরা বাইরের লোক দিয়ে এক্সট্রা টাকা দিয়ে গার্ডেন ক্লীন করিয়ে দিয়েছে, এখন একমাসেই চলে গেলে ওদের জন্য প্রবলেম, তাও তারা চেষ্টা করবে যদি বাড়িওলা রাজী হয় এটলিস্ট পাঁচ মাসের ডিপোজিট ব্যাক করবে।
কলি বলে, "ঠিক আছে তাও, ওখানে কি তুমি বাড়ি দেখেছো ?"
সংগ্রাম বলে "হ্যাঁ, একটা ভালো বাড়ি পেয়েছি , আর নিচের তলায় একটা ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি আছে, তোমার বেশি একলা feel হবে না, আরো ভালো ওদের একটা নতুর মত বাচ্চা আছে।"
এরপর কলিদের যাওয়ার গোছগাছ শুরু হয়ে যায়, অদৃশ্যবন্ধু কলিকে আগের মতই হেল্প করে সব কাজে।
যাওয়ার দিন সংগ্রাম গাড়ি আনে, সব জিনিস গাড়িতে ভরে নেয়।
🍂
গাড়ি ছাড়ার আগে কলি সংগ্রাম কে বলে, "তোমরা গাড়িতে বসো, আমি একবার ভিতরে সব দেখে আসি"
সংগ্রাম বলে "ok, তাড়াতাড়ি করো"
কলি সোজা রান্নাঘরে যায়।
অদৃশ্য বন্ধুর উদেশ্যে বলে "আমি আসছি, তুমি ভালো থেকো, bye, "
কলি ছুটে গিয়ে গাড়িতে বসে, ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে , কলি গাড়ির জানলা দিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যতক্ষণ না বাড়িটা চোখের আড়াল হয়,
কলির হঠাৎ মনে হয় বাড়ির দোতলার জানলা থেকে কেউ যেন তাকে হাত নেড়ে টাটা করছে, কলিও হাত নেড়ে bye করে, গাড়িটা টার্ন নেয় বাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে যায়...
সংগ্রাম দেখে কলির চোখে জল।
সংগ্রাম মনে মনে ভাবে
সত্যি কি ঐ বাড়িতে কেউ ছিল?.....
নাকি কলির মনে মনে গড়ে তোলা এক কল্পনার শুভাকাঙ্ক্ষী....
যে ভাবে সে পাশে পেতে চেয়েছিল নিজের কাছের মানুষদের......
পেতে চেয়েছিল তাদের থেকে ছোট ছোট হেল্প ...
চেয়েছিল হাত ধরে কেউ তাকে শিখিয়ে দেবে সংসারের কাজ..
কিন্তু কোনোদিন কাউকে সে পাশে পায়নি...
সংগ্রাম কলির হাতেতে বাগান থেকে আনা ল্যাভেন্ডারের ডালটা দেয়
কলি বলে "তুমি , ..."
সংগ্রাম কলির হাতে হাত রাখে।
এর পর কলির জীবনে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, কলিরা এখন ভারতে, ছেলেরাও বড় হয়ে গেছে, অনেক কথা তার মনেও নেই, কিন্তু কলির মনে অদৃশ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর স্মৃতি একই ভাবে জীবিত।
হঠাৎ একদিন সংগ্রাম অফিস থেকে ফোন করে জানালো নীরজ আর ওর ফ্যামিলি এসেছে ইন্ডিয়াতে, ও বিকেলে ওদের নিয়ে বাড়ি আসছে।
কলি খুব খুশি, আজ কতদিন, প্রায় দশ বছর পর ওদের সাথে দেখা হবে।
বিকেলে ওরা এলো ওদের বাচ্চারাও অনেক বড় হয়ে গেছে, কলি ওদের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করেছিল। খাওয়া দাওয়া সারতে অনেক রাত হয়ে গেলো , কলি ওদের অনেক করে থাকার অনুরোধ করল কিন্তু ওদের পরের দিন afternoon এ ফ্লাইট ছিল সব গোছগাছ করতে হবে তাই ওরা চলে যাবে বললো।
সংগ্রাম নীরজকে নিয়ে নীচে গাড়ি বার করতে গেল, নীরজের বউ অনিতা বলল ওর কিছু কথা আছে কলির সাথে।
অনিতা হঠাৎ কলির হাতটা ধরে বলল "তুমি আমাকে সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করে দিও, আমি ঐ সময় ডিপ্রেসনে ভুগছিলাম, একজন মহিলা হিসাবে তুমি নিশ্চয় বুঝবে, আফটার ডেলিভারি এই ধরনের প্রবলেম তো ..."
