জ্বলদর্চি

জাদুর হাঁড়ি/সংগ্রাহক- পূর্ণিমা দাস/কথক- আল্পনা দাস, গ্রাম- যুগীশোল, থানা- নয়াগ্রাম, জেলা- ঝাড়গ্রাম

জাদুর হাঁড়ি

সংগ্রাহক- পূর্ণিমা দাস

কথক- আল্পনা দাস, গ্রাম- যুগীশোল, থানা- নয়াগ্রাম, জেলা- ঝাড়গ্রাম


শ্যামপুর নামে একটি গ্রামে এক রাজা বাস করত। এ রাজা সে রাজা নয়, যে রাজা ঘোড়ার চড়ে যুদ্ধ করতে যায়। এ হল শুধু নামেই রাজা। এর না আছে কোনো ঘোড়া, না আছে কোনো রাজপ্রাসাদ। এই রাজা ছিল আসলে খুবই গরীব। এর ছিল শুধু ছোটো একটি কুঁড়েঘর, দুটি গরু ও একজোড়া লাঙ্গল আর কয়েকটি মুরগি। এই রাজার রাণী অর্থাৎ বউ ছিল। রাজার প্রথম পক্ষের বউ মারা যাবার পর সে আবার দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। তার আগের বউটার থেকে এ বউটা ছিল অত্যন্ত লোভী ও স্বার্থপর। রাজা প্রতিদিন সকালে উঠে চাষের কাজে মাঠে চলে যেত। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় বাড়ি এসে ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম করত। এককথায় যে ছিল অত্যন্ত পরিশ্রমী। কিন্ত এত পরিশ্রম করার পরও তার সংসারে অভাব মিটত না। রাত-দিন এই নিয়ে তাকে তার বউ-এর কাছে নানা কথা শুনতে হয়। এইভাবে ঝগড়া অশান্তির মধ্য দিয়ে তাদের দিন কেটে যেতে লাগলো।

🍂
ad

         এমনই একদিন রাজা চাষের কাজের জন্য মাঠে যাবার সময় তার বউ তাকে বলল-“বলি শুনছ, পাশের বাড়ির হারান দার বউ কী সুন্দর একটা সোনার নাকছাবি কিনেছে, তুমি আমার জন্য একটা গড়িয়ে দাও না।” রাজা তার বউর এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। কারণ রাজা ভাবল তার বউ জানে না তাদের কী অবস্থা। আর এই সময় এইগুলো কী কথা বলছে বউ, রাজা তখন বলল-"তুমি তো জানো আমাদের কী অবস্থা, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আর তুমি সেখানে সোনার স্বপ্ন দেখ কী করে?” রাজার বউ বলে-“আমি কিছু জানি না। আমায় যখন বিয়ে করেছিলে তখন মনে ছিল না কী খাওয়াবে, কী পরাবে আমাকে? আমি এতসব কিছু জানি না আমার সোনার নাকছাবি চাই চাই-ই।” রাজা বলে-”যা রোজগার করি তা তো সংসার খরচে চলে যায়। আর চাষের থেকে যা পাই তা জমিদারের খাজনা দিতে দিতে শেষ হয়ে যায়। তোমার জন্য সোনা আনব কোথা থেকে?”  রাজার বউ কোনো কথা শোনে না। এই নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। রাজা তখন কিছু না বলে রাগের মাথার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর মনে মনে ভাবতে থাকে “আমি শুধু নামেই রাজা, কিন্তু বাস্তবে ভিখারী। কেন যে বাপ-মা এই নাম রাখল কে জানে?” এইসব কথা ভাবতে  ভাবতে সে দেখতে পায় বুড়া বটগাছের নিচে কে যেন একজন বসে আছে। কাছে গিয়ে দেখে এক সাধুবাবা বসে আছেন। রাজা তখন সাধুকে প্রণাম করে। সাধু রাজাকে আর্শীবাদ দিয়ে বলেন-“তুমি কে বাছা?” রাজা বলল-“আমি রাজা,এই গ্রামে আমার বাড়ি।” সাধু তখন বলেন-“তোমাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?” রাজা তখন সাধু্কে সমস্তকিছু বলে। সাধু বলেন-“তোমার কোনো চিন্তা নেই, আমি তো আছি তোমার সব দুঃখ কষ্ট দূর করে দেব।” এই বলে সাধুবাবা রাজাকে একটা হাঁড়ি দিলেন, আর বললেন-“বাছা, এটা কোনো সাধারণ হাঁড়ি নয়, এটা জাদুর হাঁড়ি। এই হাঁড়ির কাছে তুমি যা চাইবে তাই পাবে। তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। কিন্তু হ্যাঁ, এই হাঁড়ি তোমার তিনটি ইচ্ছা পূরণ করার পর এক সাধারণ হাঁড়িতে পরিণত হয়ে যাবে।” রাজা তখন সাধুবাবাকে প্রণাম করে সেই হাঁড়ি নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। হাঁড়ি নিয়ে ঘরে আসার পর তার বউকে ডাকে। তার বউ ঘরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে রাজার হাতে হাঁড়ি দেখে বলে-“তুমি কী গো, তোমাকে আমি নাকছাবি আনতে বললাম আর তুমি হাঁড়ি নিয়ে এসেছ।” রাজা তখন বলে-“বউ, এ যে সে হাঁড়ি নয়, এ হল জাদুর হাঁড়ি। আমাকে এক সাধুবাবা এটা দিয়েছেন। এই হাঁড়ি থেকে তুমি যা চাইবে তাই পাবে।” রাজার বউ তখন খুশিতে পাগল হয়ে যায়। সে রাজাকে বলে-“কী বলো গো! যা চাইব তাই পাব।” রাজা বলে ‘হ্যাঁ।’ তখন রাজার বউ বলে-“তাহলে এই হাঁড়ি থেকে তুমি অনেক অনেক টাকা, সোনা-দানা চাও।” রাজা বলে-“না বউ আমাদের যতটুকু প্রয়োজন আমরা ততটুকু চাইব। বেশি লোভ ভালো না।” রাজার বউ রাজার কোনো কথাই শোনে না। সে বলে “না, আমি কিছু জানি না। আমি যা বলছি তুমি তাই চাও। নাহলে আমি বাপের বাড়ি চলে যাব।” আর সে এও ভাবতে থাকে-“এবার আমি রাজরাণী হব।”  কিন্তু রাজা তার বউর কোনো কথা না শুনে ওই হাঁড়ির কাছে তার প্রয়োজনীয় জিনিস চায়। রাজা ওই হাঁড়ির কাছে একটি বাড়ি, দশটি গরু ও আরও একজোড়া লাঙ্গল চায়। কিন্তু রাজার বউ এতে খুশি হয় না। রাজা তার বউকে বোঝায় যে বেশি লোভ ভালো না। আমরা এই সব দিয়েই অনেক অনেক টাকা রোজগার করব। কিন্তু এতে তার বউ খুশি হয় না। সে মনে মনে ভাবে-“আমি ওই সাধুর কাছে যাব, আর আরও একটা জাদুর হাঁড়ি নিয়ে আসব।” এই ভেবে পরের দিন সকালে রাজা মাঠে যাবার পর সে অর্থাৎ রাজার বউ বেরিয়ে পড়ে ওই সাধুর খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে সে দেখতে পায় দূরে বুড়া বটগাছের নিচে কেউ একজন বসে আছে। কাছে গিয়ে দেখে এক সাধুবাবা বসে আছেন। রাজার বউ বুঝতে পারে এই মনে হয় সেই সাধু। তখন সে সাধুবাবার কাছে গিয়ে বলে-“সাধুবাবা, আমার বরকে তুমি যে জাদুর হাঁড়ি দিয়েছ, সেরকমই একটা জাদুর হাঁড়ি আমাকেও দাও।” সাধু বলেন-“তুমি কে মা, তোমার কীসের জন্য জাদুর হাঁড়ি দরকার।” রাজার বউ বলে-“এত কথা আমি বলতে পারব না। আমাকে জাদুর হাঁড়ি দাও।” তখন সাধুবাবা বুঝতে পারলেন যে এর মনের ভিতর কী চলছে, আর এ কতটা লোভী। রাজার বউ মনে মনে ভাবতে থাকে “এবার আমি রাণী হব।” এরপর সাধুবাবা কোনো কথা না বলে জাদুর হাঁড়ি রাজার বউকে দিলেন, কিন্তু এটা সেই হাঁড়ি নয়, অন্য হাঁড়ি। এই কথাটি তিনি রাজার বউকে বললেন না। আর এই জাদুর হাঁড়িতে যেটা চাইবে সেটা দেবে না, বরং তার ঠিক উল্টোটা দেবে- এই কথাটিও রাজার বউকে বললেন না। তিনি রাজার বউকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এইসব করলেন। রাজার বউ হাঁড়ি পেয়ে মহানন্দে ঘরে ফিরে এল। ঘরে এসে সে ওই হাঁড়ির কাছে চাইল-“হাঁড়ি হাঁড়ি হাঁড়ি তুমি আমাকে অনেক অনেক ধন-রত্ন দাও।” কিন্তু হাঁড়ি এইসব কিছু না গিয়ে অনেক অনেক সাপ দিল। সারা ঘর সাপে ভরে গেল। রাজার বউ এইসব দেখে খুব ভয় পেয়ে রাজাকে ডাকতে লাগল। রাজা এসে যখন দেখে ঘরের এই অবস্থা, সেও রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়। রাজা তখন তার বউকে জিজ্ঞাসা করে-“এইসব কী করে হল?” তখন রাজার বউ সব কথা রাজাকে খুলে বলে। রাজা তখন বলল-“আমি আগেই বলেছিলাম অতি লোভ ভালো না।” রাজার বউ তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল-“আমি আর লোভ করব না গো, আর লোভ করব না। তুমি সাপের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।” সেই সময় সেখানে সাধুবাবা এসে উপস্থিত হলেন। আর রাজা সাধুবাবাকে বলব তার বউকে বাঁচাতে। সাধু তখন জাদুবলে সবকিছু ঠিক করে দিলেন, আর বললেন-“এটা তোমরা মনে রেখো যে, ভগবান ভালোর সঙ্গে ভালো আর খারাপের সঙ্গে খারাপ করেন। তাই সবসময় সৎ  পথে থাকো আর পরিশ্রম করো। ভালো ফল একদিন না একদিন পাবেই।”এই বলে সাধুবাবা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর এদিকে রাজার বউ নিজের ভুল বুঝতে পারল এবং তার সব লোভ ত্যাগ করে সুখে শান্তিতে রাজার সঙ্গে বসবাস করতে লাগলো। এছাড়া রাজার সঙ্গে সঙ্গে সেও পরিশ্রমী হয়ে উঠল।

Post a Comment

0 Comments