কলি ওকে থামিয়ে বলল "আরে আমার তো কিছু মনেই নেই, ক্ষমা এসব তুমি কি বলছো"
সত্যিই কলির কিছু মনে ছিলনা।
অনিতা বলল" আমার মনটা আজ অনেক হালকা হলো, আমি আসি"
অনিতা চলে যাবার পর কলি কি হয়েছিল মনে করার চেষ্টা করল, কিন্ত মনে করতে পারলো না, কিছু একটা হয়েছিল হবে, যাই হোক , কলির মনের ভিতর আজ আবার অদৃশ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর স্মৃতি ভেসে উঠলো...
তবে কি?
আফটার ডেলিভারি তারও কি এই ধরনের কোন সমস্যা হয়ে ছিল, যা তার বন্ধু মিলিও তাকে বলতে চেয়েছিল...
নীরজদের ছেড়ে সংগ্রাম বাড়ি ফিরতে কলি প্রশ্ন করে,
"অনিতা আমার কাছে ক্ষমা চাইলো, কিন্তু আমার তো কিছু মনেই নেই, তোমার মনে আছে কি হয়েছিল? ও বলছিল ও নাকি ঐ সময় আফটার ডেলিভারি ডিপ্রেসনে ভুগছিল"
সংগ্রাম কথাটা এড়িয়ে যায় বলে "হবে হয়ত"
কলি বলে, "তোমার হেল্পার ভুতকে মনে আছে?"
সংগ্রাম বলে "মনে থাকবে না আবার, ওটা তো কাবাব মে হাড্ডি ছিল"
কলি বলে "সেই তোমার ইয়ার্কি, আমার মনে হয় আমারও সেই সময় ডিপ্রেসন বা কিছু একটা হয়েছিল"
সংগ্রাম বলে "লন্ডনে যখন মিলির কাছে গিয়ে ছিলাম, তখন মিলি আমায় বলেছিল তোমাকে যেন একটু বেশি সময় দিই, আফটার ডেলিভারি অনেক সময় একলা থাকলে একটা স্ট্রং ইমোশন তৈরি হয়, আবার কেউ ভুতও দেখে…"
সংগ্রাম হাসতে থাকে।
কলি বলে "আগে বলনি তো কোনদিন"
সংগ্রাম বলে, , " তুমিই তো একটা আস্ত ভুত, তার একটা ভুত ফ্রেন্ড হতেই পারে.."
কলি বলে "আমি ভুত তো তুমি ব্রম্মদৈত্য… "
সংগ্রাম বলে "কাল অফিস আছে, অনেক রাত হয়েছে, চলো শুয়ে পড়ি, আমি যাচ্ছি"।
কলি বলে "তুমি যাও আমি আসছি"
কলি ঘরের আলোটা নিভিয়ে জানলার ধারে এসে দাঁড়ায়, মনে মনে ভাবে অদৃশ্য শুভাকাঙ্ক্ষী কি তাহলে তার কল্পনার মায়াজালে বোনা উপলব্ধি মাত্র ছিল....
সব তার মনের ভুল...
কিন্ত সব উপলব্ধির কি ব্যাখ্যা হয়???...
দেওয়ালে টিকটিকিটা
2 Comments
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টান টান গল্প। শেষ না করে ছাড়া যায় না।
ReplyDeleteThank you
ReplyDelete